জঙ্গল যাপন বিশেষ ভ্রমণ

খৈরি নদী, জায়ান্ট স্কুইরেল আর সিমলিপাল

ইন্দ্রজিৎ সাউ

‘ইন্দ্রদা ও ইন্দ্রদা গাড়িটা থামাতে বল না, আর যে সহ্য হচ্ছে না।’’ শিলাদিত্যর প্রবল ধাক্কাধাক্কিতে ঘুমটা ভেঙে গেল। কোলাঘাট ছাড়ার পরপরই একটু ঘুমিয়ে নিচ্ছিলাম। এর পর সুব্রতকে পিছনের সিটটা ছেড়ে দিতে হবে। আর ড্রাইভারের পাশে বসলে ঘুমতে পারব না। এবারেও আমরা বেরিয়া পড়েছি বর্ষ শেষের রাতে। গন্তব্য সিমলিপাল ন্যাশনাল পার্ক, উড়িষ্যা। এবারে সঙ্গী ন’জন, সুব্রত, মিন্টুদা, দুলালদা, তপনদা, সুদীপ, গৌতমদা, বিশ্বজিৎ, আর শিলাদিত্য। ড্রাইভার কাম অল ইন ওয়ান, রাজা তো আছেই। এটা রাজার ২৮তম সিমলিপাল যাত্রা। ঘুম ভাঙার পর রাজাকে বললাম, রাজাদা গাড়িটা থামাও বাচ্ছাটা যে থাকতে পারছে না। বলার সঙ্গে সঙ্গে সবাই রে রে করে উঠল। পারলে দু’ঘা বসিয়েই দেয়।

জঙ্গলপথে।

রাত তখন ১.৪০। আমরা লোধাশুলির জঙ্গলে। একটা সময় মাওবাদী উপদ্রুত এলাকা ছিল। এক সঙ্গে ১০-১২টা গাড়ি ছাড়া যাওয়া যেত না। এখন অবশ্য আর কোনও ভয়ের ব্যাপার নেই। জঙ্গল পেরিয়ে মাঝে দু’এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ভোরের দিকে পৌঁছলাম বাংরিপোসি। এখান থেকেই পাহাড়ি জঙ্গলের শুরু। রাস্তার দু’পাশে মোটা মোটা গাছের সারি, রাস্তায় গাছের মালার সৃষ্টি করেছে। দেখেই তাদের প্রাচীনত্ব মালুম হচ্ছিল। দেখে কাশ্মীরের গার্ডেন রোডের কথা মনে হচ্ছিল।কাশ্মীরের গার্ডেন রোডে ঠিক এমনি গাছের সারি দেওয়া সুন্দর রাস্তা আছে।

তরলিত চন্দ্রিকা চন্দন বর্ণা।

জোশিপুরে প্রধান অফিস থেকে যাবতীয় ছাড়পত্র নিয়ে আমরা জঙ্গলের দিকে রওনা দিলাম। সিমলিপাল জঙ্গলে রাত্রি যাপনের খুব ভাল ব্যাবস্থা আছে। ২৭৫০ কিমি বিস্তৃত এই জঙ্গলে এখন চারটি জায়গায় থাকার ব্যাবস্থা আছে। কুমারী, গুরগুরিয়া, জামুয়ানি আর রামতীর্থ। আমরা আগে থেকেই জামুয়ানিতে ঘর বুক করে গিয়েছিলাম। কালিয়ানি চেক গেটে যাবতীয় কাগজপত্র দেখিয়া জঙ্গলে ঢুকলাম। চেক গেটে দাঁড়ানোর সময় খুব কাছেই জলের স্রোত বয়ে যাওয়ার খুব তীব্র আওয়াজ পাচ্ছিলাম। গেটম্যানকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে খৈরি নদী। অপূর্ব সুন্দর এই পাহাড়ি নদী। খৈরি দেখে আমরা এগিয়া চললাম। প্রথমেই গেলাম উস্কি ঝর্ণা দেখতে। লালমাটির কাঁচা রাস্তা ধরে কিছু দূর গিয়ে গভীর জঙ্গল। দু’ধারে চল্লিশ থেকে সত্তর আশি ফুটেরও বেশি বড় বড় শাল সেগুন ছাড়াও কত নাম না জানা গাছের সারি। জঙ্গলে ঘুরতে ঘুরতে দীপুর কথা খুব মনে হচ্ছিল। আমাদের দীপু ভাই। ঘাসপুসকে ডক্টর। কিছু গাছ তো চেনাতে পারত। জঙ্গল এতই ঘন যে সূর্যের আলো ঠিক করে ঢুকতে পারছে না। চারিদিকে আলো ছায়ার খেলা। এই জঙ্গলে অনেক আদিবাসী গ্রাম আছে, যাওয়ার পথে তাদের ছোট ছোট বাচ্ছারা আমাদের হাত নেড়ে অভ্যর্থনা জানাছিল। আমরাও তাদের জন্য লজেন্স নিয়ে গিয়েছিলাম।

ঘোরার পথে এরকম দৃশ্যে অস্বস্তি হয়।

উস্কি গিয়ে আমরা টিফিন করে নিলাম। দারুণ সুন্দর একটা ঝর্না। চারিদিকের ছবি যখন তুলছি হঠাৎ দেখি মিন্টুদা চেঁচাচ্ছে, “ইন্দ্র আমার ছবি তোলো দ্যাখো আমি কোথায়?” ঘুরে দেখলাম আমাদের সাতান্ন বছরের যুবক মিন্টুদা ঝর্নার একেবারে নীচে চলে গেছে। সবাই একসাথে চেঁচিয়ে উঠলাম, পিচ্ছিল পাথরে পা পিছলে পড়লে আর দেখতে হবে না। আশি নব্বুই কিলোমিটারের আগে কোনও চিকিৎসা পাবে না।

উস্কি ঝর্না দেখে আমরা জামুয়ানির দিকে এগিয়া চললাম। পথে দেখলাম অপূর্ব সুন্দর সব ভ্যালি। আর পাহাড়ের মালায় ঘেরা জঙ্গল। চড়াই আর উৎরাইয়ের মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চললাম। বরুনদাবন চেক গেট ছাড়িয়ে এসে রাজা গাড়ি থামিয়ে দিল, এবং রহস্য করে সবাইকে নামতে বলল। আমরা তো ভেবেই আস্থির, সবাইকে বাঘে খাওয়াবে নাকি? সবার আগে দেখি রাজাই নেমে গেল, সাহস পেয়ে আমরাও একে একে নামলাম। তার পর রাজা ফিস ফিস করে বলল, চুপ করে থাকো এখানে অনেক জায়ান্ট স্কুইরেল আছে। রাজার কথা মতো আমরা একটু এগিয়ে গেলাম এবং সত্যি সত্যি একটা জায়ান্ট স্কুইরেল খুব দ্রুত এক গাছ থেকে আর এক গাছে ঝাঁপিয়ে যেতে দেখলাম। সেই সঙ্গে দূর থেকে অন্য অনেক স্কুইরেলের আওয়াজ পেলাম। তপনদার সরস মন্তব্য, “গিন্নি ডেকেছে তাই বাবুর এত তাড়া”।

অনেক কষ্টে তোলা এক জায়ান্ট স্কুইরেলে ছবি। ছবি জুম করে দেখলে বোঝা যাবে।

জামুয়ানি থাকার ব্যবস্থা খুবই সুন্দর। ঘর থেকে চারিদিকের পরিবেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন আর খুব সুন্দর করে সাজান। বিশেষ করে দেখলাম এখানকার যারা আমাদের আপ্যায়নের জন্য ছিল প্রত্যেকেই সাঁওতাল পরিবারের ছেলে এবং মেয়ে। তাঁদের নম্র ভদ্র আর অমায়িক ব্যবহার আমাদের আপ্লুত করল পুরো সময়। রুমে জিনিসপত্র রেখে ফ্রেস হয়ে খেয়ে নিলাম। দুপুরে আমাদের খাওয়াল আলুভাজা ডিমের ঝোল দু’রকম তরকারি ভাত পাঁপড় আর চাটনি। রান্নার স্বাদও দারুণ। এই গভীর জঙ্গলে এক রাজকীয় ব্যবস্থা।

খাওয়ার পর সকলে রাতের বাকি ঘুম পূরণ করতে শুয়ে পড়লাম। শোয়ার সময়ই রাজা বলে দিয়েছিল বিকালে যদি ওকে ঘুম থেকে তুলতে পারি তাহলে জঙ্গল ঘোরাতে নিয়ে যাবে গাড়িতে। ঘুম থেকে উঠে সবাই রেডি। অনেক ডাকাডাকির পরও রাজার ঘুম ভাঙানো গেল না। অগত্যা আমরা হেঁটেই বেরলাম আশপাশটা ঘুরে দেখতে, আমি বাদে। আমি বেরলাম সাইকেলে। এখানে টুরিস্টদের জন্য আধুনিক কেতার সোজা হ্যান্ডলের নতুন অনেকগুলো সাইকেল রাখা আছে। কিছুদূর যাওয়ার পরই ঢালাই রাস্তা পেলাম। সেটা ধরে একটা গ্রামে পোঁছলাম। ভদ্রেশ্বর গ্রাম। ময়ূরভঞ্জ জেলা। গ্রামের সর্বত্র হতদরিদ্র ছবি বর্তমান। ইটের বাড়ির কদাচিৎ দেখা মেলে। সবই মাটির নয়তো বেড়ায় ঘেরা খড়ের ছাউনি। যার মধ্যে রোদ জল সবই অবাধে যাতায়াত করে। জানি না এরা কেন প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা থেকে বঞ্চিত? তবে উড়িষ্যা সরকার সব বাড়িতে বিনামূল্যে সৌর বিদ্যুতের ব্যবস্থা করে দিয়েছে।

বসত।

ফিরলাম যখন অন্ধকার নেমে এসেছে। ফিরে বসে আছি, মাদলের আওয়াজ শুনতে পেলাম। হোটেলের একজন বলল, আজ আশেপাশের গ্রাম থেকে অনেকে এসেছে নতুন বছরের প্রথম দিনের আনন্দে মাততে। আমরা দেখতে যেতে পারি কিনা জানতে চাওয়ায় বলল কোনও অসুবিধা নেই।

জঙ্গল-প্রান্তরে মেশামেশি।

সকলে মিলে বেরিয়ে পড়লাম ধামসা মাদলের নাচ দেখতে। অন্ধকার পথে লাইট নিয়ে এগিয়ে চলেছি। দেখা হল একদল যুবকের সঙ্গে। সকলেই এসেছে পাশের মঞ্জলি গ্রাম থেকে। এরাও মাদলের তালে নাচতে যাচ্ছে। গিয়ে দেখলাম কেরোসিন তেলের কুপির একটা মাত্র আলো একপাশে বসানো। আর একপাশে কাঠের জলন্ত আঙরা। ধোঁয়াহীন আগুনের শিখাহীন। তার চার পাশে বিভিন্ন বয়সী নারী পুরুষ বসে, সঙ্গে বাচ্ছা আর বাড়ির পোষা কুকুরটাও। আর মাঝে একদল নারী পুরুষ একে অপরের কাঁধে হাত দিয়ে সাঁওতালি সুরে কোরাস করে মাদলের তালে তালে নাচছে। সকলেই ছিল হাঁড়িয়ার নেশায় বুঁদ। সে সুর বিনা হাঁড়িয়াতেই আমাদের শরীরে দোলা লাগাছিল। বেশ খানিকক্ষণ পর আমরা ওখান থেকে চলে এলাম।

সেই ছন্দোময় রাত।

ফেরার পথে রাজা বলল আমার সঙ্গে এস তোমরা একটা অন্য রকম অনুভূতি পাবে। রাজার কথা অনুযায়ী আমরা বেশ কিছুটা জঙ্গলের গভীরে এগিয়া গেলাম। তার পর রাজা বলল সবাই লাইট অফ করে চুপ করে দাঁড়াও। নিস্তব্ধতা আর অন্ধকার যে এত গভীর হতে পারে তার এক বিরল অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হলাম আমরা প্রত্যেকে। আধ হাতেরও কম দূরত্বে কেউ কাউকে দেখতে পাচ্ছিলাম না। আর নিস্তব্ধটা এমনই নিজেরা নিজেদের নিঃশ্বাসের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিলাম। বেশিক্ষণ চুপ করে থাকতে পারিনি কেউ। কথা বলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।

দূরে পাহাড়ের কাছে গ্রাম।

ফিরে এসে আর এক মজা, এখানেও সকলের হাতেই মোবাইল সেই সকাল থেকেই দেখতে পাচ্ছি। স্মার্টফোনও আছে বেশ কিছু জনের হাতে। কিন্তু নেটওয়ার্ক কোথায় যে, কথা বলবে? আমরা তো পাচ্ছি না আমাদের ফোনে। সেই কথা হোটেলের কয়েকজনকে বলতে, একটি মেয়ে আমাদের নিয়ে গেল একটি প্রপিতামহের আমলের গাছের নিচে। এত মোটা সে গাছ আমরা চার পাঁচ জনেও ধরতে পারব না। সেখানে গিয়ে দেখলাম অনেকেই সেখানে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। এবং আমাদের মোবাইলেও নেটওয়ার্কের দেখা পেলাম। রাত্রিরে খাওয়ার সময় ঠিক হল পর দিন আমরা সকাল পাঁচটার মধ্যে এখান থেকে বেরিয়ে পড়ব জঙ্গলের বাকি দিক দেখতে…।

ছবি- লেখক

(চলবে)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *