পাহাড়িয়া বাঁশি বিশেষ ভ্রমণ

মহাকালের পথে

ধ্রুবজ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়

সমান্তরাল আর খরস্রোত কখনও একসঙ্গে চলে না। সমতলভূমি এবড়োখেবড়ো হলেও পাথর গড়ায় না। সেখানে যতক্ষণ না ঢাল এসে পড়ছে ততক্ষণ জীবনে স্রোত নেই। গড় গড় করে যখন শব্দ হতে শুরু করবে, তখন আর জীবনের হিসাব কষার সময় থাকবে না। সে জীবন ঢালের জীবন। শীতের ধূসর বিকেলে এমন এক ঘাস জমির ঢালে গিয়ে পড়লাম। তখন দিন প্রায় শেষ। বৃদ্ধ গাইড এক পাও এগোতে চায় না। উল্টে ভয় দেখায় ও পথে এই বিকেলের পর  যাওয়া মানা। পাহাড় থেকে নেমে আসতে পারে বিপদ। আমরাও নাছোড়। সঙ্গী বলতে সাত-আটজনের টাটকা শরীর। দীর্ঘ ট্রেন যাত্রার পরও তাতে পর্যাপ্ত জীবন মজুত। পেটে খাদ্য আর মনোবল নিয়ে সে পথে আমরা যাব, যেভাবেই হোক। সুযোগ বুঝে কিছু বাড়তি চেয়ে বসল গাইড। তাতেও রাজি। নিয়ে চলো। শীতের ধূসর দুপুর তখন সবে অবসর নামিয়ে এনেছে জয়ন্তীর বুকে। আশপাশে পাথর ঠোকার শব্দ।

নদীর বুকে সেতুটা অনেকখানি বুজে গেছে। চূড়াটুকু জেগে। চির চিরে কিছু পাখির ডাক পড়ন্ত বিকেলে এসে মিশছে পারদ নামানো কনকনে মাঘের হওয়ায়। ওপারের জঙ্গলের রেখাটুকু বাদ দিলে এক কিলোমিটার চওড়া নদীর বুকে একফালি মাত্র জলের রেখা বয়ে চলেছে সমতল খাতে। গোড়ালি ডোবে না। আমরা যাব উত্তর-পুবে ভুটান সীমান্তের দিকে। লেপচা পাহাড়ের পিঠের নাগালে মহাকাল মন্দির। শোনা গেল পাহাড়ের গায়ে খাড়া পথে ছোট মহাকালও হয়েছে। হাতে সময় কম। তাই আমরা সেটুকুই দেখতে চাই। বিকেল গড়িয়ে গেলে সে পথে যাওয়াও মানা। দূর দিগন্তে সূর্য ডোবার পালা শুরু হয়েছে। পাহাড়ের নিয়ম যেমন। একটা করে কপাট বন্ধ হতে হতে ঝুপ করে সেখানে সন্ধ্যা নামে। পা বাড়ালাম চড়াই-উতরাইয়ের উজান পথে। সঙ্গে জুটল পাহাড়ি এক কুকুর। আমরা যেন যুধিষ্ঠিরের দল!

একদিন দল বেঁধে।

ঘাস জঙ্গলের পথ

এমন সব রাস্তায় জীবনের মোড় ঘুরে যেতে পারে। জয়ন্তীর ধার ঘেঁষে এক মানুষ সমান ঘাসের জঙ্গল। আশপাশে কিছু দেখার উপায় নেই। ধূসর বাদামি। পাশে নদীর খরস্রোতের শব্দ। উতরাই ধরে এগোলে হাওয়ার বেগের সামনে মাথা নত না করে উপায় থাকে না। প্রথম নেমেছি এই পথে। ঘাসের এই জঙ্গলের ঠিক পেছন থেকেই ঘন জঙ্গলের শুরু। শত চেষ্টাতেও তার নাগাল পাওয়া যায় না। লেপচা পাহাড়ের কোলে গুহামন্দিরের রাস্তাও ঠাহর হয় না ঘাসের লম্বা শরীরের ফাঁকে। প্রায় এক কিলোমটার হেঁটে পেরোতে হবে। এত মিহি অথচ ঘন লম্বা ঘাস জীবনে আগে দেখিনি। ধূসর পাহাড়ের ধুলোমাখা। বৃদ্ধ গাইড দ্রুত হেঁটে অনেকটা আগে পৌঁছে গিয়েছে। এর ওর মুখ থেকে খবর এল এসময় জঙ্গল থেকে হিংস্র শ্বাপদরা নেমে আসে। তবে তারাও সুযোগ খোঁজে। চট করে ঝাঁপায় না। কিন্তু সে সুযোগ তারা পেল কিনা, তা দেখার উপায় নেই সাত ফুটের ঘন ঘাসের জঙ্গলে।

এতক্ষণ খেয়াল করিনি, পায়ে পায়ে কুকুরটা পাহাড়ের কোলে এসে দাঁড়িয়েছে। এবার সোজা খাড়া পথ। গায়ে ছিটেফোঁটা পাহাড়ি ধারার জল এসে পড়ছে। এক লাফে আমাদের টপকে গেল কুকুরটা। উপর থেকে স্বর ভেসে এল, বুঝে পা ফেলবেন। সরু ঝোরাগুলো দ্রুতপায়ে গড়িয়ে নামছে। এলোমেলো পা ফেলেছ কী সোজা নীচে। উপর থেকে বুড়ো গাছের কিছু ঝুরি নেমে এসেছে। সেসব ধরে পা মেপে চড়তে লাগলাম মহাকালের পথ। এক পা এগোতেই বিস্ময়। ঘড়িতে সময় আচমকা থমকে গেল। তাকালাম ভাল করে। অবাক কাণ্ড! আধ ঘন্টা পিছিয়ে গেলাম কীভাবে! জবাব দিল গাইড। ভুটানে পা রেখেছেন। বায়বীয় সীমান্ত সময়টাকে টেনে পিছিয়ে দিয়েছে। এ কী শিহরণ না রোমাঞ্চ! ঘড়ির কাঁটা আবছা যতটুকু দেখা যাচ্ছে সওয়া পাঁচটা। ছোঁ মেরে কে যেন নিয়ে গেল ভারতীয় ৩০ মিনিট। পাহাড়ি আকাশে এক ফোঁটাও আলো বাকি নেই। শনশনে হাওয়াটা এতক্ষণ যে অবিরাম ঠেলে চলেছিল, হঠাৎ যেন গুম হয়ে গেছে। চারপাশটা কেমন স্যাঁতস্যাঁতে আর জল চুঁইয়ে পড়ার শব্দ।

ছোট মহাকালের পথটাও খুব একটা সহজ নয়। ভাঙাচোরা পথের উতরাই পেরোতে সিকি ভাগ হলেও মূল্য দিতে হল। মাধ্যাকর্ষণের টানে ক্রমশ প্যাচপ্যাচে জলের বিন্দু বেরিয়ে আসছে শেওলাধরা পাহাড়ের গা বেয়ে। অন্ধকারে ঠাওর করতে না পেরে একজনের হাত পিছলে গেল। ভর অনুযায়ী পা দুটোও। সপাটে এসে আমার গায়ে। সামলাতে পারলাম না। নরম মাটি। বুড়ো গাছের ঝুড়ি পটপট শব্দে কয়েকটা ছিঁড়ে নিয়ে কয়েক ধাপ গড়িয়ে এসে পড়লাম। ততক্ষণে অনেকখানি উঠে পড়েছে কুকুরটা। গায়ের রং সাদা। সেই অন্ধকারেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। সে-ও তাকিয়ে আমাদের দিকে। চোখ দুটো জ্বলছে। ওই অবস্থায় ভুল হতে বাধ্য, জ্বলন্ত চোখ জোড়া কুকুরটারই তো। ভুল সে নিজেই ভাঙাল পরপর দুবার ঘেউ ঘেউ চিৎকার করে। সে যেখানে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, সামলে নিয়ে উঠে গিয়ে দেখলাম সেটাই ছোট মহাকালের গুহা মন্দির। ছোট কয়েক খণ্ড শিলা সেখানে ঈশ্বর রূপে পূজিত হয়। শেষ বিকেলেই কারা সিঁদুর ফুল দিয়ে গেছে।

রহস্যের টানে।

পূর্ণিমার দরজা খুলছে জয়ন্তী

ভরা পূর্ণিমায় যে জয়ন্তী গিয়ে পৌঁছেছি তার আসল রূপ মালুম হল ফিরতি পথে। সন্ধ্যার অন্ধকার থেকে মুখ সরিয়ে চাঁদ যে ভাবে মহাজাগতিক চেহারা নিয়ে সামনে আসছে সুদূর কল্পনাতেও এ জিনিস দেখব ভাবতে পারিনি। পোড়া বিকেলে যে দৃশ্যপট পিছনে ফেলে এসেছিলাম তাই এখন সামনে এসে দাঁড়িয়েছে প্রবল হাতছানি নিয়ে। একটা উঁচু ঢিবির উপর দাঁড়িয়ে সেই ঘাস জঙ্গলের পুরোটা একেবারে উঠোনের মত পরিষ্কার দেখাচ্ছে। গা-লাগা জঙ্গল আরও ঘন। যদিও সন্ধ্যার আঁধার একইসঙ্গে একটু উপকার করে দিল। দুপুরে বা বিকেলে শ্বাপদের যে উপস্থিতি ঘাস জঙ্গলের ফাঁকে টের পাওয়া দুঃসাধ্য ছিল, অন্ধকারে তাদের জ্বলন্ত চোখ এবার দেখতে পাওয়া যাবে। এত অন্ধকারে সেই কাজটা অন্তত পঞ্চাশ ভাগ সহজ। তবে মন সেদিকে নেই। কারণ ততক্ষণে শীতল আঁচ বাড়াতে শুরু করেছে পূর্ণিমার সদ্য ফোটা চাঁদ। দু’একটা ডুয়ার্সের চিতা যে আশপাশের জংলি রাস্তা থেকে আমাদের উপর নজর রেখে চলছে না তেমনটা বোধহয় একেবারেই নয়। এবং এ সন্দেহও নেই যে, তারা এই ঘাস জঙ্গলের অ্যাম্বুশের ফাঁকেই কোথাও লুকিয়ে থাকতে পারে। তার পরও গোলাপি কুসুমের মতো চাঁদের আলো যে মায়ার পৃথিবী তৈরি করছে অনায়াসে মনের টান এখন সেদিকে। অনভ্যাসের পাহাড়ি পথ চলায় শরীরে এখন ক্লান্তি কামড় বসিয়েছে। তাতে নরম মাটিতে পা সরে যাওয়ার ঘটনায় পেশিগুলো বেশ বিরক্ত। জানানও দিচ্ছে সে কথা। মায়ার দৃশ্যপটে নজর যাওয়ার কথা নয়। কিন্তু এ মোহের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে থাকব এমন মূর্খও বোধহয় নই। সঙ্গে যা ভাবছিলাম রয়েছে ঠিক তার উল্টো। শরীরের ক্লান্তি মায়ার বশে মনকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। যতদূর দেখতে পাচ্ছি ধূসর কুয়াশা ঘিরে ফেলছে নদীর বুক। তার উপরই লালচে চাঁদের গোলাপী জ্যোৎস্না মায়া মাখাচ্ছে। শীতল এক আভা। আদিগন্ত পড়ে রয়েছে শুকনো ধবধবে সাদা পাথর। নদীর বুকে জলের শব্দ আরও স্পষ্ট। ক্ষীণ। হিম। ওদিকে যে পা চলতে চলতে কখন ফের সেই ঘাস জঙ্গলের মুখে এসে ঠেকেছি খেয়ালই নেই। ইলিউশন হচ্ছে! শ্রান্ত চরণ, শরীর ভাঙা ঘাম নাকের পাশে কানের নীচে শুধু কিছু দাগ রেখে গেছে। পাহাড়ি শুকনো বালুকণা চোখে মুখে লেগে। আর কোনও ক্লান্তি বাকি নেই শরীরে। হয়তো পর্যাপ্ত অক্সিজেন বা পটাশিয়াম স্তরও উপর নিচ হয়ে রয়েছে। শরীর পুরোপুরি রাসায়নিক অসামঞ্জস্যের বশ। তবু সেদিকে মন নেই।

পোড়া বিকেলের রঙে যে ঘাস ধূসর দেখিয়েছে, এখন তার রং মেটে। কোথাও কালচেও। গোড়ার দিকে তাকানো যায় না। ঘন ঘাসের ফাঁকে ফাঁকে রাস্তার বাঁক। কে যেন মাথার উপর থেকে আলো ধরে সেই রাস্তা চিনিয়ে নিয়ে চলেছে। আর কোনও ভয় নেই। আতঙ্ক নেই। যেন মহাকাশ মহাজগৎ জয় করে ফিরছি গুটিকয়েক নভোশ্চর। মাথার ভিতরে শিরশিরে একটা আহ্বান শুধু অনবরত টোকা দিয়ে চলেছে। পথ আর বেশি দেরি নেই। এ কী নিশিতে পেল? মুহূর্তে উপরের দিকে মুখ উঠল। হ্যামিলনের বাঁশি এ নয়। গোটা আকাশগঙ্গা যেন তীব্র হাতছানিতে টেনে নিয়ে চলেছে ভবিষ্যতের দিকে। এ বর্তমান আমার নয়। অতীত ফুরিয়ে গেছে কবে। মাটিতে পা পড়ছে না। ঘাড়ে মাথায় দুই বাহুর শিরায় একসঙ্গে এক ঝাঁক উড়ন্ত জ্যোৎস্না আলতো করে ধরে টেনে নিয়ে চলেছে। কোনও ক্লেশ নেই। অবিরাম শুধু দৃশ্যপটের বদলে যাওয়া।

সঙ্গী সেই কুকুর।

বেমক্কা একটা পাথরে পা পড়তেই হুড়মুড়িয়ে সেটা নীচে নেমে গেল। আচমকা খাদে পড়ে যাওয়ার ভয় ছটফটিয়ে উঠলেও বিষয়টা ততটা ভয়ের ছিল না। যাওয়ার পথে যে ভাঙা ধাপ কসরত করে চড়তে হয়েছিল সেটার কথা ভুলেই গেছিলাম ফেরার পথে। ঘাস জঙ্গল শেষ করে একটা ছোট্ট ধাপ নেমে গিয়ে মিশেছে সামনের খোলা ভাঙাচোরা পাথুরে চত্বরটায়। আর কোনও বাধা নেই। সামনে আদিগন্ত বিস্তৃত নদীর বুক। চরই বলা চলে একে। এভাবে যে ঘোর কাটবে বুঝতেই পারিনি। অসাবধানে প্রায় হুড়মুড়িয়ে এসে পড়ছিলাম নিচে নদীর ধারে। কুকুরটার এ পথ হাতের তালুর মতো চেনা। ফিরতি পথে তাই ঘাস জঙ্গলের রাস্তায় সে ঢোকেইনি। ঘুরে এসেছে নীচের পাথুরে জমি ধরে। এখন লেজ নাড়াচ্ছে আমাদের অপেক্ষায়। আরও কিছুটা পরিশ্রমের পর উঁচু-নিচু খরস্রোতা পথে পৌঁছলাম কটেজে। তখনও যে জীবনের সেরা চমক সম্ভবত অন্তিম বিস্ময়ের ঘোর লাগা বাকি রয়ে গেছে ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি। যে পূর্ণিমা রাতের জঙ্গল নদী এমন ধূসর শুভ্র পাথুরে নদীর চরের অপেক্ষায় রোমাঞ্চের দিন কাটে, রাত যুবক হয়, সেই সন্ধিক্ষণ তখনও ঘনিয়ে আসেনি। পা বাড়ানো হয়নি উপত্যকার বুকের মৃত্যুপথে।

রহস্য রেখে গেলেন বাঙালি রান্নার ঠাকুর

গোটা দিনের ক্লান্তি আর পাহাড়ি জ্যোৎস্নার মায়া ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিল। চোখ মেললাম দরজায় টোকা শুনে। ততক্ষণে চারিদিক অনেকটা শান্ত। এমন সময় ঘরের বাইরে কে হতে পারে! কটেজে লাগোয়া ঘর দুটো। সব মিলিয়ে আমরা আটজন। পাশাপাশি দুটো বিছানায় প্রায় গা ঘেঁষাঘেঁষি করে এতক্ষণ পড়েছিলাম। টোকা শুনে হুড়মুড়িয়ে একে তাকে ডেকে দরজা খুলে দেখি রান্নার ঠাকুর নিজে। বাঙালি। কী ব্যাপার? রাত বাজে সাড়ে ন’টা। এখন খাওয়ার ঘরে গিয়ে পাত পেড়ে বসার অপেক্ষায় আর কেউ নেই। পাহাড়ে এই রাত অনেকটাই। আমাদের জন্য আর কেউ জেগে থাকতে পারবে না। তার ঘর এই পথে। ফেরার পথে খাবারটুকু নামিয়ে দিয়ে তাই সে পালাবে। তার কড়া নির্দেশ, বাইরে বসেই খাওয়া-দাওয়া সেরে পাত সেখানেই রেখে দিতে হবে। সবই না হয় বুঝলাম। কিন্তু পারদ পাঁচের মাত্রা ছাড়িয়ে নেমে গিয়েছে। শনশনে হাওয়ায় সোজা দাঁড়িয়ে থাকা দায়। রান্নার ঠাকুরের শরীর দেখে অবশ্য আবহাওয়ার তেমন রকমফের মালুম পাওয়া দুষ্কর। পাহাড় ঘেঁষা ডুয়ার্সের কটেজ হলেও লোকটি তো বাঙালি। বাঙালি শীতকাতুরে শুনেছিলাম। কিন্তু বোঝা গেল এ পাড়ার হাওয়া তার অনেক দিনই গায়ে লেগেছে। একটা পাতলা গেঞ্জি তার সঙ্গে স্রেফ ময়লা একটা চাদর জড়ানো। আমাদের সঙ্গে আর বেশি বাক্যব্যয় করতে সে নারাজ। রান্নার ঠাকুর হলেও তার কথার দাম সে আদায় করে নিতে জানে। আরও একবার তাই জানিয়ে দিল দ্রুত খাওয়া-দাওয়া সেরে শুয়ে পড়ুন। আরও কড়া সতর্কবাণী, রাত এগারোটার পর ঘরের বাইরে পা দেবেন না। বারান্দার আলোটুকুও যেন না জ্বলে। এমন কথা বলল কেন? রাত এগারোটার পর কী হয় এখানে? পেটে তখন ছুঁচোয় ডন দিচ্ছে। তবু খাওয়ার কথা মাথায় উঠলো। লেপচা বা গোর্খা হলে হয়তো এত কথাই বলত না। বাঙালি বলেই আরও কতগুলো বাঙালিকে বোধহয় সাবধান করে গেল। কিন্তু বিষয়টা কী? সাবধান হওয়া দূরে থাক, কৌতূহল আরও বেড়ে গেল। ঠাকুরকে চেপে ধরলাম। কিন্তু কিছুতেই সে মুখ খুলবেনা। শেষে অনেক ধরে খাওয়া-দাওয়ার বিষয়টা ঠান্ডায় বারান্দায় বসে না করে ঘরের ভিতরে সেরে নেওয়ার অনুমতিটুকু আদায় করে নিলাম। খাবার সে দিয়ে গেল। ফিরলও দ্রুত পায়ে। শুধু শোনা গেল, ‘থালাটালা যা থাকে রেখে দিন। সকালে নিয়ে যাব’।

অবশেষে হাতছানি এল মৃত্যু উপত্যকার

গরম ভাতে ডাল, একপদ ভাজা, সঙ্গে কী একটা সবজি। শেষে ডোঙা করে কাটা আলু দিয়ে বড় বাটিতে মাংস। পাকস্থলিটা যেন তৈরি হয়েই ছিল। এক মুহূর্ত দেরি করেনি সাবাড় করতে। খাওয়ার পর্ব মিটতেই জানলা টপকে বাইরে লাফ দিয়ে পড়ল লাল্টু। পেট পুরে খেয়ে তার নাকি শরীরে এখন প্রবল এনার্জি। আর সে দেরি করবে না। বেরিয়ে পড়তে হবে। এই রাতে ভরপেট খেয়ে সে চলল কোথায়! বিদেশ না হলেও মোটেই পাড়ার রক নয়। আশপাশে আরও দু’-একটা কটেজ থাকলেও তার ঠিক পাশ থেকেই জঙ্গলের শুরু। এত রাতে এমনভাবে আচমকা না বেরোনোই ভালো। হঠাৎ বাঙালি ঠাকুরের সাবধান বাণী মনে এল। রাত এগারোটার পর এক পাও বাইরে নয়। ভয় তো চেপে ধরলই। তার চেয়ে বেশি পেয়ে বসল কৌতূহল। রাত এখন এগারোটা দশ।

টপাটপ দরজা খুলে গায়ে ভারী কাপড় চাপিয়ে বেরিয়ে পড়লাম দু’-তিনজন। সঙ্গে লাল্টুর জ্যাকেট। চোখে-মুখে প্রবল ধাক্কা লাগল। ঝরনার মতো অজস্র আলোর ধারাপাত যেন স্বর্গ থেকে নেমে আসছে। আচমকা ফোনের টাওয়ারটা ব্লিঙ্ক করে উঠল। তাই তো, এখানে আসা ইস্তক প্রায় গোটা একটা দিন বাড়িতে খবর দিতে পারিনি। ফোনটা একটু তুলে ধরতেই ধাঁধিয়ে গেল চোখ। ঠিক আমাকে তাক করেই যেন অজস্র জোনাকির ধারা জ্যোৎস্নার পাখায় ভর করে বয়ে আসছে। তার টান ফেরানো অন্তত আমার পক্ষে এই অবস্থায় সহজ নয়। দুর্বল করে দিচ্ছে সমস্ত ভাবনা। সবটুকু জীবিতের ইচ্ছা। অনর্গল জ্যোৎস্নার ধারা অসহনীয় অথচ শীতল কর্ষণে টেনে নিয়ে যেতে চাইছে রূপকথার এক অষ্টপ্রহর ঘুপচি খোপে। কোনওদিন কোনও কালে সেখানে সূর্যের আলো পৌঁছবে না। অজস্র জোনাকি আড়াল করে রাখবে আমার মাথার ভিতর থেকে শরীর থেকে উঠে আসা বেঁচে থাকার একরাশ আগ্রহ। চোখের সামনে এক সমুদ্র আকাশ ভরে থাকবে নীল জ্যোৎস্নায়। সাদা ফেনার মতো অজস্র ঢেউ এসে লাগবে। আমার আত্মার সঙ্গে মিশবে। এতদিনে তার ওড়ার সাধ পূর্ণ হবে। শরীর নিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে সেই নির্যাস। মুঠো করা হাত খুলে গেছে। পায়ের তলায় অফুরান আলোর ফুলকি। মাথার পিছন থেকে নিচের দিকে নেমে যাচ্ছে কী এক অতীত মাখা জীবন। চাঁদের বাড়ির হদিশ পেয়ে গেছি। এমন স্নিগ্ধ আলো পৃথিবীর নয়। শিরায়-উপশিরায় এই শিহরণ মহাজাগতিক। সামনের পাহাড় বেয়ে নেমে আসছে ধূসর শুভ্র ধোঁয়াশা। তাতে মেঘ মিশেছে। পায়ের তলায় সেসবই আলতো ছুঁয়ে গেল। নিজেই নিজের ছায়া হয়ে আলো থেকে নিজেকে আড়াল করে রেখেছে একটা নেড়া গাছ। তার দু’টো ডালের ফাঁক দিয়ে চাঁদের একটা কোণা যেন ভেঙে পড়ছে পাহাড়ের গায়ে। দু’হাত বাড়িয়ে ছুটে চলেছি। উড়ে চলেছি সেই কণাটুকু লুফে নেওয়ার আকাঙ্ক্ষায়। কেউ পা ধরে টানছে না, কেউ ঝাঁকিয়ে দিচ্ছে না। কেউ ভুল পথে নিয়ে যাচ্ছে না। কেউ কোথাও নেই দূর থেকে পৃথিবীর সীমা আবছায়া হয়ে আসছে। ধীরে ধীরে নেমে আসছে চাঁদের কণাটুকু। পৃথিবীর বুকে সেই চাঁদ ঝরনার উপত্যকা বেয়ে নেমে আসার আগে লুফে নিতে হবে জীবনহীন নীল জ্যোৎস্না মাখা এই মৃত্যুকে। টপ করে খসে পড়ল চাঁদ। ওই তো, ওই ওই জঙ্গলের ফাঁক দিয়ে গাছের বাকল ধরে সরসর করে নেমে যাচ্ছে জোনাকির সারি। সরে যাচ্ছে মেঘ কুয়াশামাখা চাদর। জয়ন্তীর মাথার উপর থেকে আর তার জল চিকচিকে দেখাচ্ছে না। আবার সেই আদিগন্ত গাছের রেখা ফিরে আসছে চোখের সামনে। এত কষ্ট হচ্ছে কেন! চাঁদ কোথায়? ওই যে আছাড় খেয়ে নদীর ধারে তখন লালটু পড়ে গেল তার শব্দেই পালিয়ে গেল নাকি।

এমন তো হওয়ার কথা নয়। শীর্ণ এক ফালি জানলার ফাঁক ভেদ করে সটান রোদ এসে পড়ছে মুখে। আরে! পর্দাটা কে সরিয়ে দিল? পার্থর গলা পেলাম, লাল্টুকে বাথরুম থেকে বেরোতে বলছে। ‘জানো তো কাল আমরা যখন ফিরলাম তারপর কী হয়েছে?’ —পার্থর প্রশ্ন। মাথার ভিতরে বোধ চিড়বিড় করে উঠছে। ‘কী হয়েছিল রে?’ পাল্টা আমি। ‘রাত প্রায় তখন সওয়া বারোটা। এই একটু আগে দারোয়ানটা বলল। এক পাল হাতি নাকি বেরিয়েছিল। আমরা যে পথে বেরিয়েছিলাম ঠিক তার উল্টো দিকের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এ পারে এসে আবার ফিরে গেছে!’ ‘আমরা কোথায় ছিলাম?’ পার্থ সন্দেহ করল, ‘মনে হচ্ছে সত্যিই ভুলে গেছো। কাল আমাদের কটেজে ফিরতে প্রায় একটা বেজে গেছে। বরাতজোর বেঁচে গেছি।’ ‘বাঙালি ঠাকুরটা কোথায় রে?’— আমার প্রশ্ন শুনে দরজা খুলে বাইরে গেল পার্থ।

ছবি— লেখক ও অনিকেত মুখোপাধ্যায়

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *