পাহাড়িয়া বাঁশি বিশেষ ভ্রমণ

দুয়ারসিনির দুয়ারে

দীপক দাস

নদীটার নাম সাতগুরুম। ক্ষীণতোয়া। সেই নদীতে একদল লোক মাছেদের ইলেকট্রিকের শক দিচ্ছে। শীর্ষেন্দুবাবুর ভাষায় বলতে গেলে, ঘুরতে এসে এমন অশৈলী কাণ্ড দেখে আমরা থ। দাঁড়িয়ে পড়লুম সাতগুরুমের ওপরের ছোট্ট পাকা সাঁকোর ওপরটায়।

দুয়ারসিনি ঘুরতে এসে বারবারই এমন ভাবে থমকাতে হচ্ছে। কখনও প্রকৃতির কাছে। কখনও মানুষজনের কাছে। চার বন্ধু চলে এসেছি শহরের পুজো ছেড়ে। সুদূরপানে। আমাদের চারজনের এবারের বেস ক্যাম্প হয়েছে বাঁকুড়ার ঝিলিমিলি। সেখান থেকে পাড়ি জমিয়েছি পুরুলিয়ার দুয়ারসিনিতে। বান্দোয়ান থানার মধ্যে পড়ে জায়গাটা। ভ্রমণ সাইটে বা খবরের কাগজে দুয়ারসিনি নিয়ে লেখা হলে অনিবার্য ভাবে থাকে এখানকার তিনটি সরকারি কটেজের ছবি। আর কিছু বর্ণনা। কিন্তু দুয়ারসিনি কটেজ আর ওই বর্ণনা থেকে আরও অনেক কিছু। সে বোধহয় শুধু দেখার। ভাষায় প্রকাশ করার নয়।

পথে যেতে যেতে।

দেখাটা অবশ্য শুরু হয়েছে দুয়ারসিনি ঢোকার আগে। আমরা ঝিলিমিলি থেকে কুইলাপাল হয়ে দুয়ারসিনির পথ ধরেছি। সারথি শিবু হেমব্রম চৌখস ছেলে। সব রাস্তা চেনে। আর রাস্তার পাশের গ্রামের নামগুলোও জানে। পর পর পেরিয়েছি নেকরা, কাল্লিয়াবেড়া, শিরিশগোড়া। হঠাৎ সামনে চলে গ্রাম, টুকরো টুকরো জীবন দেখতে দেখতে গাড়ি সফর। রাস্তার পাশে চাষের জমি। আরও দূরে পাহাড়। দূরে পাহাড় আর কাছের চাষের জমির মাঝে কিছুটা খোলা ঘেসো জমি। তাতে গরু চরে বেড়াচ্ছে। আছেন কিছু বাগালও। আমি নিশ্চিত, এই রকমই কোনও দৃশ্য দেখে রবীন্দ্রনাথের অমল দইওয়ালাকে বলেছিল, সেখানে পাহাড়ের গায়ে সব গরু চরে বেড়াচ্ছে?

যেতে যেতে এক জায়গায় গাড়ি থামাতেই হল। দূরে একটা পাহাড়। পিরামিডের মতো। কিন্তু ধূসর নয়। সবুজ। ছবি তুললাম বেশ কিছু। তার পর একটা পুজো পেরিয়ে, আরও কিছু জমি ছাড়িয়ে হাজির হলাম দুয়ারসিনির দুয়ারে। দুয়ারসিনি ঢুকলে প্রথমে সকলে মন্দিরের কাছেই গাড়ি থামান। তার পর পায়ে হেঁটে ঘোরাঘুরি। আমরাও ঘুরলাম। হাটের দিকে একটু গেলাম। তার পর বাঁদিকে নদী খাতের দিকে। পাথরের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে সাতগুরুম। দু’চারজন পর্যটকও সেই খাতের দিকে নেমেছেন। ওই খাতের কাছেই ছোট্ট একটা মন্দিরের মতো আছে। তাতে একটা বিশাল খাঁড়া রাখা। আদিবাসী গোষ্ঠীর কোনও দেব বা দেবীর মন্দির। পাহান বা পুরোহিত একজন রয়েছেন।

সাজিয়ে রেখেছে প্রকৃতি।

আমরা আবার বড় রাস্তায় উঠে এলাম। ইন্দ্র এর মধ্যে কয়েক বান্ডিল বাবুই ঘাসের দড়ি কিনে ফেলেছে। ওর শপিংয়ের দিকে ঝোঁক আছে। এখানেও করে ফেলল। খুশিই হলাম। কারণ বাবুই ঘাস বুনে এখানের বহু মানুষের পেট চলে। তাছাড়া আমাদের কাছে কিছু স্মারকও তো রইল। আমরা মন্দিরটার ভিতরে একবার উঁকি দিলাম। দরজার পাশে শিবের ছবি আঁকা। ভিতরে সিংবাহিনী দেবী। কিন্তু এখানেই খটকা লাগে। ইনি একজন লোকদেবী। কোনও মূর্তি হওয়ার কথাই নয়। সিনি নামের মধ্যে একটা ইতিহাস আছে। ধর্ম সমন্বয়ের ইতিহাস। সেই ইতিহাস-শিক্ষা দিয়েছিলেন কোনওদিন চোখে না দেখা বন্ধু তরুণ সিংহ মহাপাত্র। তাঁর কথা অনুযায়ী, পণ্ডিতদের অভিমত লোকদেবীদের সিনি নামকরণের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বৌদ্ধ ভাবনা। বৌদ্ধ ধর্মের বিভিন্ন দেবদেবীর পূজারী বা পূজারিনীদের দেববাসী বা দেববাসিনী বলা হত।

দুয়ারসিনি মন্দিরের সামনে আমাদের সারথি শিবু।

পরে দেববাসীর অপভ্রংশ দিয়াসী এবং দেববাসিনীর অপভ্রংশ দিয়াসিনী হয়ে যায়। বৌদ্ধ মতে অনেক দিয়াসিনী সিদ্ধা রমণীরা ছিলেন অলৌকিক শক্তিসম্পন্না। এঁরা মৃত্যুর পর দেবী রূপে পূজিত হয়ে থাকেন। অবশ্য দিয়াসিনীর শেষাংশ আসিনী যোগে সমস্ত সিদ্ধা রমনীর নামকরণ হতো। পরবর্তী সময়ে আসিনী শব্দটি সর্বত্র যুক্ত না হয়ে সংক্ষেপে সিনি শব্দটি প্রচলিত হয়। অনেক ক্ষেত্রে গ্রামের নামের সঙ্গে সিনি শব্দটি যুক্ত হয়ে গ্রামদেবতা রূপে পূজিত হয়। তেমনই দুয়ারসিনি। ঝাড়গ্রামের গাড়রাসিনি।

এমন সুন্দরের মাঝে যেতে পেরেও শান্তি।

এই ইতিহাস জানার পরে স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন জাগে, মন্দিরে সিংহবাহিনী দেবী এলেন কোথা থেকে? সহজ উত্তর, সাংস্কৃতিক সমন্বয় থেকে। লৌকিক দেবীর সঙ্গে হিন্দু সংস্কৃতির মেলবন্ধন। কেউ কেউ হয়তো আগ্রাসন শব্দটি পছন্দ করতে পারেন। আমরা মন্দির ছাড়িয়ে কিছুটা হেঁটে গেলাম। কিন্তু মন ভরছিল না তাতে। দরকার আরেকটু যাওয়ার। সারথি শিবুকে ডেকে নিলাম। তার পর গাড়ি করে এগিয়ে যাওয়া।

সেই শৈলমালা।

ডান হাতে সেই সব খবরে আলো করে থাকা সরকারি কটেজ রেখে এগিয়ে গেলাম। রাস্তা এখানে বেশ ভাল। একটা বাঁক নেওয়ার পরে হঠাৎ বাঁদিকে নজর গেল। তার পরেই গাড়ি থামাতে বলা। সে এক অপূর্ব দৃশ্য। রাস্তাটার ডানপাশটা উঁচু টিলার মতো। আর বাঁদিকে দূরে পাহাড়ের শৃঙ্খল। পর পর পাহাড়ের চূড়া। সবুজে সবুজ। তাকিয়ে থাকলে ধীরে ধীরে আচ্ছন্ন হয়ে যেতে হয়। দীপু ততক্ষণে ফটোসেশন শুরু করে দিয়েছে। বাবলা মোবাইল নিয়ে ছবি তুলতে ব্যস্ত। ইন্দ্র সানগ্লাস পরে প্রকৃতি দেখছে। সারথি শিবু স্থানীয় দু’টি মেয়ের কাছ থেকে জায়গা সম্পর্কে তথ্য নিচ্ছে।

ছবি তুলতে তুলতে চোখ গেল পাহাড় চুড়োগুলোর দিকে। পাহাড়ের শীর্ষদেশে তখন মেঘের খেলা। একরাশ মেঘ ধীরে ধীরে ঢেকে দিচ্ছিল শৈলশিরাগুলো। একটা একটা করে পাহাড়ের চুড়ো মেঘে ঢাকা পড়ছিল। কিংবা পাহাড়ের মাথায় আটকে ঝুলছিল। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আমাদের আর কিছু করার ছিল না। এখনও কিছু করার নেই। শুধু সেই ছবিটা আরেকবার মনে করা ছাড়া। ওই সৌন্দর্য লিখে প্রকাশ করা যায় না। এই জায়গাটার নাম আসনপানি। পুরুলিয়ার মধ্যেই পড়ে। বলল শিবু। কিন্তু রাস্তার পাশের ফলক হিন্দিতে লেখা। দীপু বলল, বাংলা পক্ষ খবর পাইনি, তাই। না হলে তুলকালাম হত। এই এলাকায় কোনও তুলকালাম না হওয়াই ভাল। প্রকৃতি বড়ই রমণীয়। শান্ত।  

দূরে মৎস্যশিকারিরা।

আসনপানি থেকে রাস্তাটা সোজা চলে গিয়েছে বুরুডি, ঘাটশিলা। জায়গাগুলো আমাদের ঘোরা। তাই ঘোরালাম। দুয়ারসিনির মন্দিরের কাছে এসে হাট পেরিয়ে চলে গেলাম সাতগুরুম নদীর সাঁকোর ওপরে। যেখানে মাছেদের ইলেকট্রিক শক দেওয়া হচ্ছিল। এমন ভাবে মাছ ধরার পদ্ধতি আমাদের জানা ছিল না। আমাদের সঙ্গেই আছে নামী মৎস্য শিকারি বাবলা ওরফে ছোটা ডন। মাছ ধরার জন্য ওকে ভাড়ায় নিয়ে যায়। বাবলাও বলল, এমন পদ্ধতি কোনও দিন শোনেনি। নদীর জলে বোমা ফাটিয়ে মাছ ধরার কথা পড়েছি। কিন্তু মাছেদের শক দিয়ে কাবু করা! তাছাড়া বৈজ্ঞানিক ভাবেও সেটা সম্ভব কিনা বুঝে উঠতে পারলাম না। জলে মাছেদের শক দিতে গেলে নিজেদেরও শক লেগে যাওয়ার সম্ভাবনা। কিন্তু শিকারিদের কাছ থেকে ফিরে আসা একটা লোক তাই বললেন। আমরাও বিদ্যুতের তার দেখতে পেলাম। দূরে শিকারিদের দলটা। লম্বা মতো একটা কিছু নদীর পাড়ের দিকে ঝোপে ঠেকাচ্ছে, দেখা যাচ্ছে। কিন্তু তা-ও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। মাছ ধরার পদ্ধতি নিয়ে বিস্তর আলোচনা হল। আমাদের স্বল্প পড়া পদার্থ বিজ্ঞানের জ্ঞানে সাতগুরুমের বুকে ঘটে চলা শিকার পদ্ধতির শেকড় খুঁজে পেলাম না।

সেই অর্ধসমাপ্ত কটেজ।

মন দিলাম প্রকৃতিতে। সাতগুরুম অপরূপা। খালের মতো প্রবাহ। কিন্তু দু’পাশের ঝেঁপে আসা ঝোপঝাড় জঙ্গল নদীটাকে অন্য রূপ দিয়েছে। বেশ অ্যাডভেঞ্চারের নদীর মতো। কাছেপিঠেও আছে জঙ্গল। অনেকক্ষণ কাটানো যায় জায়গাটায়। আমরা কাটালাম। তার পর গাড়িতে উঠলাম।

গহন আবছায়ায় সাতগুরম নদী।

ও হ্যাঁ, দুয়ারসিনি থেকে সাতগুরুমের সাঁকোর দিকে গেলে একটা অর্ধেক হওয়া বাড়ি দেখতে পাওয়া যাবে। কোনও গেস্ট হাউস তৈরি হতে হতে থমকে গিয়েছে। থমকে গিয়েছে সেই আতঙ্কের সময়ে। দুয়ারসিনি ও আশপাশের মানুষ এখনও মনে করতে পারেন সেই সব দিনের কথা। ল্যান্ডমাইন, খুনের বিপ্লবের কথা।

সাতগুরুম নদীর কাছে পরিবেশ।

সে সব ভয় আর নেই। এখন শুধু প্রকৃতি আর প্রকৃতি। তার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেই হল। মনৌষধি।

ছবি— ইন্দ্রজিৎ সাউ, দীপশেখর দাস

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *