ইতিহাস ছুঁয়ে বিশেষ ভ্রমণ

বুলবুলের সঙ্গে ইটাচুনা রাজবাড়ি

তনয়া মুখোপাধ্যায়

কোনও ভ্রমণ গ্রুপের সদস্য হলে কোনওদিন মনে হয় না বাড়িতে কাটাচ্ছি। সবসময় বেশ বিনা খরচে দেশ বিদেশ ঘুরে বেড়ানো যায়। কিন্তু সত্যি যখন পরপর মাসগুলোর সারা সপ্তাহ জুড়ে MS excel আর সপ্তাহান্তে Surf excel বিরাজ করে তখন সব ফেলে কোথাও একটা পালানো ছাড়া গতি থাকে না। বড় বেড়াতে যাওয়ার সঙ্গী বা ছুটি কোনওটাই না পেয়ে ঠিক করলাম একদিনের জন্যই কোথাও যেতে হবে। আমার মতোই বেশ কয়েকটা পাগলি সঙ্গী পেয়েও গেলাম।এ বারের গন্তব্য হল ইটাচুনা রাজবাড়ি।

কাছারি বাড়ি।

কিছুটা ধারণা করে নিয়ে ফোন করলাম ওদের কলকাতার অফিসে। অক্টোবর মাস জুড়ে বুকিং থাকার জন্য নভেম্বর ই-বুকিং পেলাম। তারপর তো সারা মাস জুড়ে শুধু রাজবাড়ির চিন্তাতেই কাটিয়ে দেওয়া। যাওয়ার সময় এগিয়ে আসতে ধাক্কা দিতে এগিয়ে এল ঘূর্ণিঝড় বুলবুল। সবার বাড়িতে ছোটখাট বিধি নিষেধের বেড়াজাল পেরিয়ে যখন হাওড়া স্টেশন পর্যন্ত পৌঁছলাম তখন আর ঘূর্ণিঝড়ের তোয়াক্কা কে করে। ঝড় বৃষ্টির ভয়কে জয় করে সকালের বর্ধমান মেন লাইন লোকাল ধরে এক ঘণ্টার একটু বেশি সময় পরেই পৌঁছে গেলাম খন্যান স্টেশন। এক নম্বর প্ল্যাটফর্ম ধরে রেলগেটের দিকে এগিয়ে টোটো ধরে পৌঁছে গেলাম বহু আকাঙ্ক্ষিত রাজবাড়ি।

অন্দরমহল।

গেটে বুকিংয়ের এর নাম বলে ঢুকে অফিস ঘরে গিয়ে নিয়মমাফিক ফর্মালিটি সেরে রুম পেলাম। আমাদের রুমের নাম ছিল বিলাস মঞ্জরী। আমরা ছ’জন ছিলাম আর পেয়েছিলাম রাজবাড়ির সবথেকে সুন্দর ঘর। গোটা রাজবাড়ি আর বিলাস মঞ্জরীকে দেখে আমরা তখন ঘায়েল।

রাজবাড়ি।

রাজবাড়ির অফিস থেকে বলে দেওয়া হয়েছিল খাওয়ার সময় সম্পর্কে এবং বেশ কিছু নিয়ম যা আবশ্যিক। ঘরে গিয়ে অবাক হচ্ছিলাম শতাব্দী প্রাচীন এই রাজবাড়ির কারুকার্য এবং আসবাবপত্র দেখে। ঐতিহ্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আধুনিকতার ছোঁয়া মিলেমিশে একাকার।

চারপাশটা।

স্নান সেরে খাওয়া পর্ব। রাজবাড়ির অন্দরমহলের দিকে ঠাকুর দালান পেরিয়ে খাবার ঘর। বাইরে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টির সঙ্গে ভিতরে রাজকীয় খাওয়া দাওয়া। সে এক অনন্য অনুভূতি। খাওয়া শেষে ঘুরপাক আর ৪টে নাগাদ শুরু হল রাজবাড়ির গাইডেড ট্যুর। যা ওখান থেকেই ব্যবস্থা করা। সারা রাজবাড়ি এবং তার আশপাশ ঘুরে জ্ঞানের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করে চা খাওয়া হল। তখন কানে এলো অদ্ভুত এক বাঁশির সুর। যা মনকে মাতাল করে নিয়ে যায় এক রূপকথার দেশে। তার পরেই ঠাকুর দালানে আরতির সময় হতে যাওয়ায় সবাই জড়ো হলাম ঠাকুরের প্রাঙ্গণে। চোখ বুজে শঙ্খ ঘণ্টা ধ্বনির সঙ্গে পিছিয়ে গেলাম বহু বছর। মনে হল রাজবাড়িতে পুজোর অতিথি হয়েছি। নিঝুম রাজবাড়িতে বৃষ্টির ঝিমঝিম ও সঙ্গে পুজোর আবহ, কিছু অনুভূতি শব্দের অপেক্ষায় থাকে না। রাত্রে রাজকীয় ভোজের সঙ্গে মনটাও খারাপ হতে থাকল। কাল ফিরতে হবে।

শিবমন্দির।

সকালে উঠে চমক। সোনার মতো রোদে রাজবাড়ি ঝকঝক করছে। চা খেয়ে একটুও সময় নষ্ট না করে বাইরের দিকটাতে গেলাম আরও কিছু মুহূর্তকে ক্যামেরা বন্দি করতে। যেগুলো আগের দিন বৃষ্টির কারণে তোলা হয়নি। গোটা রাজবাড়ি ঘুরে ভিডিও বানিয়ে ছাদে গিয়ে বেশ কিছু সুন্দর স্মৃতিকে সঙ্গে নিয়ে বাইরের দিকে শিবমন্দির গেলাম। রাজবাড়ির কোনও এক মহিলা সদস্য স্বপ্নাদেশ পাওয়ার পর এই মন্দির প্রতিষ্ঠা হয়। কিন্তু মূর্তি যিনি আনেন তাঁর অকস্মাৎ মৃত্যুর পর পুজো শুরু হওয়া সম্ভব হয়নি। যাই হোক, এসব মিটতে এলাম সকালের খাবার খেতে। সকাল ১০টায় রুম ছেড়ে দিতে হবে। গোছগাছ করে নিয়ে বিলাস মঞ্জরীকে এবারের মতো বিদায় জানিয়ে চললাম প্রচেষ্টা নামক রাজবাড়ির স্টলে। কিছু কেনাকাটা করে রাজবাড়িকে সজল নয়নে বিদায় জানিয়ে ফেরার পথ ধরলাম। কানে বাজতে থাকল দ্বাররক্ষী দাদার মিষ্টি বিদায় সম্ভাষণ ‘‘আবার আসবেন দিদিরা।’’

করতে পারেন কেনাকাটাও।

দরকারি খোঁজখবর

১। রাজবাড়িতে যাওয়ার জন্য নির্দিষ্ট নম্বরে ফোন করে বুকিং নিতে হয়। ওখানেই টাকা পাঠানোর পর মেইল আইডিতে জানানো হয়। শুধু খাবার অর্ডার নেওয়া হয় আগের দিন। রাজবাড়ি থেকেই ফোন করা হয়। খাবারের বিল ওখানেই দিতে হয়। ওটা আগে নেওয়ার নিয়ম নেই।

এসে বসলাম আহারে।

২। দিন এর দিন ঘুরে চলে আসা যায় কিন্তু তার জন্য বুকিং লাগে। সেটাও কলকাতা অফিসে ফোন করেই নিতে হয় (9748700820)।

৩। রাজবাড়ির বেশ কিছু নিয়কানুন আছে যা মেনে চলাই ভাল। সেগুলো ওঁরা ওখান থেকে বলে দেন। আনন্দের আতিশয্যে ভেসে গিয়ে যা ইচ্ছা তাই করা থেকে বিরত রাখাই শ্রেয়।

হাজার টাকার কিনা কে জানে। ঝাড়বাতিগুলো খুব সুন্দর।

৪। ওখানকার স্টাফ, ঘর, খাওয়াদাওয়া সমস্ত কিছু ভীষণ ভাল।

৫। যদি গ্রুপ সফর হয় এবং ছ’জন সদস্য থাকে তাহলে অতি অবশ্যই বিলাস মঞ্জরী তে থাকা উচিত। অসাধারণ ব্যবস্থা।

ছবি— লেখিকা

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *