জলযাত্রা পাহাড়িয়া বাঁশি বিশেষ ভ্রমণ

ভাইজাগ, আরাকু আর ফস্কে যাওয়া ব্যাম্বু বিরিয়ানি- শেষ পর্ব

সৌগত পাল

ঘরে ফিরে একটু বিশ্রাম করে চলে এলাম সমুদ্রের ধারে। রাতের সমুদ্র বোধহয় সব জায়গাতেই এক। মানুষের ভিড় ফেরিওয়ালাদের চিৎকার আর সমুদ্রের গর্জন। অনেকটা রাত অব্দি বসে থাকলাম। তারপর ঘরে ফিরেও ব্যালকনিতে বসে রইলাম অনেকক্ষণ। কাল আবার বাকি জায়গা গুলো যাবব। সারা দিন ঘোরাঘুরি করে ক্লান্ত লাগছিল। শোয়া মাত্রই ঘুম। সকালে ঘুম ভেঙে যেতে গেলাম ব্যালকনিতে। সেই অসাধারণ সূর্যোদয়। সকালে ইডলি দিয়ে টিফিন সেরে চলে গেলাম সমুদ্রে স্নান করতে। এখানে ঢেউ খুব মৃদু। পুরী বা দীঘার মতো শক্তিশালী নয়। তবে এখানে সমুদ্রের জল খুব পরিষ্কার। অনেকক্ষণ স্নান করার পরও গায়ে বালি লাগল না। স্নান সেরে তৈরি হয়ে গেলাম।

লাইট হাউস থেকে তোলা ছবি।

দুপুরের খাওয়া খেয়ে বেরিয়ে পড়লাম। আজ গন্তব্য ডলফিন নোজের উপরে লাইটহাউস। তার আগে বন্দরটা ঘুরে দেখলাম। ছোট ছোট অনেক লঞ্চ সার দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর রোদে সামুদ্রিক মাছ শুকোচ্ছে। এছাড়া আর বিশেষ কিছু দেখতে পেলাম না। ওখান থেকে গাড়ি চলল ইয়ারদা বিচ। এখানেও অনেক মানুষের ভিড়। একটা জিনিস দেখলাম এখানে প্রত্যেক জায়গায় সমুদ্রের রঙ আলাদা আলাদা। এবার গাড়ি চলল ডলফিন নোজ। এই ডলফিন নোজ যাবার রাস্তাটা ভারি সুন্দর। পাকদণ্ডী রাস্তা আর চুলের কাঁটার মতো বাঁক। যত উপরের দিকে উঠছি নীচে শহরটা দেখা যাচ্ছে। দেশলাই বাক্সের মত ছোটো লাগছে বাড়িগুলো। লাইট হাউসে পৌঁছে টিকিট করে জুতো খুলে ভিতরে ঢুকতে হল। কিন্তু উপরে আর উঠতে পারি না। আসলে উপরে উঠার সিঁড়িটা খুব সরু আর ওটাই নামার রাস্তা। তাই ঠেলাঠেলি। অবশেষে উপরে উঠতে পারলাম। সামনে শুধু নীলজল রাশি। হু হু করে হাওয়া আসছে। নামতে ইচ্ছা করছিল না। কিন্তু নীচে আরো লোকজন দাঁড়িয়ে। তাদেরও দেখতে দিতে হবে। তাই নেমে এলাম। গাড়ি করে এবার নীচের দিকে নামতে লাগলাম। আবার মন ভোলানো দৃশ্যগুলো। গাড়ি দাঁড় করিয়ে ছবি তুললাম কিছু। সন্ধের সময় ফিরলাম হোটেলে।

ভাইজাগ শহর।

আজ রাতের মেনু বিরিয়ানি। সঙ্গে রায়তা। এখনও মনে পড়লে জিভে জল এসে যায়।

পরদিন সকালে তাড়াতাড়ি উঠে পড়েছি। কারণ ট্রেন ধরতে হবে। হ্যাঁ আজ বাড়ি ফেরার ট্রেন ধরতে হবে কিন্তু সেটা রাতের বেলা। এখন সকালে ট্রেনে করে যাব আরাকু ভ্যালি। গাড়ি করেও যাওয়া যায় কিন্তু ট্রেন থেকে পথের যে সৌন্দর্য দেখা যায় তা গাড়িতে পাওয়া যায় না। আরাকু স্টেশনে গাড়ি আমাদের জন্য অপেক্ষা করবে। ট্রেন থেকে নেমে আমরা গাড়ি করে ঘুরব। এই আরাকু ভ্যালি অনেক গল্পে জায়গা পেয়েছে। সন্তু তো কাকাবাবুকে খুঁজতে আরাকু যাবার পথে ট্রেন থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছিল। পান্ডব গোয়েন্দাও আরাকুতে অভিযানেএসেছিল।

লাইট হাউস।

যাই হোক সকালে স্টেশনে এসে টিকিট কেটে বসলাম কিরণ ডৌল প্যাসেঞ্জারে। ট্রেন ছাড়ল ৬টা ৫০ মিনিটে। শহর শহরতলি ছাড়িয়ে ট্রেন গ্রাম্য এলাকা ধরে চলতে লাগল। স্টেশন আসছিল। নামগুলো কী বড় আর খটোমটো। ট্রেন মোটামুটি খালি বলা চলে। সবাই ঘুরতেই যাচ্ছে। দু’চারজন অফিস যাত্রী ছিলেন। তাঁরা কয়েকটা স্টেশন পরেই নেমে গেছেন। বেশ লাগছিল দু’পাশের প্রকৃতি। পাহাড় গাছপালা চাষ জমির ভিতর দিয়ে ট্রেন ছুটে চলেছে। হঠাৎ লোকজন হইহই করে উঠল। আর তারপর সব অন্ধকার। ট্রেন পাহাড়ের পেটে ঢুকে পড়েছে। মানে টানেলের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এরপর নিয়ম করে এরকম হতে লাগল। এই রাস্তায় একরম অনেক টানেল আছে। পাহাড় কেটে রেললাইন পাতা হয়েছে।

টানেলে ঢোকার মুখে।

প্রকৃতি উপভোগ করতে করতে ১০টা নাগাদ আরাকু স্টেশনে পৌঁছলাম। এখানে বলে দেওয়া ভাল এর আগে আর একটা স্টেশন আছে আরাকু ভ্যালি নামে। সেটায় কিছু নেই। একটা সাইন বোর্ড অবধি নেই। একটা পিচবোর্ডে নাম লিখে লাঠিতে বেঁধে স্টেশনে বসিয়ে দিয়েছে কেউ।

আরাকু ভ্যালি স্টেশন। এই স্টেশন গন্তব্য নয় কিন্তু।

আমাদের গাড়ি অপেক্ষা করছিল। গাড়িতে উঠে কিছু দূর গিয়ে প্রথমে সকালের খাওয়াদাওয়া সেরে নিয়ে চললাম বোরা কেভ’স বা বোরা গুহালু। ছবির মতো সাজানো রাস্তা পেরিয়ে বোরা গুহা পৌঁছলাম। বাইরে অনেক খাবারের দোকান। তারা অর্ডার নিতে ছুটে আসছে কোনো গাড়ি দেখলেই। বলছে অর্ডার দিয়ে চলে যান। গুহা ঘুরে এসে খেয়ে নেবেন। কিন্তু অর্ডার না দিলে কি খাবার পাব না? তারপর ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম। অর্ডার একটা বিশেষ খাবারের জন্য নেওয়া হচ্ছে। ‘ব্যাম্বু চিকেন’। বাঁশের মধ্যে মাংস মশলা মাখিয়ে আগুনে ঝলসে বানানো। আমার খুব ইচ্ছে ছিল। কিন্তু ওই পারিবারিক ভ্রমণ। তাই পিছিয়ে আসতে হল। ওই মাংস পচা। অনেক দিনের। এইসব যুক্তি। তখন তো কলকাতায় ভাগাড় কাণ্ড হয়নি। তাই আমি যুক্তির সামনে পিছিয়ে আসতে বাধ্য হলাম।

আরাকুর পথে। গলিকোন্ডো ভিউ পয়েন্ট থেকে তোলা।

বোরা গুহার মধ্যে বেশ একটা গা ছমছমে ব্যাপার। আধো অন্ধকার আর পাহাড়ের ছাদ থেকে চুঁইয়ে চুঁইয়ে জল পড়ছে। পাহাড়ের ছাদে চুনাপাথর জমে নানা রকম আকৃতি তৈরি হয়েছে। কিন্তু সেগুলোতে লাল নীল সবুজ আলো লাগিয়ে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নষ্ট করে দিয়েছে। খুব সাবধানে পা টিপে টিপে চলতে হচ্ছিল।

বোরা গুহার ভিতরে স্ট্যালাগমাইট।

অনেকটা সময় ভিতরে কাটিয়ে গুহার বাইরে বেরিয়ে এলাম। এবারের মতো ঘোরা শেষ হয়ে গেল। এবার ফেরার পালা। ফেরার সময় এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। কিছু স্থানীয় মানুষ কফি মশলা ইত্যাদি বিক্রি করছিলেন। সেই কফি কিনেছিলাম। এরপর হোটেলে ফিরতে ঘণ্টাখানেক লেগেছিল। আসতে আসতে দেখছিলাম এখানকার রাস্তা কত পরিস্কার আর ট্রাফিক জ্যাম নেই। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ছাড়া এই কারনেও সমুদ্র তীরবর্তী অন্ধ্রপ্রদেশের এই বাণিজ্য নগরী তথা বন্দর নগরী মানুষ এত ভিড় করেন।

কৃত্রিম আলোয় স্ট্যালাগমাইট।

সন্ধ্যাবেলা আমাদের ফেরার ট্রেন। হোটেলের বিল মিটিয়ে ব্যাগপত্তর নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম স্টেশনে ট্রেন ধরতে। ট্রেনে খাবারদাবার খেয়ে ঘুম।

বিশাখাপত্তনম বন্দর।

সকালে ঘুম ভেঙে আবার সব চেনা জায়গা।

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *