পাহাড়িয়া বাঁশি বিশেষ ভ্রমণ

জীবন্ত সেতু, ডুমুরে খোঁজ আর বৃষ্টি ভেজা মৌসিনরাম— শেষ পর্ব

শ্রেয়সী সেনশর্মা


২৬ এপ্রিল

ওই ২৩ এপ্রিলের রাতের বেলায় ফেরার সময় দিগন্ত ধরে তারা ভরা আকাশে পূর্বপুরুষরা যেন শান্তির হাসি হাসছিলেন, আমার রক্তে এই বোহেমিয়ানা যেন পুরোপুরি তারা গছিয়ে দিয়ে আরাম করছেন। ডাউকির পথে যাবার বেলায় এইসব চিন্তা মাথায় আসছে, কারণ আজ যেখানে যাব সেথায় আমার পূর্বপুরুষের নিঃশ্বাস মিশে আছে।

আপাতত আর্মি ক্যান্টিনে বসে। সামনে ধোসা আর ধূমায়িত কফি। ভাষাটা কেউ বোঝেন না। সামনে একজন দক্ষিণী বসে। অবাক চোখে খানিক তাকাল। আজ সারথি হিসেবে সুরজ ভাইয়া। সামনে দেখলাম লেখা ‘First In Dhaka’। ভাইয়াকে জিজ্ঞেস যথারীতি। কাহিনী হচ্ছে ১৯৭১ এর যুদ্ধে প্রথম বাংলাদেশের ঢাকায় এই ক্যান্টনমেন্ট থেকে সৈন্য নামে। পেছনে সার সার মূর্তি এবং মরণোত্তর পরমবীর চক্র প্রাপ্ত কার্গিল যুদ্ধের বীরদের হাসি মুখ। গায়ে বড় কাঁটা দেয়। এরপর গন্তব্য মওলিলং যাওয়ার পথে আরেকটা জীবন্ত শিকড়ের সেতু। রাস্তায় ওই পাহাড়গুলি নাকি একেকজনের সম্পত্তি। তারা সব বাংলাদেশের কাছে ওই চুনাপাথর বিক্রি করে দিয়েছে।

মেঘের বাড়ি ছাড়িয়ে।

ঢাকা এখান থেকে ৩০০ কিমি দূরে। সব পাথর ওইখানে যায়। ভাবছিলাম দেবতা আর কত সহ্য করবে। এক জায়গায় দেখলাম তিনটে লম্বা পাথর, পাথরের মাথায় মুরগির মূর্তি। ওই তিন পাথর হল মেঘালয়ের তিন উপজাতি, ‘সেন খাসি’, ‘সেন জয়ন্তিয়া’, ‘সেন গারো’র প্রতীক। এদের দেবতা হল মুরগি। খাসিদের রাজাকে বলে সেন রাজ। অবশ্য এখন বেশির ভাগই এরা ধর্মান্তর হওয়া খ্রিস্টান। সেই কারণে সুযোগ সুবিধাও পায়।

এরপর জীবন্ত সেতুর উদ্দেশে, পথে বেশ গায়ের উপর ওঠা মেঘগুলোকে হাত বাড়িয়ে খাওয়া যায়। বেশ ভিজে, ঠান্ডা ঠান্ডা। মেঘ মেঘ মেঘ সরিয়ে, জাফলংয়ে চায়ের কাপের ধোঁয়া আর মেঘের দেশের আস্তরণ কাটিয়ে গাড়ি থামল। সিঙ্গল লিভিং রুট ব্রিজে। প্রাকৃতিক সুইমিং পুল এবং অনেক লোকের ভিড়, সমস্ত ইতিহাস এখানে একটি পাথরের ফলকে লেখা আছে। সেতুতে একজনের বেশি ওঠা মানা এবং দেখে শেখার মতও কী অসাধারণ এদের প্রকৃতি মাকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা। এরপর মওলিলং এর ঠিক সীমানা বরাবর “ Maw Ryngkew Sharatia” or “ Nature’s balancing rocks.” একটি বড় বোল্ডার একটি ছোট বোল্ডারের উপর বসানো। চারিদিকে বাঁশ বাগান। প্রকৃতি ঝড়, বন্যা কিছুই একে টলাতে পারেনি।

নেচার ব্যালান্সিং রক।

এরপর মওলিলং। সমস্ত গাড়িগুলিকে গ্রামের সীমানাতে রাখা। অসম্ভব পরিচ্ছন্ন একটি গ্রাম। এই গ্রাম এশিয়ার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন গ্রাম নাকি। গাছপালায় ভর্তি, উঁচু গাছ বাড়ি, সেখান থেকে নাকি বাংলাদেশ সীমানা দেখা যায়। স্থানীয় একটি বটকে ঘিরে বেশ বেদি মতো, বোঝা গেল পুজো পান ইনি। এখান কার একটি হোটেলে দুপুরের খাওয়া, বেশ বাঙালি। রসনা তৃপ্তি হল। দাম ২০০ টাকা, মুরগির মাংস সহযোগে। রান্নায় বাংলার প্রভাব বেশ।

মওলিলংয়ের গাছ বাড়ি।

এরপর ডাউকি এর দিকে। প্রচণ্ড গরম, খারাপ রাস্তা, মোড়ে মোড়ে আর্মি চেকিং। বেশ ঘণ্টা দুয়েক লাগে যেতে। যেতে যেতে দেখতে পাচ্ছি সাদা পতাকা, ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’, কাঁটা তার, ওই দেশ। প্রকৃতির বিশেষ কিছু পার্থক্য নেই, তা-ও তারা কেমন আলাদা, দেশ কাল সীমানা ছাড়িয়ে। আমাদের ভাষা এক। কিন্তু দেশ আলাদা, সীমানা আলাদা, কাল আলাদা। যাক। অনেক পাথুরে ঝর্ণা পেরিয়ে, অবশেষে পৌঁছলাম। ডাউকি বর্ডার। দূরে ঝুলন্ত সেতু যা খাসি আর জয়ন্তিয়া পাহাড়কে জুড়েছে, সামনে লেক, সবাই বোটিংয়ে ব্যস্ত, দূরে কমলা গোলটা ডুব দিচ্ছে, আর আমি দেখছি, কেমন করে একটা পাথর আলাদা করেছে দুটো দেশকে, মধুমাঝির নৌকা বাঁধা গঞ্জ ঘাটে যেন। ওই দেশটায় অনেক ফেলে আসা আবেগ জড়িয়ে। ‘Fore Fathers Soil’।

ডাওকি বর্ডার আর ওরা বাংলাদেশ।

এরপর ঘর, থুরি গেস্ট হাউসের পানে।

২৭ এপ্রিল

আজ যাচ্ছি নখেলিয়াম অভায়ারণ্যের দিকে। এটি গুয়াহাটি যাওয়ার সময় নংপো যাওয়ার পথে পরে। পথে ঠিক করেছিলাম শিলংয়ে রবিঠাকুরের বাড়ি দেখব। বড় সুন্দর, শান্ত, সাদা, একটি মিউজিয়ামও আছে, রবিবার এটি বন্ধ থাকে। এই বাড়িতে বসেই ‘শেষের কবিতা’ রচনা করা হয়। পাইন বনের শিরশিরানি হাওয়াতে যেন এরা সব ফিসফিসিয়ে যায়। অমিত, লাবণ্য যেন এখনই হাঁটতে হাঁটতে এসে পড়বে। আপাতত এখানে বিধানসভার অধিবেশন বসে।

শেষের কবিতার বাড়ি।

সমস্ত পাহাড় জুড়ে দুদ্দাড়িয়ে মেঘ নামছে, সবুজদের অপেক্ষা শেষে, গোটা বাঁশবন জুড়ে মেঘ করে, ঝুপ্পুস করে বৃষ্টি এল। পাহাড়ের বৃষ্টি বড্ড রূপসী। বনের ওই শুকনো ঝর্ণা বেয়ে জল বইছে হুড়মুড় করে, খুব শব্দ করে। চারিদিকে ভিজতে ভিজতে চলল কাজ আর উপভোগ। একটা সময় ওই জলের পাশ দিয়ে দিয়ে অজস্র নৌকা রাখা, শূন্য নৌকা রেখে সব পালিয়েছে কোথায়। একটা জায়গায় দেখলাম লরি এসেছে আর টুকরি ভরে খাওয়ার আসছে। সাপ্তাহিক বাজার হয়তো। ছবি তুলতে চাইলে ছুটে পালাল।

নওখেলিয়ামের বেগবতী

ফেরার পথে এক ধাবায় পাঞ্জাবি বিরিয়ানি আর লস্যি। কাল যাব ভারতের সবচেয়ে বৃষ্টিবহুল জায়গা, মৌসিনরাম।

২৮ এপ্রিল

প্রচলিত নাকি, মৌসিনরামে নাকি সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয়। মৌসিনরাম হল আরেক দেশ যা মেঘ-কুয়াশা পেরিয়ে যেতে হয়। এ চত্বরে আলু চাষ হয় প্রচুর, এবং সবই নাকি গোবর সার দিয়ে। অর্থাৎ বাজার চলতি সার নৈব নৈব চ। আমরা tyrsad বলে একটা গ্রামে থামলাম। পেট ডাকছে। পেটের ডাকে সাড়া দিতে বসে পড়লাম ‘পোথারো’ এবং এক পেয়ালা চা নিয়ে। দোকানগুলি ছোট ছোট, কিন্তু কী সুন্দর সাজানো। পোথারো হল এখানকার লাল চালের তৈরি রুটি, যা এরা মাংসের সঙ্গে খায়।

পোথারো সহযোগে চা।

Mawjymbuin cave চুনাপাথরের তৈরি একটি গুহা, মৌসিনরামের অনতিদূরে অবস্থিত। দর্শক প্রায় নেই বললেই চলে। গুহার ভেতর অসম্ভব ঠান্ডা এবং জলের গর্জন। ক্যালসিয়াম এবং বেলে পাথরের তৈরি একটি শিবলিঙ্গ প্রকৃতির খেয়ালে তৈরি হয়েছে। স্টালাগমাইট জমে ওই লিঙ্গের উপর একটি গাইগরুর বাটের মতো সৃষ্টি করেছে। যা থেকে নাকি আগে দুধ ঝরে পড়তো। কোনও এক ইংরেজ তাতে গুলি করায় ওই দুধ পড়া নাকি বন্ধ হয়ে যায়। কথিত, ওই ইংরেজ সাহেব ঘটনার দিন কয়েক পরে নাকি মুখে রক্ত উঠে মারা যান। শিবলিঙ্গের সামনে একটি ছোট প্রণামী বাক্স রাখা। না, আপাতত এখানে ধর্ম নিয়ে ব্যবসা শুরু হয়নি। ওই জনমানুষহীন পথ দিয়ে যেতে যেতে এলাম ক্রেমপুরিতে।

সেই শিবলিঙ্গ।

Laitsohum গ্রামে অবস্থিত এই গুহা হল পৃথিবীর দীর্ঘতম ‘Sandstone Cave’। ২০১৬ সালে জনকয়েক বিদেশি এটি আবিষ্কার করেন। প্রায় ২৫ কিমি দীর্ঘ এই গুহায় পাওয়া গেছে ‘জলজ ডাইনোসর’ Mosasaurus-এর (অতিকায় সরীসৃপ) জীবাশ্ম। যা প্রায় ৬৬-৭৬ মিলিয়ন বছরের পুরনো। এই গুহাতে যেতে গেলে গাইডের অবশ্য প্রয়োজন। সিঁড়ি অনুপস্থিত, কোনও ক্রমে গাছের ডালপালায় ভর করে প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে এক ঘণ্টা হাঁটার পর এর দর্শন মিলবে। গাইড, ড্রাইভার ভাইয়া আর আমি তিনজন মিলে চললাম। গুহার সামনে এসে টর্চ ছাড়া ভিতরে ঢোকার উপায় নেই। ভিতর মুখ খুব সরু, ঠান্ডা, অন্ধকার। একটি ঝর্ণা পেরিয়ে এই গুহায় ঢুকতে হয়।

পৃথিবীর বৃহত্তম sandstone cave, এতেই সেই ডাইনোসরের জীবাশ্ম

শুনলাম, এরপর এই গুহা যেতে আসতে নাকি সাত দিন লাগে। বেলা ৪টে নাগাদ আমাদের ট্রেকিং শেষ হল। স্থানীয় কাফেতে গিয়ে এক বাটি ম্যাগি পেটে ঢাললাম। আপাতত মেঘালয় ভ্রমণের সমাপ্তি।

২৯ এপ্রিল

এদিন শুধু চলল গোটানোর পালা। সংগ্রহ করা গাছপালার জঙ্গল সামলে, বিকেলে পুলিশ বাজারের তন্দুরি চিকেন চিবিয়ে সেলফি তুলে একটু বিশ্রাম নেওয়ার অবসর।

শিলং আর উমিয়াম

৩০ এপ্রিল, ২০১৯

সকাল ৯টা আর সুইফট ডিজায়ার। আর গন্তব্য গুয়াহাটি আইআইটি, কারণ সেখানে একবেলা থাকার নেমন্তন্ন করা হয়েছে। গাড়িতে বসে বসে দেখতে পাচ্ছিলাম নতুন করে, ভূপেন হাজারিকার সমাধি মন্দির, ব্রহ্মপুত্রের রুপোলী জল, সরাইঘাট সেতু, অবশেষে ক্যাম্পাস।

গুয়াহাটি আইআইটি ক্যাম্পাস

এখানে হস্টেলগুলি সব নদীর নামে। আমার একবেলার ঠাঁই হল বালিকা হস্টেল ‘ধানসিড়ি’তে। বলা হয়, এটি নাকি সবচেয়ে সুন্দর আইআইটি ক্যাম্পাস। ক্যাম্পাসে সুবনসিড়ি লেক আর সারপেন্টাইন লেক, ডিরেক্টর বাংলোর প্যাঁচানো পথ, চিতা বাঘের শূন্য খাঁচা, ভিউ পয়েন্ট আর সবুজ পাহাড় আর একদল তরুণ তরুণীর গলায় ‘এই একলা ঘর আমার দেশ, আমার একলা থাকার অভ্যেস’ সন্ধ্যে নামছে উদাত্ত গলায়। স্মৃতি জড়িয়ে বন্ধু বানিয়ে ফিরছি আমি আমার ‘একলা ঘরে’।

নংপো‌ experimental garden

এরপর ৯টায় ট্রেন, হুল্লোড়বাজগুলো ট্রেনে মালপত্র-সহ তুলে দিল। চাকা গড়াল।

একটু একটু করে যাচ্ছি বাংলার ওই সোঁদা গন্ধের দিকে।

কভারের ছবি— তিন উপজাতির মুরগি দেবতা।

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *