জঙ্গল যাপন পাহাড়িয়া বাঁশি বিশেষ ভ্রমণ

ধারাপাতের ধারাগিরি

দীপক দাস

ঝপঝপ করে চারজন নেমে পড়ল অটো থেকে। গিয়ে দাঁড়াল মারমুখী দুই দলের মাঝে। অটো থেকে কোনওদিন নায়ককে নামতে দেখেছেন? কোনও অ্যাকশন দৃশ্যে? আমি তো দেখিনি। অবশ্য সব দক্ষিণী সিনেমা দেখা হয়ে ওঠেনি। কোনও একটাতে থাকলেও থাকতে পারে। দক্ষিণী পরিচালকদের যা বুদ্ধি!…

পাঁচ অটোমূর্তিকে দেখে একটু থমকে ছিল দুই দলই। হয়েছেটা কী, দুই বাইক বাহিনীর রাস্তায় কুড়োনো ঝামেলা। ১৫ অগস্ট। জাতীয় ছুটির দিন। বাইক নিয়ে দলবল বেড়িয়ে পড়েছে রাস্তায়। একটি দলের সঙ্গে দু’জন মেয়েও ছিল। কী নিয়ে ঝামেলা বুঝতে পারিনি। শুধু দেখেছি, দু’দল মারমুখী হয়ে তেড়ে যাচ্ছে পরস্পরের দিকে। দু’দলকে আলাদা করা গেল। দাড়িটাড়ি রেখে জ্ঞানতাপসের মতো দেখতে আমাকেই। তাই জ্ঞানটা আমিই দিলাম, সঙ্গে মেয়েরা রয়েছেন। অচেনা জায়গায় ঝামেলা করছেন? শিগগির গাড়িতে উঠুন। ছেলের দল মেয়েদের নিয়ে চলে গেল। অন্য দলটাকে বললাম, ছেড়ে দিন দাদা। ততক্ষণে তো বুঝেছি, দোষ প্রথম দলটারই। মেয়েদের নিয়ে বেরিয়েছে। তাই হিরোগিরির নেশা পেয়েছে। মেয়েরা সবসময়ই নার্ভগুলোকে একটু চনমনে করে তোলে না! হ্যাঁ, ওই পাঁচ অটোমূর্তি আমরাই ছিলাম। ছোটা ডন বাবলা, গার্ডবাবু শুভ, ফটোগ্রাফার ইন্দ্র (প্রাক্তন), ঘাসপুস দীপু আর…যাগগে।

শবরপাড়ায় ঢোকার রাস্তা।

চলেছি বুরুডি। স্বাধীনতা দিবস যে। ছুটি কাটাতে হবে না! পূর্বপুরুষেরা লড়াই করে আমাদের মুক্তি এনে দিয়েছিলেন। আমরা মুক্তকচ্ছ হয়ে দিবস পালন করছি।

বুরুডি ড্যাম নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। আবার বললেও ক্ষতি নেই। বুরুডি কখনও পুরনো হতে পারে না। এখানে দূরে পাহাড়ের মাথায় মেঘ আটকে থাকে। আটকে রাখা জলে মেঘ আর পাহাড়ের ছায়া পড়ে। হাওয়া বয় মৃদুমন্দ। সেই হাওয়ায় ড্যামের জলে কাঁপন লাগে। জল পাথর বাঁধানো পাড়ে ছলাৎ শব্দে ধাক্কা খেয়ে ছড়িয়ে পড়ে। দিক ভরা সৌন্দর্যের মাঝেও কিছু লোক ছিপ ফেলে এক মনে।

যাত্রা শুরু।

এ সবই কিন্তু আমি আগামীকাল দেখেছিলুম। আজ আমি ছিলুম বড় ক্লান্ত। বুঝতে পারছেন না তো? বুরুডিতে এই সফরে দু’বার এসেছিলাম আমরা। দ্বিতীয় দিনের ঘোরাফেরা লেখা রয়েছে, ‘গালুডির পাকোচ মাছ আর বুরুডির আমড়া’র চাটনিতে। দ্বিতীয় দিনেই দেখেছিলুম বুরুডির সৌন্দর্য। প্রথমদিন মাথায় অক্সিজেন যাচ্ছিল না। রাতে ঘুম হয়নি। তাই বুরুডিতে গিয়েই একটা খাটিয়ায় লম্বা হয়েছিলুম। এখানে চারদিক খোলা চালা বাঁধা ভাতের হোটেল রয়েছে কয়েকটা। তারই একটাতে লম্বা। চালকদাদার চেনা হোটেল। এই হোটেলেই দুপুরের খাওয়া হবে। কিন্তু কী খাওয়া হবে? প্রশ্নটা দু’বার করল ইন্দ্র। একবার শুভ। ইঙ্গিত পরিষ্কার। হোটেলের চালায় দু’টো মুরগি বাঁধা। দেশি। আজ দেশি মুরগি আর ভাত। বাবলার আবার হোটেলর মুরগি ঠিক পছন্দ নয়। ও মোরগ চায়। বেশ স্বাস্থ্যবান। যেন মোরগটাকে দিয়ে ও লড়াই করাবে। বা পুষবে। কিন্তু তেমন মোরগ এখানে নেই। আছে হোটেল মালিকের পাড়ায়। তিনি বাইক নিয়ে মোরগ ধরতে বেরিয়ে গেলেন। আমি খাটিয়ায় লম্বা হলুম। আর ওরা চারজন ড্যামের পারে গেল।

আর্টেজীয় কূপ।

কিছুক্ষণ পরে মোরগ এল। সত্যিকারের গর্বিত মোরগ। সাড়ে তিন কিলো ওজন। বাবলার তো গর্বে বুক ফুলে উঠেছিল। বিল মেটানোর সময়ে গর্ব আরও বাড়ল। মোরগ, রান্নার মজুরি মিলিয়ে বিল হল ১১০০ টাকা!

হোটেল মালিক মোরগের ব্যবস্থা করতে লাগলেন। আমরা অটো নিয়ে ধারাগিরি যাত্রা করলাম। পাকদণ্ডী বেয়ে অটো চলতে লাগল। পথের বর্ণনা কী দেব? যে দিকে দু’চোখ যায় সবই সবুজ। চেনা অচেনা কত গাছ। দূরের পাহাড়ও সবুজ। পথের মাঝে লোক চলাচল নেই। মাঝে দু’জনের সঙ্গে দেখা হল। একপাল ছাগল নিয়ে চলেছেন। এই সফরে বৃষ্টি আমাদের পিছন ছাড়েনি। মূল রাস্তা ছাড়তেই কাদায় ভরা রাস্তা। ধারাগিরির ঠিক আগে শবর পাড়ার রাস্তা তো কাদায় দই হয়ে রয়েছে। কিন্তু কাদা বাদ দিলে বাকি পরিবেশ মন ভরিয়ে দেয়।

আমাদের গাইড।

শবর পাড়া থেকে একজন গাইড নেওয়া হল। এক বৃদ্ধ। গাইডের পিছু নেওয়াই পর্যটকদের কর্তব্য। কিন্তু আমাদের জন্য উনি এগোতেই পারছিলেন না। কী করে এগোবেন? আমরা যে যেতে যেতে বারবার থমকাচ্ছি। না থমকে উপায় আছে? শবর পাড়া থেকে ধারাগিরির জঙ্গলে ঢোকার আগে পর্যন্ত রাস্তাটা তো আমাদের জন্য সবুজ গালিচা পেতে রাখা। সেই গালিচা ফুঁড়ে কোথাও অল্প একটু রাঙা আলু, ডাল জাতীয় কিছু চাষ হয়েছে। এক জায়গায় মাটির নীচে থেকে জল উঠছে। আপনাআপনি। সেই জল নিয়মিত বয়ে চলে তৈরি করেছে একটা নালা। জল বয়ে গিয়ে পড়ছে দূরের জমিতে। গাইডের নামটা ভুলে গিয়েছি। ওঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, এটা কী? উনি বললেন, মাটি থেকে জল উঠছে। লোহার একটা পাইপ দেওয়া জলের উৎসে। আমার মনে হল কোনও আর্টেজীয় কূপ। পাথুরে জমির অন্ত:স্থল গলানো জলেই চাষবাস হয়। আরেকটু দূরে একটা মহুল গাছ একাটি দাঁড়িয়ে। অনেক দূরে সবুজ পাহাড়। জঙ্গল, চাষের জমি মিলিয়ে সে এক অপূর্ব দৃশ্য।

দলবেঁধে।

জঙ্গলে ঢোকার আগে একটু থমকাতে হল। একটা ঝুপড়ির দোকান। তার মানে লোকজন নিয়মিতই আসেন। একটু নজর করতে পর্যটকদের আনাগোনার চিহ্ন চোখে পড়ল। চিপস, বিস্কুটের প্যাকেট ছড়ানো। নাদা দেখে যেমন বোঝা যায় হাতির আগমন তেমনই পর্যটকদের আনাগোনা বোঝা যায় ছড়ানো প্লাস্টিকে। সেসব পেরিয়ে জঙ্গলে ঢোকা গেল। নির্জন, স্যাঁতসেঁতে জঙ্গল। ভিজে মাটি, পুরনো পাতার গন্ধ। অন্ধকার অন্ধকার। কেমন যেন ছমছমে ব্যাপার। আমাদের হাসাহাসিতে জঙ্গলের নীরবতা ভেঙে যাচ্ছিল বারবার।

পার হচ্ছেন আরেক হেভিওয়েট, গার্ডাবাবু। দীপু সাবধান করছে।

হাসি তো পাবেই। সঙ্গে ইন্দ্র আছে যে। চলার পথে একটা নালা পড়েছিল। বেশ চওড়া। নালা পার হওয়ার জন্য গাছের ডাল দিয়ে সেতু তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু জল পেয়ে, পুরনো হয়ে সেই ডাল আর ভরসার যোগ্য নয় বলেই মনে হচ্ছিল আমাদের। ফলে ইন্দ্রকে বললুম, ‘তুই সবচেয়ে শেষে পার হবি।’ ওর যা ওজন! ও যদি প্রথমে পার হয় আর ডাল ভাঙে তাহলে ওকে ধারাগিরির জঙ্গলেই রেখে যেতে হবে। অথবা গাছের ডাল কেটে নতুন সেতু তৈরি করে আবার ফিরিয়ে আনতে হবে। কারণ ইন্দ্র যতই ব্ল্যাক বেল্ট হোক লাফিয়ে নালা পার হতে পারবে না। যেটা আমাদের পক্ষে সম্ভব। প্রস্তাবে রেগে গেল ইন্দ্র। আমি কি মোটা, অনেক রোগা হয়ে গেছি’ ইত্যাদি বলতে বলতে দাঁড়িয়ে গেল। ছবি তুলতে শুরু করল। বাবলাটা এমন বদমাশ, লাফিয়ে নালা পার হল। ওপারে গিয়ে বলল, ‘এই রকম করে পারবে?’

উপল বিছানো পথ।

না, কোনও অঘটন ঘটেনি। ডাল ইন্দ্রর ভার সয়ে নিল। আর আমরা আস্তে আস্তে ঢুকে গেলুম জঙ্গলে। বেশ ঘন জঙ্গল। বর্ষার জল পেয়ে গাছেরা আমোদিত। নবযৌবনা সব। তার মাঝ দিয়েই পথ। ধারাগিরির কাছাকাছি এসেছি, হঠাৎ একটা কলরব কানে এল। গান গাইছে, কথা বলছে, চিৎকার করছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখা হয়ে গেল সেই কলকাকলির দলের সঙ্গে। পর্যটকের দল। ওদের কথা এবং আচরণে বোঝা গেল, গোটা দলই স্বাধীনতা উদযাপনে মত্ত। অনর্গল গালাগাল বেরোচ্ছে। আহা রে! ভারতমাতার স্বাধীন সন্তানেরা। মদ ছাড়া যে উল্লাস জাগে না।

পৌঁছে গিয়েছি প্রায়।

অবশেষে পৌঁছলুম ধারাগিরি। বিশাল বিশাল পাথর বিছানো গাছপালাময় আধো অন্ধকার একটি জায়গা। পাহাড়ের মাথা থেকে নেমে আসছে ধারাপাত। জলধারা নেমে আসে বলেই কি এর নাম ধারাগিরি? জানি না। এখন জলধারা ক্ষীণ। কিন্তু এলাকা দেখলেই বোঝা যায়, পাহাড়ের মাথায় প্রবল বৃষ্টিতে জল ছোটে সমস্ত এলাকা ছাপিয়ে। পাথর-পথের অনেক জায়গাতেই এখনও বয়ে যাওয়া জলের চিহ্ন। দুই পাথরের মাঝে গর্তে জমে থাকা জলে মাছ, ব্যাঙ ঘুরছে। কঠিন পাথর ঘিরে, ফাঁকে ফাঁকে প্রচুর গাছপালা। সবুজ গাছ, কালো পাথর আর সাদা জলধারার অদ্ভুত বৈপরীত্য চারিদিকে।

কিছুক্ষণের মধ্যে শুরু হল আমাদের ফটোশ্যুট। ইন্দ্র ঝট করে চুল আঁচড়ে নিল। শুভর মুখে কথা নেই। এখানকার নির্জনতা ওকে গ্রাস করেছে? মোটেই নয়। ও শেষ যে কথাটা বলেছে, সেটাই আবার শুরু করার তাল করছে। এই রকমই ও। টেপরেকর্ডারের মতো। যেখান থেকে সুইচ অফ করা হবে সেখান থেকেই শুরু করবে সুইচ অন হলে। বাবলাটা গেছুড়ে। ও ছোটখাট শরীর নিয়ে পাথরে পাথরে লাফিয়ে বেড়ালো। দীপু ছবি তুলছিল। ক্যামেরা স্ট্যান্ড খাটিয়ে ফেলল।

ধারাগিরি।

ধারাগিরি যেন এক টুকরো আদিম দুনিয়া। চারিদিকে ফেলা যাওয়া গুটখা, খাবারের প্যাকেট, আমাদের ক্যামেরা, সাজপোশাক না থাকলে সেই আদিমতার রূপ আরও বাড়ত। আমাদের কথাবার্তা ছাপিয়ে কানে আসছিল পাখির ডাক। একটা পাখি ডেকেই চলেছে। মিষ্টি তার ডাক। এই সম্ভাষণ উচ্চারিত হয় শুধু প্রিয়ার উদ্দেশ্যেই। বেশ বোঝা যাচ্ছিল। নাম জানি না পাখির।

অনেকটা সময় ছিলাম আমরা ধারাগিরির কোলে। পাখির ডাক একটা দু’টো করে বাড়ছিল। বাকি সময়ে পুরো নিস্তব্দ। এই নীরবতাতেই মনে কেমন যেন ভয় জাগাচ্ছিল। কলরবের দুনিয়ার মানুষ আমরা। কোনও না কোনও আওয়াজ হয়েই চলে প্রাত্যহিকীতে। প্রকৃতি নীরব থাকলে সাড়া দেয় মোবাইলে ঘাপটি মেরে থাকা সোশ্যাল মিডিয়া। মেসেজ ঢোকে। ধারাগিরির নীরবতা পেয়ে বসছিল আমাকে। এবার ফেরা দরকার।

এমনই মোহময়ী।

ফেরার সময়ে এক তাল গোবর দেখতে পেলাম। শুভ বলল, হাতির নাদা। শুনেই চমকালাম। হঠাৎ করে হাজির হলে? আবার সেই নীতিকথার ভালুকের গল্প অভিনীত হবে। নিজেরা নিজেদের চিনতে পেরে যাব। হাতি না বেরনোই ভাল।

সেই খোলা প্রান্তরে যখন এসে পৌঁছলাম, তিনটে বাচ্চা ছিল সেখানে। একটা বাচ্চা পা টেনে টেনে চলে। গাইড বললেন, পোলিও হয়েছে। আমাদের সঙ্গে রেশনের চিড়ের প্যাকেট ছিল। ওদের দিয়ে দিলুম। শবর পাড়ায় গাইডের প্রাপ্য মেটানো হল। তখনই এক বুড়ি এসে পয়সা চাইতে শুরু করল। বুড়ির চোখ মুখ ফোলা। দেখলেই বোঝা যায় নিয়মিত নেশা করে। আরও কয়েকজন মেয়ে পুরুষ বসেছিল বাড়ির সামনের দাওয়ায়। তোম্বা মুখে। ওরাও নেশা করে আছে।…

এক শবর বালক।

শবর পাড়ার কাঁচা রাস্তা ছাড়িয়ে অটো তখন পাকদণ্ডীতে। ঝেঁপে বৃষ্টি নামল। গাড়িতে থাকা অবস্থায় বৃষ্টি অনেকবার পেয়েছি। কিন্তু পাহাড়ি রাস্তায় অটোয় যেতে যেতে বৃষ্টি! সে এক স্মরণীয় অভিজ্ঞতা। সেই অভিজ্ঞতা বর্ণনা করার সাধ্য আমার নেই। কারণ বিভূতিভূষণ কোনওদিন অটোয় চড়ে পাহাড়ে ঘোরেননি। ফলে কিছু লেখেননি।

পাহাড়ে তখন বৃষ্টি নেমেছে।

ছবি— ইন্দ্র, দীপু, শুভ

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *