বিশেষ ভ্রমণ ভিনদেশি ভ্রমণ

কাউচ সারফিং, ক্রেজি বাইকার্স আর দ্য আমস্তারদাম

মঞ্জুশ্রী মণ্ডল

শীতের শেষে ঘুরতে যাওয়া, পোল্যান্ড থেকে হল্যান্ড। শীতটা তখন কম এমন নয়, তুষারপাত বন্ধ হয়েছে ঠিকই কিন্তু ঠান্ডা হিমেল উত্তুরে হওয়ার প্রভাব এতটুকু কম হয়নি। কিন্তু একে ছুটি আর তা্র ওপর বিদেশ বলে কথা, মনটা বলে উঠল ঠান্ডা তো বারবার আসবে কিন্তু আবার কি এভাবে হল্যান্ড দেখতে মিলবে? তাই এবারের মতো বেরিয়ে পড়া যাক।

আমরা উজ শহর থেকে বেরিয়ে পড়লাম, আমি আর আমার সঙ্গে সাউথ আমেরিকান বান্ধবী। পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশ এর মদলিন এয়ারপোর্ট থেকে প্লেনে চড়ে সোজা ব্রুসেলের চারলেরই এয়ারপোর্টে। যখন প্লেন ল্যান্ড করল তখন রাত আটটা মতো বাজে।

আমস্তারদাম সেন্ট্রাল রেলস্টেশন।

অল্প কিছু ডিনার সেরে নিলাম সেখানেই। এবারে বাসে করে ব্রুসেল সাউথ রেল স্টেশনে যাওয়ার পালা। সেখান থেকে হল্যান্ডটাও ঘুরে দেখে তারপর ফেরা যাবে এই মনোবাসনা নিয়ে আমরা ব্রুসেলের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। কিন্তু যখন স্টেশনে পৌঁছলাম তখন আবহাওয়া খারাপ হয়ে গেছে। আবার ঠান্ডা কনকনে হিমেল হওয়া, হালকা বৃষ্টি। সঙ্গে তুষারপাত, খুব ছোট একটা আধটা দোকান খোলা। রাস্তায় পর্যাপ্ত আলো থাকলেও এরকম আবহাওয়ায় সেটা যথেষ্ট নয়। ট্যাক্সি পরিষেবা আপাতত বন্ধ। শেষে নিজেদের মাথার সব পরিকল্পনাকে তুলে রেখে সোজা বাসে করে হল্যান্ড। মনে মনে ভাবনা একটাই, ঠাকুর যেন হল্যান্ডের আবহাওয়া ভাল থাকে।

আনা ফ্রাঙ্ক মিউজিয়ামের সামনে বান্ধবী।

বাসে উঠে বাইরে ঠান্ডা থেকে রেহাই পেয়ে খুব শান্তি পেলাম যেন। সেদিন বাসে খুব সহজেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম আমরা দু’জনেই। পরের দিন সকালে বাস যখন হল্যান্ড ঢুকব ঢুকব করছে তখন ঘুম ভাঙল। চারিদিক আলোয় ঝলমল করছে। সুন্দর স্নিগ্ধ আকাশ আমাদের সব ক্লান্তি আর ভাবনা মুছে দিল। আমার সঙ্গীটি বলে উঠল ‘হি সেভ আস অ্যান্ড আওয়ার ট্রিপ টু’। আমি নিজেরই অজান্তে হেসে ফেল্লাম। মনে মনে বললাম ইন্ডিয়া হোক কী উত্তর আমেরিকা, মানুষ মাত্রেই এক। মাঝে মাঝে দু’টো একটা পরিযায়ী পাখির ঝাঁক উড়ে যাচ্ছে। এক দঙ্গল সি-হক তীক্ষ্ণ স্বরে কলরব করতে করতে উড়ে গেল। গাছে গাছে নতুন পাতা কোনটা সবুজ, কোনটা গেরুয়া, কোনটা্ লাল। হলুদ ড্যাফোডিল ফুল ফুটে আছে এখানে ওখানে। লাল, হলুদ, ভায়ওলেট, সাদা, নানান রঙের টিউলিপ ফুলের সমারোহ। এই সব দেখতে দেখতে আমরা পৌঁছেগেলাম গন্তব্যস্থল আমস্তারদাম সেন্ট্রালে।

আনা ফ্রাঙ্ক মিউজিয়াম।

সব কিছু ছবির মতো রঙিন, সুন্দর করে সাজানো, নোংরা অপরিষ্কার বলে কিছু চোখে পড়ল না। এখানে কাকের দেখা মেলে না, পাখি বলতে, পায়রা, মধু খাওয়া পাখি, সি-হ্ক আর জলের খোঁজে আসা পরিযায়ী পাখির দল। আমাদের এখানে দেখতে পাওয়া ফিঙে পাখির মতো কোনও একটা পাখি।

এই ঘুরতে যাওয়ার সময় বাস আর প্লেনের টিকিট কাটার দায়িত্ব ছিল আমার। আর থাকার জায়গা ঠিক করার দায়িত্ব ছিল আমার বান্ধবীটির। এখানেও একটা নতুন অভিজ্ঞতা অপেক্ষা করছিল আমার জন্য। ‘কাউচ সারফিং’। অনেকেই হয়তো এই শব্দটার সঙ্গে পরিচিত। অন্তত যাঁরা বিদেশে ঘুরে বেড়ান তাঁদের কাছে তো বটেই। এটা একটা বড় গ্রুপ। পুরো ইউরোপ জুড়েই আছে। শুধু ইউরোপ কেন তার বাইরেও আরও বিভিন্নি জায়গায় এর প্রচলন আছে। আমাদের খোদ কলকাতা শহরেও এমন অনেক ফ্যামিলি আছে যারা এই গ্রুপের সদস্য। অচেনা-আজানা ফ্যামিলির আতিথেয়তায় থাকা, তাঁদের সঙ্গে সময় কাটানো, তাদের জীবন আর সংস্কৃতিকে খুব কাছ থেকে দেখা ও জানার সুযোগ ঘটে। এটার জন্য টাকা খুব বেশি লাগে এমন নয়। সৌজন্যবশত অতিথি তাঁর আশ্রয়দাতাকে উপহার দেন। আমরা এ রকম একটা পরিবারের সঙ্গে সময় কাটিয়েছিলাম। আর এটা সম্ভব হয়েছিল আমার এই বান্ধবীটির দাক্ষিণ্যে।

হিডেন চার্চ।

আমস্তারদাম সেন্ট্রালে নেমে বিখ্যাত ড্যাম স্কোয়ার, আনা ফ্রাঙ্ক হাউস, সাইটসিয়িং ক্রুজ, মাদাম তুসোর মোমের মিউজিয়াম, দ্য বিগেইনহফ (The Begijnhof), বিখ্যাত টিউলিপ গার্ডেন, উইন্ড মিল এই সব উল্লেখযোগ্য। এখানে গাইড প্রতিদিন সকালে, দুপুরে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পর্যটকদের উল্লেখযোগ্য স্থানগুলো ঘুরিয়ে দেখান। তার পরিবর্তে লোকজনেরা খুশি হয়ে তাঁদের কিছু অর্থ দেন। অনেকেই এটা আংশিক সময়ের কাজের মতো করে।

আমস্তারদাম সলটারডিক।

ড্যাম স্কোয়ারের বিবরণ লিখতে গিয়ে একটুখানি পিছন ফিরে দেখে এর ইতিহাসটা না বললে অসম্পূর্ণ রয়ে যায়। এটি আমস্তারদাম সেন্ট্রালে অবস্থিত, অ্যামস্টেল (Amstel) নদীর ওপর নির্মিত প্রথম ব্রি্জ। এই নদীর নামে এই জায়গার নাম আমস্তারদাম, হল্যান্ডের বর্তমান রাজধানী। অতীতে জলপথে ব্যবসা ছিল পণ্য পরিবহণের সহজ উপায়। পুরো শহরে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি করতে শহরটায় এভাবে ব্রি্জ নির্মাণ করা হয় ক্রমে ক্রমে। এই শহর মধ্যমণিতে থাকার কারণে এখান থেকে সমগ্র হল্যান্ডে চালনা করাটাও সহজ হতো। এখানে মাঝে মাঝে মেলা বসে বছরে বিভিন্ন সময়। অনেক রকমের raids এখানে দেখতে পাওয়া যায়। রকমারি কেক, বিস্কুট, আইসক্রিম, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই পাওয়া যায় এখানে। হরর হাউসও থাকে ছোটদের মনোরঞ্জনের জন্য।

জলের পাখি।

কফি শপের কথা বলি। আমরা সবাই জানি। কিন্তু এখানেও একটা ছোট্ট গল্প আছে। এখানে কফি শপে গাঁজা পাওয়া যায়। নেশার মাত্রা অনুযায়ী এর মূল্য নির্ধারণ হয়। গাঁজা টানাটা এখানে অন্যায় নয়। কিন্তু গাঁজা টেনে অন্যকে বিরক্ত করাটা দণ্ডনীয় অপরাধ। শাস্তিস্বরূপ জরিমানা-সহ জেল হতে পারে। এখানে মানা হয়, বাচ্চাদের যেটা করতে নিষেধ করা হয় সেটার প্রতি তাদের কৌতূহলটা বেশি হয়। তাই যাদের নেশা করতে ইচ্ছে তারা বাইরে কোথাও থেকে বেআইনি ভাবে গাঁজা আমদানি করার প্রয়োজন হয় না।

কফি হাউস।

আনা ফ্রাঙ্ক হাউস। বিখ্যাত ডায়েরি লেখিকা অ্যানা ফ্রাঙ্কের বাসস্থান এবং মিউজিয়াম। তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১২ই জানুয়ারি, ১৯২৯ সালে জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরে। তাঁর ডায়েরি থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অনেক তথ্য জানা যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসিদের অত্যাচারের কাহিনী তাঁর ডায়েরিতে পাওয়া যায়। ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৫ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। তাঁর জীবন কাহিনী, ডায়েরি এই সংগ্রহশালায় সযত্নে রক্ষিত আছে।

মনোরম গির্জা।

মাদাম তুসোর মোমের মিউজিয়াম। মোম দিয়ে তৈরি বিভিন্ন বিখ্যাত মানুষজনের মূর্তি। এই মিউজিয়াম মহাত্মা গান্ধী, দলাই লামা, আইনস্টাইন-সহ অনেক বিখ্যাত মানুষদের মূর্তির দর্শন মেলে। বিখ্যাত কমিকস চরিত্র স্পাইডারম্যানের মোমের পুতুল দেখা যায়। হলিউডের অভিনেত্রী মেরিলিন মনরো, অ্যাঞ্জেলিনা জোলির মোমের মূর্তির নজর কাড়া সৌন্দর্য লক্ষ্য করার মতো। মোমের মূর্তি তৈরি করার ক্রিয়া কৌশল মুগ্ধ করেছিল আমাদের। বুঝলাম সুন্দর কিছু তৈরি করতে অনেক পরিশ্রম, অনেক ধৈর্যের প্রয়োজন হয়।

সাইটসিয়িং ক্রুজ। সারা শহরটা ব্রিজ আর ক্যানাল দিয়ে সাজানো। তাই জলপথে ক্রুজে ভ্রমণ অত্যন্ত জনপ্রিয় চিত্ত বিনোদনের জায়গা। এখানে আরও উল্লেখযোগ্য, একটা জিনিস হল ক্রেজি বাইকার্স। এখানে সাইকেলের চলটা অত্যন্ত বেশি। হয়তো বা গাড়ির থেকেও। রাস্তা পেরুতে হলে সব থেকে বেশি সাবধানে থাকতে হয় ক্রেজি বাইকার্সদের থেকে।

ক্যানাল আর সেতুর শহর।

দ্য হিডেন চার্চ। এখানে খ্রিস্টান ক্যাথলিক হল সংখ্যা গরিষ্ঠ সম্প্রদায়। কিন্তু নাৎসি আইন চলাকালীন সময়ে এই সম্প্রদায়ের মানুষ নিজেদের ধর্মাচার রক্ষা করার জন্য গোপনে চার্চ তৈরি করে। যেগুলো বাইরে থেকে সাধারণ বাড়ির মতোই দেখতে। কিন্তু বাড়ির ভেতরটা এক্কেবারে চার্চের আদলে তৈরি। এই চার্চগুলি এখন ধর্মস্থান হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।

দ্য বিগেইনহফ। কথিত আছে, এগুলি আমস্তারদামের সবথেক পুরনো বাড়িগুলির মধ্যে অন্যতম, ১৩৮৯ সালে তৈরি। একান্ততা বজায় রাখার জন্য একটি মাত্র প্রবেশ পথ নির্মিত হয়েছিল, কিন্তু এর সম্পরকে বিশেষ কোন ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যায় না।

দ্য ফেমাস টিউলিপ গার্ডেন। টিউলিপ বাগান এখানে আগত মানুষদের কাছে অন্যতম আকর্ষণ। আগে সেটা রাজার পুষ্প উদ্যান ছিল কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সব বদল হয়েছে, এখন এটা সরকার পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়। এখানে রঙবেরংয়ের টিউলিপের দেখা মেলে। সাদা, লাল, বেগুনি, হলুদ, সোনালি, রকমারি রঙের সমারোহ। সবশেষে, রেড লাইট ডিস্ট্রিক্ট ঘুরে দেখার পালা। গাইড আমাদের খুব সাবধান করে বললেন, ক্যামেরা এক্কেবারে বার করা চলবে না। মাথা নিচু করে যাওয়া আর আসা, আমার কাছে এই অনেক। কখনও সচক্ষে দেখার সুযোগ ঘটেনি, শুধু বইতে পড়েছি মাত্র। এটাও আমার কাছে নতুন অভিজ্ঞতা। এবারে ফেরার পালা।

বাইক আর বোটের শহর।

অনেক সুন্দর সুন্দর স্মৃতি মনের মণিকোঠাই তুলে রেখে এবার আমাদের ঘরে ফেরা। বিগত দুটো দিন যাঁদের সঙ্গে কাটাচ্ছিলাম তাঁদের থেকে বিদায় নিয়ে আমরা সলটারডিক থেকে বাসে করে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।

ছবি- লেখিকা

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *