অন্য সফর বিশেষ ভ্রমণ

ঋতু বদলে রূপ বদলায় কাঁসাই হল্ট

নন্দিতা দাস

ট্রেন থামে। লোকজন ওঠা-নামাও করে। কিন্তু না আছে প্ল্যাটফর্ম, না আর কোনও কিছু, যা দিয়ে স্টেশন বলে চেনা যায়। আনকোরা লোক ভাবতে বাধ্য, ‘গাড়ি বোধহয় সিগন্যালে আটকাল’। কৌতূহলী হয়ে ট্রেনের জানালা দিয়ে উঁকি দিলে চোখে পড়ে, ফাঁকা ঢেউ খেলানো জমি, একটা তালাবন্ধ টিনের গুমটি (গার্ডবাবুর ভাষায় গ্যাং হাট), পরিত্যক্ত কেবিন অফিস আর একটেরে বহু পুরনো ছোট্ট একটা প্ল্যাটফর্ম। যদি সেটাকে ‘প্ল্যাটফর্ম’ বলা যায় তো! কারণ সেটি দৈর্ঘ্যে এতটাই যে ১২ কামরার ট্রেনের একটি মাত্র কামরাও পুরোপুরি তার আওতায় আসে না।

এমনই এক জায়গা হাওড়া-মেদিনীপুর লাইনের কাঁসাই হল্ট স্টেশন। খড়গপুরের পর গিরি ময়দান-গোকুলপুর পেরিয়ে এসে কাঁসাই নদীর উপর রেলব্রিজ। নদীর ওপারে মেদিনীপুরের শহরতলির সীমানা। এপারে, রেলব্রিজের ঠিক আগে, কাঁসাই হল্ট।

এরই নাম প্ল্যাটফর্ম।

‘যথা ইচ্ছা তথা যা’য় খোঁজ চলছে ‘নদীর নামে স্টেশন’এর। গুরুমশাইয়ের নির্দেশ, ‘নদী আছে, ট্রেনও থামে। নামেও নদী। ব্যাস! আর কী! লিখে ফেল তবে”। গুরুমশাই তো বলেই খালাস। এদিকে দু’কলম লিখতে যে ছাত্রীর হৃদকম্প উপস্থিত হয় তা কি আর তাঁর অজানা! যাই হোক। নির্দেশ যখন এসেছে, পালন তো করতেই হয় (না হলে কানমলা খাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে কি না!)।

কেবিন, গ্যাংহাট ইত্যাদি।

লিখতে বসে ভাবি, ‘লিখবটা কী’! কিছুই তো নেই। ক্ষীরাইয়ের মতো রাজকীয় ফুলের শোভা নেই। গুমানীর ‘অভিমানী’ নদী নেই। এমনকি ‘স্টেশন’ হতে গেলে যা কিছু আব্যশিক তার তো কিছুই নেই। আছে শুধু একা একটা নদী। কংসাবতী। আদুরে ডাকনামে কাঁসাই। ঘোর বর্ষায় যখন ঘোলা জল নদীর বুকে পাক খেতে খতে প্রবল বেগে বয়ে যায়, তখন মনে কেমন সম্ভ্রম জাগে। কাঁসাই নাম তখন তাকে আর মানায় না। তখন সে কংসাবতী। পূর্ণ যৌবনা। বর্ষা শেষের সারা বছর সে বড় শান্ত। নীলচে সবুজ জলে তার অপার স্নিগ্ধতা। তখন সে বড় আপনার কাঁসাই। যদিও রেলের সাইনবোর্ডে ইংরেজির বদান্যতায় কাঁসাই হয়ে গেছে Cossey River। কাঁসাইয়ের দুইপাড়ের যোগসূত্র বলতে কেবল দু’টো রেলব্রিজ। শুখা মরসুমে তার সঙ্গে যোগ হয় রেলব্রিজের খানিক দূরেই তৈরি হওয়া এক বাঁশের সাঁকো। যদিও মনে হয় যে প্রতি বর্ষাতেই সেটা জলের তোড়ে ভেঙে পড়ে।

ঔপনিবেশিক শিক্ষাদীক্ষার ছাপ বানানে।

কাঁসাই হল্ট এক এক মরসুমে এক এক রূপে সেজে ওঠে। বর্ষায় সে সবুজ বরণ। আকাশে পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ জমে থাকে। কাঁসাইয়ের বুকে তাদের ছায়া পড়ে। শরতে দুই পাড় কাশে-কাশে সাদা। রিক্ত শীতের পরে বসন্ত তার লাল রঙে রাঙিয়ে যায় কাঁসাই হল্টকে। দূর থেকে বোঝা যায় না পলাশ নাকি শিমূল।

ওই দূরে গ্রীষ্মের যোগাযোগের বাঁশের সাঁকো।

নদীর পাড়ে ফাঁকা মাঠ-গাছপালার সীমানা ছাড়িয়ে উঁকি দেয় বসতির আভাস। টালির চাল। পরিত্যক্ত ইঁটভাটার চিমনি। মাঠের মধ্যে দিয়ে পায়ে-পায়ে, চাকায়-চাকায় তৈরি হওয়া পথ। পাকা রাস্তা চোখে পড়ে না। মনে হয়, এখানের আশেপাশের মানুষদের মেদিনীপুর-খড়গপুর যাওয়ার সহজ মাধ্যম এই রেলপথ। তাই হয়তো স্টেশন-প্ল্যাটফর্ম কিছু না থাকা সত্ত্বেও সব লোকাল ট্রেন থামে এখানে। গুটিকয় যাত্রী ওঠা-নামা করেন। হয়তো এই যাত্রী সংখ্যা ভারতীয় রেলওয়ের কাছে এতোটাই নগণ্য যে তাদের জন্য প্ল্যাটফর্ম বানিয়ে দেওয়া রেল লাভের মনে করে না। তাই ট্রেন থামলেও মেলে না আর কোনও পরিষেবা।

ট্রেনের কামরা থেকে কাঁসাই সেতু।

নদীর ওপারে দ্রুত বসতির বিস্তার এপাড়ে তার ছায়া ফেলতে পাড়ে না। ওপারের মেদিনীপুর স্টেশন যতটা মুখর, এপারের একাকী কাঁসাই হল্ট ততটাই মৌন।

(সমাপ্ত)

One thought on “ঋতু বদলে রূপ বদলায় কাঁসাই হল্ট

  1. ট্রেন থামে নদীর জন্য ….শরত, শীত, বসন্তে কাঁসাই তো সাজ বদল করে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *