বিশেষ ভ্রমণ ভিনদেশি ভ্রমণ

ইচ্ছে সফরে সাগরদাঁড়ি, কপোতাক্ষ

অর্ণবাংশু নিয়োগী

সম্পত্তি আছে! নাকি পিছুটান! প্রশ্নটা আগেই বলে রাখলাম। গন্তব্যের নাম শুনে এই দু’টি প্রশ্নের মুখামুখি হতে হয়েছে। যতই হোক বাসস্থান আর গন্তব্যের মাঝে রয়েছে কাঁটাতার। অর্থাৎ দু’টি দেশ। যেটা ভাগাভাগি হয়েছে অনেক আগেই। আর কী বলার প্রয়োজন আছে! বলেই দিচ্ছি, বাংলাদেশ।

এবার আমার স্মৃতি ধরে চলুন একটু ঘুরে আসা যাক। তার একটু বলা দরকার। আমার প্রথম সফর। একটা আলাদা দেশ। কেমন হবে জায়গাটা! কেমন হবে সেখানকার মানুষ! এই কৌতুহলের জন্ম নিয়েছিল সেদিন, যেদিন ঠিক হয় ছুটি নিয়ে বাংলাদেশ যাব।

এবার চলুন।

গাড়ি ভাড়া করে সকাল সকাল পৌঁছলাম ঘোজাডাঙা বর্ডারে (ভায়া মসলন্দপুর)। সীমান্তের কাছাকাছি প্রবেশ করেছি মনে হয়। কারণ, বিএসএফের চেকপোস্ট চোখে পড়েছিল। চালককে জিজ্ঞেস করলাম, ‘‘আর কতদূর!’’ জবাব এল, ‘এই মিনিট ১৫ লাগবে।’ তিনি আরেকটি কথা বলেছিল, ‘সবাই (পরিবার) পাসপোর্টটা হাতে রাখবেন।’ কথা মতো ব্যাগ থেকে বের করে হাতে পাসপোর্ট রাখলাম। সীমান্তে প্রবেশ করার মুখে শেষ চেকপোস্ট। ব্যাগ চেকিংয়ের কাজটা শেষ হল। আরেক বিএসএফ জওয়ানের কাছে এক এক করে পাসপোর্ট দেখালাম। পাসপোর্টের ছবির সঙ্গে আমার বর্তমান চেহারা মিলিয়ে নিলেন। তারপর বললেন, ‘‘‘এগিয়ে যান।’’

তফাৎ কিছু আছে কি? এপার আর ওপারের?

সীমান্তে ঢুকে পড়লাম। অনেক মানুষ। তবে কে কোনও দেশের সেটা বোঝা একটু সমস্যা। কথাবার্তা শুনলে আন্দাজ করা যাবে। দূরে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশ। সেখানে পৌঁছানোর আগে বেশকিছু কাজ থাকে। অভিবাসন। তার পর কাস্টমসের কাজ। সেসব মিটিয়ে বেরিয়েই দেখলাম, সামনে একটা লম্বা রাস্তা। কেউ দাঁড়িয়ে নেই। সবাই চুপচাপ হেঁটে চলে যাচ্ছেন। সেই ৩০০/৪০০ মিটার রাস্তাই হল ‘জিরো’ পয়েন্ট। যেখানে থেকে সামনের দিকে তাকালে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার দেখা যাচ্ছে। ৩০০/৪০০ মিটার রাস্তা পার করে দাঁড়ালাম বাংলাদেশে। একবার দেখে নেওয়া যাক! একদম নয়। কাজ বাকি আছে। সেই ইমিগ্রেশন, কাস্টমস। সেটা শেষ করতে করতে মিটিট ৩০ সময় লেগে গেল। যাক এবার দাঁড়াতে পারি। গেলাম একটি চায়ের দোকানে। কাচের কাপে ‘টি-ব্যাগ’ চুবিয়ে দিয়ে কাপটা (একটু অন্যরকম) হাতে তুলে দিলেন দোকানদার। চায়ে চুমুক দিতে দিতে এদিক ওদিক তাকানো। একই শরীর থেকে কেটে তৈরি আরেকটি শরীর কেমন? দেখার জন্য উৎসুক আমি। মনে হল, শুরুতেই কাপটা অন্যরকম লাগল। তাহলে দেশের ভিতর অনেক কিছুই অন্যরকম কিছু দেখার মিলবে।

প্রথম গাড়িটি ভারতেই ছেড়ে দিয়েছি। বাংলাদেশে ঢোকার পর অটো বুক করেছি। চারপাশটা দেখতে দেখতে যাওয়া আর মাটির ঘ্রাণ নেওয়ার ইচ্ছা। গন্তব্য খলিশখালি। জেলা সাতক্ষীরা। ঘণ্টা দেড়েক সময় লাগার কথা। যাত্রাপথের মাঝে পরিবারের একজন সদস্য জিজ্ঞেস করল, কেমন লাগছে? কিছু না ভেবেই বলে দিলাম, ‘‘কিছুই বিশেষ মনে হচ্ছে না।’’ সত্যি বলতে, মানুষ, রাস্তাঘাট, বসবাস দেখে কিছুই আলাদা মনে হয়নি। নিজের দেশের কোনও একটা গ্রাম্য এলাকায় ঘুরছি বলে মনে হল।

মধুসূদনের প্রসূতিস্থল।

সাতদিনের সফর। মাঝের একটা দিন ঘুরতে গেলাম সাগরদাঁড়ি, জেলা খুলনা। এটা আগে থেকেই দেখার ইচ্ছা ছিল। মাইকেল মধুসূদন দত্তের জন্মভিটে। ভুটভুটি চলে। মানে মোটর চালিত ভ্যান। তারই একটায় চেপে পৌঁছনো গেল। খলিশখালি থেকে মোটর ভ্যানে সময় লেগেছিল ঘণ্টাখানেক। বিকাল সাড়ে ৫টায় দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়। তার আগেই পৌঁছে গিয়েছি। ঘণ্টা দু’য়েক আছে হাতে। আকর্ষণীয় স্থল কবির প্রসূতি স্থল। সেখানে রয়েছে একটি তুলসী মণ্ডপ। সংরক্ষিত। তাছাড়া কবির পারিবারের সদস্যদের ব্যবহৃত কিছু জিনিসপত্রও সংরক্ষিত। রয়েছে মধুসূদনের লেখা চিঠি। ১৮৪২ সালে বন্ধু গৌরদাস বসাককে লেখা চিঠি। কবিতা ফ্রেম বন্দি করে রাখা আছে। ভিটের পাশ দিয়ে বয়ে গিয়েছে কপোতাক্ষ নদী। যেখানে কবি একাকী বসে লিখতে ভালবাসতেন। ‘বহু দেশে দেখিয়াছি বহু নদ-দলে, কিন্তু এ স্নেহের তৃষ্ণা মিটে কার জলে?’ যখন নদীর পাড়ে পৌঁছালাম তখন ঘড়িতে প্রায় সন্ধ্যে ৬টা। সূর্য ডুবছে। আঁধার আকড়ে ধরছে নদীকে। এই শেষবার, এই শেষবার ভেবে নদীতে জাল ফেলছেন জেলে। নদীর কোলে কলসিতে রাখা কিছু মাছ তখনও লাফাচ্ছে নদীর কোলে ছুটে যেতে চেয়ে। নদীর পাড় ধরে বইছে হাওয়া। সেই তালে মাথা দোলাচ্ছে অসময়ের কাশ ফুল।

কী রে ফিরতে হবে! প্রশ্নটা কানে এল। কে ফিরতে চায়! আটকা পড়ে গিয়েছিলাম কয়েক মুহূর্তের জন্য। দেখতে দেখতে সূর্যের আলো হারিয়ে গেল। আস্তানায় ফেরার পালা।

কবির বাড়ির পুজোর দালান।

পরের গন্তব্য খুলনা। তবে সেখানে রয়েছে ভৈরব আর রূপসা নদী। তাদের তো ছাড়া যায় না। জিয়ল মাছের মতো প্রাণচঞ্চল ভৈরব। জেটি করে তার বুকের ওপর দিয়ে পৌঁছলাম বঙ্গবন্ধু কলেজে। একদম নদীর গায়ে। ঘুরে দেখলাম কলেজ, খুলনা শহর। শহরটা যদি বলি উত্তর ২৪ পরগনার বারাসত এলাকার মতোই, ভুল হবে না কিছুই।

একটা তো বলা হয়নি। তালের রসের কথা। সে এক হাস্যকর। সকালে গাছে বাঁধা হাঁড়ি বিকেলে নামানোর পর সন্ধ্যের ঠিক আগের মুহূর্তে বাজারে নিয়ে এসে হাজির হয় সুলতান চাচা। বাজারে আসতে যেটুকু সময়। বাজারে পড়তে না পড়তেই রস শেষ। রসিক যে প্রচুর। তাই আগে ভাগে পাহারা দিলাম দু’দিন। রস খেতে হবে। দূর থেকে চাচাকে দেখার পর এগিয়ে যেতাম। বাজারে আসার আগেই আটকে দিতাম। দাঁড় করিয়ে গোটা চার-পাঁচ গ্লাস রস খাওয়ার পর বলতাম, ‘‘চাচা এবার বাজারে যাও। আচ্ছা বলে দিচ্ছি, কাল আবার চাই।’’ হেসে চাচা বসলেন, ‘ঠিক আছে।’ পরের দিন একটু দেরি। তাতে সমস্যা হয়নি। এদিনও চাচা আমার জন্য চার গ্লাস রস প্রায় বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। অদ্ভুত ব্যপার। একদিনে চাচার কেমন কাছের হয়ে গেলাম। তবে এটা বলা দরকার, আমাকে আপনাকে তারা দেখলে বুঝতেই পারবে, আমরা অন্য দেশের। ভালবাসা এবং সম্মান কিন্তু নিজের মতো করেই দেবে।

কপোতাক্ষ নদে সাঁজবেলার মৎস্যশিকারি।

বেশি কিছু দেখার সুযোগ হয়নি। হ্যাঁ, সম্পত্তি বা পিছুটানের কারণে সেখানে যাওয়া হয়নি। ইচ্ছের যাত্রা ছিল। আমি যে বাঙাল!

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *