খাদ্য সফর বিশেষ ভ্রমণ

সরভাজা-সরপুরিয়া ভায়া পান্তুয়াঘাট

দীপক দাস

তরকারিতে এক টুকরো পটল পেলাম। কচুরির টুকরো দিয়ে কিছুটা তরকারি তুলে নিতে বেরিয়ে এল বরবটি খণ্ড। বেরিয়েছি খাদ্য সফরে। নানা ধরনের মিষ্টির খোঁজে। সকাল ১০টা নাগাদ দাঁড়িয়ে আছি একটা মিষ্টির দোকানেই। কিন্তু আমরা মিষ্টি খাচ্ছি না। খাচ্ছি কচুরি আর তরকারি। অধিনায়কের মানা। ওঁর সফর-কৌশল বলছে, আমরা ফেরার সময়ে নেমে মিষ্টি খাব।

এবারের খাদ্য সফরে নদিয়া লাইন। তালিকায় রয়েছে সরভাজা-সরপুরিয়া এবং পান্তুয়া। এই এলাকায় আমাদের ঘাসপুস দীপুর রাজত্ব। চেনাও। এলাকায় এলাকায় ওর বন্ধু রয়েছে। ফলে ও সফরের অধিনায়ক। বেলঘড়িয়া থেকে ট্রেন ধরে একটু বেলার দিকে এসে পৌঁছেছি রানাঘাট। পান্তুয়ার খ্যাতির সন্ধানে। খুঁজে পেতে চারজনে (আমি, ভজা, চিনি আর অধিনায়ক) বেরও করে ফেলেছি স্টেশনের কাছেই জগু ময়রার দোকান। কিন্তু দীপুর মত, এখন মিষ্টি কিনলে সারাদিন ব্যাগে করে নিয়ে ঘুরতে হবে। তাতে মিষ্টির স্বাদ নষ্ট হয়ে যাবে। আমরা কৃষ্ণনগর থেকে ফেরার সময়ে আবার নামব রানাঘাটে। তখন মিষ্টি কিনব। এখন সকালের জলখাবারে কচুরি খাওয়া যাক। বস অলমাইটি। সুতরাং…। জগু ময়রা কচুরিটা বেশ ভালই করে। সঙ্গেরও তরকারিতেও অভিনবত্ব রয়েছে। আমি তো কোনও জায়গায় কচুরির তরকারিতে আনাজ দেখিনি। এখানে খেলাম। পটল, বরবরি। খেতে ভালই লাগছে। চাহিদাও বেশ। হু হু করে উড়ে যাচ্ছে কচুরি।

সরভাজা।

উদরপূর্তির পরে ট্রেন। সোজা বেথুয়াডহরি। সেখানে মদনমোহন তর্কালঙ্কারের ভিটে দেখে ফিরে এলাম কৃষ্ণনগর। তারপর মাটির পুতুলের গ্রাম ঘূর্ণি, বারোদোল মেলায় ঝটিকা সফর। অর্ধেক কৃষ্ণনগর চক্কর কাটার পরে ফুরসত মিলল মিষ্টিমুখের। এখানকার মিষ্টি মানেই তো সরভাজা আর সরপুরিয়া। কিন্তু কোন দোকানের? এতদিনের খাদ্য সফরের অভিজ্ঞতা শিখিয়েছে, সঠিক জিনিসের সন্ধানে সমীক্ষা প্রয়োজন। কারণ কোনও এলাকায় কোনও কিছু প্রসিদ্ধি পেলে তা ছড়িয়ে পড়ে। অনেকেই তৈরি করেন সেই জিনিস। তাতে অবশ্য গুণের তফাৎ থাকে। ফলে বিস্তর জিজ্ঞাসাবাদ। ওই এলাকার লোকজন, টোটোওয়ালা। তাতেই বেরলো অধরচন্দ্র দাসের নাম। সেই সঙ্গে সাবধান বাণী, শাড়ির দোকান এবং জ্যোতিষীর মতো এই দোকানেরও আদি এবং নব্য ভাগ রয়েছে। পরামর্শদাতারা পইপই করে বলে দিয়েছিলেন, আমরা যেন আদিতেই যাই।

সুতরাং বারোদোল মেলা থেকে বেরিয়ে টোটো পাকড়াও এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই হাজির নেদিয়ার পাড়ায়। দোকানের ঠিকানা ১৭/২ অনন্ত হরি মিত্র রোড। রাস্তার পাশেই দোকানটা। একতলা এবং পুরনো ছাঁদের। রংচটা দেওয়াল। দোকানের নামধাম লেখা জায়গায় অনেক অক্ষরই আবছা। প্রবাদেই আছে, পুরনো চাল ভাতে বাড়ে। মানে সেই ওল্ড ইজ গোল্ড কেস। আদি অধরচন্দ্র তারই প্রমাণ। জনাইয়ের মনোহরা পুরনো, নামফলকহীন কমল ময়রার দোকানেই ভাল। কৃষ্ণনগর শহরটাই এত প্রাচীন যে এখানে ঝকমকে ব্যাপারটাই কেমন যেন বেখাপ্পা লাগে। উড়ে এসে জুড়ে বসেছে মনে হয়। দোকানের কাছেই একটা ডিপার্টমেন্টাল স্টোর হয়েছে। কিন্তু কেমন যেন! মনে হয়, স্টোরটা ভবিষ্যত থেকে টাইম মেশিনে চেপে অতীতে চলে এসেছে।

সরপুরিয়া।

আমরা দোকানদারদের সঙ্গে ভাব জমিয়ে মিষ্টির ইতিহাস, ভূগোল জানার চেষ্টা করি। অধরচন্দ্রেও ভাব জমিয়েছিলাম এক কর্মীর সঙ্গে। তিনি অধর খুলেছিলেন। সরভাজার রেসিপি বলতেও শুরু করেছিলেন। দুধের সর লাগে, ঘি লাগে…। তারপর হঠাৎ কী মনে হল, থেমে গেলেন। বললেন, ‘কারখানা অন্য জায়গায়। আমরা দোকানের কর্মী।’ হঠাৎ কাজের এলাকা ভাগের কথা মনে পড়ে গিয়েছে তাঁর। সরকারি অফিসের কর্মীদের মতো। সেই কোনও কাজে গেলেই বলে না, এটা আমার ডিপার্টমেন্ট নয়। ওই কাউন্টারে যান। ফলে ইতিহাস খুঁজতে নেট ভরসা। তাতে যা মিলল, তার সারমর্ম হল, সরভাজা-সরপুরিয়ার বয়স নিয়ে টানাপড়েন আছে। জনকের নাম নিয়েও। কেউ বলেন, অধরচন্দ্র দাসই জনক। কারও মতে, তাঁর বাবা সূর্যকান্ত। এই মিষ্টি খুব বেশি পুরনো নয় বলেই অনেকের ধারণা। তবে শতায়ু। আরও একটা কথা, রেসিপি সকলে জেনে যাওয়ার ভয়ে অধরচন্দ্রেরা রাতে দরজা, জানালা বন্ধ করে সরভাজা-সরপুরিয়া বানাতেন। অর্থাৎ প্রথম থেকেই একটা লুকোছাপা রয়েছে। যেটা করলেন দোকানের কর্মী। ব্যবসায় ‘ট্রেড সিক্রেট’ তো থাকেই। কোকাকোলার ফর্মুলা নাকি অতি গোপন, এখনও!

সরভাজা-সরপুরিয়া কেনা হল। যে যার মতো কিনলাম। বেশ দাম। সরভাজা ৫৪০ টাকা কিলো। সরপুরিয়া ৪৬০ টাকা। থালার উপরে সাজানো সরভাজা একঝলক দেখলে মোটাসোটা গোলা রুটির মতো লাগে। সেটাকেই কেটে টুকরো টুকরো করে দেন দোকানের কর্মীরা। অধর দাসের সরভাজা ওপরে হালকা বাদামি দাগ। ভাজার চিহ্ন। দুধের সর, ঘি, চিনির মিশ্রনে তৈরি মিষ্টির এক টুকরো জিভের নাগালে এলেই মনটা ভরে ওঠে। আমাদের এলাকাতেও সরভাজা মেলে। ছোট ছোট টুকরো। গাঢ় খয়েরি রং। পাঁচ টাকা পিস। অধর দাসের সরভাজার এক টুকরো গড়ে ২৭ টাকার মতো পড়ে।

সরপুরিয়া চৌকনো টুকরো। ঠাস বুনোট। এমন ঠাস বুনোটের জন্য হাতে নিলে শক্ত লাগে। কিন্তু কামড় বসালেই বোঝা যায় সন্দেশের মতো নরম। এরও মূল উপাদান সর। সঙ্গে খোয়া ক্ষীর, নানা বাদাম। খাওয়ার আগে একবার নাকের কাছে ধরা উচিত। জিভ-গলা-মন ভাল কিছু পাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে যাবে। এক কিলো কিনলে সরভাজা আর সরপুরিয়া খান কুড়ি মতো হয়। মোটামুটি ভাবে। কিন্তু মিষ্টিদ্বয়ের স্বাদ আর ঐতিহ্য দামে পুষিয়ে দেয়।

কৃষ্ণনগরের অধরচন্দ্রের দোকান।

ট্রেন ধরলাম কৃষ্ণনগর থেকে। লালগোলা প্যাসেঞ্জার। ভিড়ে ভিড়াক্কার ট্রেন। নিজেদের সামলানোর থেকে বেশি চিন্তা মিষ্টি রক্ষা। ব্যাগে রয়েছে অমূল্য স্বাদ। তবে ক্ষতি কিছু হয়নি। ঠিকঠাক ভাবেই নেমেছিলাম পান্তুয়াঘাটে। মানে রানাঘাটে। কিন্তু দীপু আর চিনি দোকানে গেল না। ওরা স্টেশনে রয়ে গেল। ট্রেনে জায়গা রাখবে। আজই তো ফিরতে হবে! গেলাম আমি আর শুভ, দ্য গার্ডবাবু। স্টেশনের কাছেই বাজার এলাকায় জগু ময়রার দোকান। বেশ ঝকঝকে। সকালে এই দোকানেই কচুরি খেয়েছিলাম।

পান্তুয়া মানে রানাঘাট। এটাই প্রচলিত। কিন্তু আমাদের মত, তিন জায়গার পান্তুয়া বিখ্যাত। মানে খেতে ভাল। দু’টো আগেই চাখা হয়ে গিয়েছিল। একটা আমতার পান্তুয়া। আরেকটা কালনার নোড়া পান্তুয়া। এবার রানাঘাটের। জগুবাবুর নাতি খোকনবাবু এখন দোকান চালান। তাঁদের দোকানে মেলে দু’ধরনের দামের পান্তুয়া। সাত টাকা এবং ১০ টাকা। এখানকার পান্তুয়া কিন্তু গোল নয়। লম্বাটে। ঠিক কালনার নোড়া পান্তুয়ার মতো। (মন্দির নগরীতে অষ্টাদশ টোটোআরোহী দ্রষ্টব্য)। পান্তুয়ার রং একটু কালচে লাল। ছালটা মোটা। তার মানে ভাল ভাবে জ্বাল দিয়ে ভাজা হয়েছে। ওপরটা শক্ত মতো। অনেকটা আমতার পান্তুয়ার মতোই। পান্তুয়ার ভিতরটা জালের মতো ফুটো ফুটো। ভিতরে রস ঢুকেছে ঠিক মতো। কামড় দিলে ভিতরের রসের আস্বাদ মেলে। ভাল পান্তুয়ার গুণই হল, ওপরের ছাল হবে শক্ত। ভিতরটা নরম, জাল জাল। লালচে, থ্যাসথ্যাসে পান্তুয়া মানেই কম আঁচে ফাঁকিবাজিতে তৈরি।

জগু ময়রার তিন পুরুষের ব্যবসা। কিন্তু পান্তুয়া লম্বাটে কেন? খোকনবাবু তা জানেন না। শুধু বললেন, ‘লম্বা, গোলে কী আসে যায়। স্বাদটাই তো আসল।’ একেবারে হক কথা। কী ভাবে তৈরি হয়েছিল এখানে পান্তুয়া সেটাও জানাতে পারলেন না।

রানাঘাটের পান্তুয়ার দোকান।

ট্রেন ধরার তাড়া ছিল বলে বেশি ইতিহাস চর্চার সুযোগ হয়নি। তাছাড়া দীপুর সূত্র জানিয়েছে, রানাঘাটে আরও একটা দোকানের পান্তুয়া ভাল। সেই পান্তুয়াও তো চাখা দরকার! চৌরঙ্গি মোড়ের কাছে সেই দোকানের নাম ‘মেজদার জলযোগ’। হেঁটে হেঁটে গিয়ে মেজদার দোকান থেকেও পান্তুয়া নেওয়া হল। ট্রেনে বসে খাওয়ার জন্য। নামে নতুন মনে হলেও এই দোকানের পান্তুয়াও বেশ ভাল। স্বাদে তফাৎ করতে পারা যায় না। কোথা থেকে যেন জেনেছিলাম, মেজদার জলযোগ এবং জগু ময়রা, দু’টো দোকানের উৎসই এক। সকলেই নাকি জগু ময়রার বংশধর।

তাই হয়তো স্বাদে তফাৎ করা যায় না। বংশের ধারা বলে কথা!

(কী ভাবে যাবেন— শিয়ালদহ থেকে ট্রেনে রানাঘাট। পান্তুয়া খেয়ে আবার ট্রেনে কৃষ্ণনগর)

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *