অন্য সফর জঙ্গল যাপন বিশেষ ভ্রমণ

কেঁদতল-কুসুমতল-ঝিলিমিলি

দীপক দাস

অটো থেকে নেমে ঝিলিমিলি যাওয়ার বাস পেয়ে গেলাম। শুনতে চামচ থেকে সসপ্যানে মাখনের টুকরো পড়ে হড়কানোর মতো মসৃণ মনে হল তো? কিন্তু এবারের সফর মোটেও সহজ ছিল না। পদে পদে বাধা। বৈষ্ণব পদাবলীতে রাধার অভিসারের যাওয়ার পথের থেকেও সঙ্কটময়। একেবারেই চলইতে শঙ্কিল পঙ্কিল বাট’।

এবারের পুজোর সফরে দল ভারী হবে মনে করা হচ্ছিল। কচি, মানে আমাদের শহর শাখার শুভ মাসখানেক আগেই জানিয়ে দিয়েছিল, ও যাবে। জুয়েল, অরিজিতের কথা বলতে পারি না। জুয়েল এখন জুকেরবার্গের জোগাড়ে। ফেসবুককে সারাদিন সচল রাখে। বাণী, বই, খিল্লি, আত্মরতি দিয়ে। ফলে ওর সময় হবে না। অরিজিৎ সারা বছর নিখোঁজ থাকে। মাঝে মাঝে কোনও বৈপ্লবিক কাজ কারবার নিয়ে ফেসবুকে ভেসে ওঠে। এই যেমন, অমুক কাগজ বাঙালির লজ্জা। তমুক চ্যানেল চামচা। এই সব সমাজ সংস্কারমূলক কাজ সেরে জুয়েল, অরিজিৎ যেতে পারবে না ধরেই নিয়েছিলাম। গৌতম দিল্লিতে। আসতে পারবে না। তবুও ছয় থেকে সাতজনের দল হওয়ার কথা ছিল।

কিন্তু কচির বাবা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়লেন পুজোর কিছুদিন আগে। গার্ডবাবু ছুটি নিয়ে প্রতি বছরের মতো দেয়ালা শুরু করল। আমার ছোট ভাই প্রতিবারের মতোই শেষ মুহূর্তে পিছিয়ে গেল। রয়ে গেলাম আমরা চারজন। প্রতিবারের পুজোর সফরের চার ইয়ার, ইন্দ্র, বাবলা, দীপু, আমি। কিন্তু আটকে গেলাম পরের ধাপে। কোথায় যাওয়া হবে? প্রস্তাব জমা পড়েছে একগাদা। তুলিন, বেতলা। কেচকি, ঝিলিমিলি, দুয়ারসিনি। গার্ডবাবু যাবে না। কিন্তু পরামর্শ দিতেও ছাড়বে না। কিছুতেই সিদ্ধান্তে আসা যায় না। যাত্রা শুরুর আগের দিন পর্যন্ত কোনও সিদ্ধান্ত হল না। শুধু ঠিক হয়েছিল, সপ্তমীর সকালে সাঁতরাগাছি থেকে রূপসী বাংলা ধরা হবে। টিকিট পুরুলিয়া পর্যন্ত কাটা হবে। ট্রেনে ঠিক করা হবে, বাঁকুড়া না পুরুলিয়া।

কাশের মেলা।

তবে ট্রেনে ঠিক করতে হয়নি। বড়গাছিয়া স্টেশনে গিয়ে দেখি, সেদিনের ট্রেন বাতিল। পুজোর সময়ে ট্রেন বাতিল থাকে। তবুও প্রতি বছর দীপু বা ইন্দ্র জোর করে স্টেশনে আনে। তার পর আবার ফিরিয়ে নিয়ে বাসস্ট্যান্ডে হাজির করায়। এবারও তাই হল। বড়গাছিয়া থেকে বাস ধরলাম। বাসেই ঠিক হল যাওয়া হবে ঝিলিমিলি। ঘুরেফিরে যেমন সময় বাঁচবে তেমন সিদ্ধান্ত হবে। দাশনগর থেকে টিকিট কাটলাম। এখান থেকে লোকাল ট্রেনে সাঁতরাগাছি যাব। কিন্তু সেই ট্রেনে এত ভিড় যে উঠতেই পারছিলাম না। চারজনে চারদিকের ছিটকে গেলাম। ইন্দ্রর বুদ্ধি। এত গেঁতো ছেলে। সাঁতরাগাছিতে নেমে হাঁটতে হবে বলে শেষ কামরায় ওঠার বায়না জুড়েছিল। সেই কামরায় ঠাসা ভিড়। আগের কামরা লেডিজ। ফলে ছিটকে পড়া।

সাঁতরাগাছিতে রূপসী বাংলা তখন প্ল্যাটফর্মে। আমরা লেজা থেকে মুড়ো পর্যন্ত হেঁটে কোথাও খালি পেলাম না। ট্রেন ছেড়ে দিতে হল। আধঘণ্টার মধ্যেই রাজ্যরানি আছে। আমাদের সামনে দিয়ে রূপসী বাংলা  বিয়ের পর প্রেমিকার শ্বশুরবাড়ি চলে যাওয়ার মতো ব্যথা জাগিয়ে চলে গেল। এই রূপসী বাংলায় কত অভিযান করেছি। বেগুনকোদর, বাঁকুড়া…আজ!

ছেন্দাপাথরে শহিদ ক্ষুদিরামের স্মৃতি।

স্টেশনে বসে আছি। হঠাৎ একজন আমাদের ব্যর্থতার ক্রেডিট নিতে শুরু করল। আমাদের দলেরই সদস্য। বলল, ‘‘বলেছিলাম, আজ ট্রেনে জায়গা পাবে না! সত্যি হল তো?’’ এই সদস্যের কালো বিড়াল সাজার খুব শখ। ছোট থেকে। এডগার অ্যালান পো-র কালো বিড়াল নয়। রাস্তা কাটা কালো বিড়াল। দলে একটা সাদা বিড়ালও আছে। একজন নেগেটিভ আরেকজন পজিটিভ। একজন যা বলে তা-ই ঘটে যায়। আরেকজন যদি কোনও কিছুর প্রশংসা করে তো হয়ে গেল। ভয় পাচ্ছিলাম, রাজ্যরানি নিয়ে না কিছু বলে বসে।

রাজ্যরানিতে জায়গা পেয়েছিলাম। তার পর একসময় নামলাম বাঁকুড়া। সেখান থেকে ঝিলিমিলির বাস। কাছাকাছি বসার জায়গা মিলল না। বাবলা পেল চালকের কেবিনে। ইন্দ্র একটু পিছন দিকে। আমি আর দীপু ব্যাগপত্র কোলে নিয়ে একদম পিছনের সেই লম্বা বেঞ্চের মতো টানা সিটে। ঘণ্টা আড়াইয়ের যাত্রা। কোনও ব্যাপার নয়। তখন কী আর জানতাম, আমাদের এই যাত্রা ‘বোম্বে টু গোয়া’ সিনেমার যাত্রা!

বাসস্টপের চা খানা।

বাঁকুড়া শহর ছাড়ার পরের এলাকা আমাদের আগেই দেখা। আহামরি কিছু নয়। শুধু শহর থেকে আরেকটু দূরে নদীর পার বরাবর কাশের সমুদ্র আগে চোখে পড়েনি। বাসে তেমন ভিড় নেই। ফলে একটু চোখ বুজে ক্লান্তি দূরের চেষ্টা করছিলাম। ঘুম এসে গেল। যখন চোখ খুলল তখন দেখি বাস বোঝাই। কিচিরমিচির। হইহই। আগে সামনে জানলার ফাঁকফোকর দিয়ে চলমান, হঠাৎ হঠাৎ ছিটকে আসা প্রকৃতির কিছু দেখা যাচ্ছিল। এখন সেটাও বন্ধ হল। আমাদের পাশের জানলা দিয়ে দেখলে হলে অনেকটা ঘাড় ঘোরাতে হবে। কারণ আমরা বসেছি মাঝ বরাবর। ঠাসাঠাসি হয়ে চুপচাপ বসে রইলাম। বিরক্ত হয়ে যাচ্ছিলাম। সেই সময়েই উঠল রাখি। আমাদের বাসযাত্রায় এনে দিল এক ঝলক আনন্দের বাতাস। মা-দিদির সঙ্গে উঠেছিল। কোন স্টপ থেকে সেটা আর মনে নেই। ভিড়ে রাখিকে নিয়ে দাঁড়ানোর জায়গা পাচ্ছিলেন না মা। অনুরোধ করলাম, রাখিকে আমাদের কাছে দিতে। মা অনুরোধ শুনলেন। দীপুর কোলে এসে বসল সে। ছোট্ট একটা পরি। বছর তিন চারেকের হবে। মুখ তার ঝরনা। অবিরল কলকল করে গেল। আমাদের বাসযাত্রার ক্লান্তি এক নিমেষে ধুয়ে গেল সেই প্রবাহে।

মামা ঘর যাচ্ছে সে। হঠাৎ জানলা দিয়ে দেখা গেল রেললাইন। রাখির সে কী উচ্ছ্বাস। বিভূতিভূষণের বালক অপু যেন বালিকা বেশে দীপুর কোলে। আমাদের জানাল, ও রেলগাড়ি চেপেছে। মামা বাড়ির কাছে পূজা হয়। ও পূজা দেখতে যাচ্ছে। কত কিছু যে সারাক্ষণ বলে গেল! রাখির দিদি আবার ওর উল্টো। নাইনে পড়ে। কিন্তু একদম চুপচাপ। ভিড়ে দাঁড়াতে পারছিল না। আমরাও ওকে বসতে জায়গা দিতে পারছিলাম না। আমাদের ব্যাগ রাখার জায়গা নেই। রাখির দিদি সেগুলো কোলে নিয়ে বসতে পারবে না। আবার আমরাও ব্যাগ নিয়ে দাঁড়াতে পারব না। ওকে বললাম, ব্যাগের উপরে ঠেস দিয়ে দাঁড়াতে।

একলা জগাই।

একসময়ে রাখিরা নেমে গেল। আমরা আবার একা। কিছুক্ষণ পরে বাস ফাঁকা হল। বাস আস্তে আস্তে ঢুকল খাতড়া বাসস্ট্যান্ডে। আর তখনই সামনে এল সত্যটা। খিদে পেয়েছে। আমরা বাসের কন্ডাক্টর রোহিণীদাকে জিজ্ঞাসা করলাম, খাতড়ায় খাবার মিলবে কিনা। উনি পরামর্শ দিলেন, রানিবাঁধ খেতে। ওখান ভাল হোটেল দেখিয়ে দেবেন। আমরা না খেয়ে আসা পর্যন্ত বাস ছাড়বেন না। রাস্তা এখনও অনেক বাকি। পৌঁছতে পৌঁছতে বিকেল হয়ে যাবে। শুনে পরস্পরের মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। রোহিণীদা কথা রেখেছিলেন। হোটেল থেকে না খেয়ে আসা পর্যন্ত বাস ছাড়েননি। যেখানে খেলাম সেটা কে ঠিক হোটেল বলা যায় না। টু ইন ওয়ান। আসলে মিষ্টির দোকান। কিন্তু বেশ বড়। তারই এক দিকে হোটেলের মতো ব্যবস্থা। ভাত পাওয়া যায়। নোনতাও। আমরা মাছ-ভাত, ডাল এবং অতি অবশ্যই পোস্তর তরকারি খেলাম। চাটনি, আলু ভাজাও ছিল। সঙ্গে অবশ্যই ছোট ছোট কিন্তু প্রচণ্ড ঝাল আর স্বাদু লঙ্কাও ছিল।

নদী কে কিনারে।

খেয়েদেয়ে আবার যাত্রা শুরু। কিছুক্ষণ পরে বাস একেবারে ফাঁকা। রোহিণীদার সঙ্গে কথা হয়ে গিয়েছে, উনি ঝিলিমিলিতে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করে দেবেন। চেনা লজ আছে। আমরা নিশ্চিত হয়ে গল্প জুড়লাম। এলাকার গল্প। ততক্ষণে আসল বাঁকুড়া শুরু হয়ে গিয়েছে। দু’পাশে দিগন্ত ভরা সবুজ। ঢেউ খেলানো ভূমি। কোথাও টিলার মতো উঁচু। কোথাও মাঝে এক টুকরো জলাশয়। দূরে জঙ্গলের আভাস। মাঝে মাঝে ছিটকে ছিটকে আসছে একেকটি পাড়া। ছিমছাম। টিনের চালের বাড়ি। মাটির দেওয়াল। পাকা দেওয়ালও রয়েছে। তবে রাস্তা খুব খারাপ। আমাদের হাড় মাস এক হয়ে যাচ্ছিল। রোহিণীদা জানালেন, এখানেই রাস্তার পাশে পড়বে একটা জায়গা। ছেন্দাপাথর নামে সেই জায়গায় ক্ষুদিরাম লুকিয়ে ছিলেন কিছুদিন। ছেন্দাপাথরের নাম জানতাম। রাস্তার পাশে একটা ক্লাবও চোখে পড়ল। ক্ষুদিরামের ছবি দেওয়া ক্লাবের নামের মাঝে।

হঠাৎ দেখা গ্রাম।

বাস ততক্ষণে জঙ্গলের পথ ধরেছে। একেবারে পাহাড়ি পথ। চড়াইয়ে উঠতে শুরু করল। এখানকার বাসস্টপগুলোর নাম ভারী অদ্ভুত। কেঁদতল, শালতল, কুসুমতল, নিমতল। সবই গাছের নামে। কলকাতা, হাওড়া, হুগলিতে গাছের নামে বাসস্ট্যান্ড আছে। বেলগাছিয়া, নিমতলা। আমাদের বড়গাছিয়া। কিন্তু এখানকার নামগুলো সহজ সরল। কেন্দুগাছের তলাতেই বাস দাঁড়াবে। কিংবা কুসুম গাছের কাছে। কুসুম নামটাই কী রোমান্টিক!

ছবি-দীপু, বাবলা।

সব ছবিই চলন্ত বাস থেকে তোলা।

(চলবে)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *