পাহাড়িয়া বাঁশি বিশেষ ভ্রমণ

শিলং ছুঁয়ে, মেঘের বাড়ি আড়ি–ভাব

শ্রেয়সী সেনশর্মা

শীতকাল এলেই আমি সারা সকাল বাড়ির পড়ন্ত রোদের বন্ধুতা ছাড়তাম না। তেমনি গাছে চড়তে ভালবাসতাম। এককথায় পুরা গেছো। এইজন্যই হয়তো ৫ বছরের জন্য গাছপালা বগলদাবা করার পাশাপাশি ঢুঁ মেরে আরও গেছো ভূত হওয়ার সুযোগ পেলুম। আমাদের সমাজে প্রচুর সমস্যা, তার মধ্যে অন্যতম একটা মাইয়ামানষের একেলা ঘুরতে যাওয়া। শুনলেই লোকে হাই হাই করে ওঠে। গাইড মশায়ের তাড়নাতেই কাজে শিলং যেতে হবে। ধরে নিয়ে টিকিট কাটানো গেল। ও হরি, যে মামণি টিকিট কাটলেন, উনি যাওয়াটি ক্যানসেল করলেন। “একলা চল” বলে বেরিয়ে পড়লাম। আমার দূরপাল্লার ট্রেন চড়ে বঙ্গের বাইরে যাওয়া এই প্রথম, কোথাও যাইনি, পুরীও না। মূলত বোনের উৎসাহে চললুম বাক্স, প্যাঁটরা গুছিয়ে।

শিলং পাহাড়।

বন্ধু ট্রেনে উঠিয়ে বাক্স বেঁধে সাবধান করে চলে গেল। স্লিপার ক্লাসের সবচেয়ে উপরের বার্থে সিট, দেখে ঢোক গিললাম বার কয়েক, কারণ উচ্চতা আমার মাথা ঘুরিয়ে দেয়, যা হোক করে ওঠা হল। আমার আশেপাশে এক ফ্যামিলি। বেশ বাচ্ছা কাচ্ছা, বউমা শাশুড়ি ওয়ালা, ভরভরন্ত। তারাও ওরম চোখ কপালে তুলল, একা?। জানলা দেখছি রাতের অন্ধকারে, কেমন করে সরাইঘাট চলছে হেলায় একেকটা ইস্টিশান কে পিছে ফেলে।

মেঘের খাসতালুক।

সকাল হতেই চির হাঁকপাকানো মন আমার, দেখছি মন ভরে চুনাপাথরের পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে হলুদ আলো ঝিকমিকাচ্ছে, দূরে সারি সারি গুরুগম্ভীর শৈলশ্রেণী। গুয়াহাটি নেমে ট্যাক্সি ভাড়া করলাম। তিন খান মালপত্তর বওয়া যে ককী দুষ্কর। ঘণ্টা তিনেক যাত্রাপথে বিবাগী মন যা সঞ্চয় করল, মনে হচ্ছিল মন তোতা কেউ আকাশে উড়িয়ে দিয়েছে। গুয়াহাটির ঝাঁ চকচকে দোকান পাট পেরিয়ে, ধুলো উড়িয়ে খাসি পাহাড়ের দিকে গাড়ি চলল। পাহাড়, পাহাড় খালি, চারিদিকে, সঙ্গে মাঝে মাঝে ধাপে ধাপে অসম্ভব সুন্দর বাড়ি। আর তার সঙ্গে মনোরম ধাপগুলি।পথের ধারে আচারের সম্ভার নিয়ে বসা খাসি মহিলারা, বা আনারসের কারবারিরা হাসিমুখে।

শিলং ক্যাথিড্রাল।

পরিষ্কার হাইওয়ে, মাঝে দাঁড়িয়ে বেশ দু’হাত তুলে বলা যায়, “আমি আছি, খুব বাঁচব এই পাহাড়ের ধাপে, কেউ নেই এই বেশ”। এক ধাবাতে পেটপুরে খেয়ে গাড়ি চলল আবার পথে। ওই নিজের মনে বক বক করা মন বলছে ‘পিছুটান নেই , কেউ নেই, আর ঘরে না ফিরলেই হয়।’ গেস্টহাউস, কাজ এসব নিয়ে নাই বা আর ঘ্যান ঘ্যান করলাম।

নিঝুম অরণ্য।

১৪ দিনের যাপনে কাজটাই বেশি ছিল, তা-ও পাইন বনের শিরশিরানি হাওয়াতে পাইন কোনও দিব্য কুড়িয়েছি। সকাল সকাল ছাদ আর আমি একটা বহু পুরানো সম্পক্ক , অবশ্য সন্ধ্যের ছাদ ও ভালো বন্ধু আমার। এক রবিবার দেখে প্রেম আঙ্কেলের (খুব ভাল ড্রাইভারকাকু) গাড়ি, আর সারা শিলং শহর আর আমার থুড়ি আপিসের ক্যামেরা বগলদাবা করে হুট বলে বেড়িয়ে পড়লাম। প্রথম গন্তব্য ছিল শিলং ক্যাথলিক চার্চ। দিন রবিবার, উতরাই বেয়ে ‘জয়ন্তিয়া শাড়ি’ পরা সুবেশা নারীকুল, হলের ভিতরে গম্ভীর উচ্চারণ। ভিনদেশি সাহেব মেমরা চার্চ প্রান্তরে ভিড় জমাচ্ছে, কোথাও ওই ‘জয়নগরের মোয়া খা’ শব্দ কানে আসছে। বাঙালির চার্চ প্রীতি আবার সর্বজনবিদিত। সামনে এক খান ফুল টুকটুকে স্মার্ট চেরি গাছ। সবমিলিয়ে মন ভাল করা দিনের শুরু। বকবকানি আমি আমার ভাঙা হিন্দি দিয়ে আঙ্কেলের সঙ্গে বকবক শুরু করলাম। শুনছিলাম এক অর্ধশিক্ষিত খাসি ড্রাইভার বলে চলেছে সর্বধর্ম সমন্বয় এর মূল সুর, বলছে স্বামী বিবেকানন্দের ভেদাভেদ ঘুচানোর মন্ত্র। শুনছিলাম আর ভাবছিলাম এরাই তো সাধারণ মানুষ, এদের মত করে ভাবতে তো পারে দেশনায়কেরা। এরপর শিলং পিক।

সমাধি ক্ষেত্র।

অপেক্ষমান আমি গাড়িতে বসে বসে শুনছি ‘এই তো লুচি তরকারি পেয়েছি, খেয়ে নি’(বাঙালির লুচি পেরেম)। মিলিটারিদের কড়াকড়ি পেরিয়ে আসলাম শিলং পাহাড়ে, যেখান থেকে সারা শহর হাসি মুখে। টেলিস্কোপে চোখ, মন সেলফিতে, টাকা ব্যস্ত খাসি পুরুষ সাজতে। কেউ দেখছে না , দূরে ঘুমিয়ে এক এক অখণ্ড যোগী পুরুষ, হালকা আবছা, যিনি সবাই কে দেখা দেন না, কেবল কিছু বোহেমিয়ানদের চোখে পড়ে এসব হয়তো। এরপর Mawphlang sacred grove। ধূ ধূ মাঠ, লোকাল গাইডের সাহায্য ছাড়া বনে ঢোকা যাবে না, গাছপালায় হাত বোলানো নিষিদ্ধ। প্রান্তরে একা দাঁড়িয়ে, মনে হচ্ছিল কোলকাতায় কেউ আমার জন্য অপেক্ষায় নেই, ঘন বন, আদিম পাথর হাতছানি দেবে আমি ছুটে চলে যাব। যেন আমার জন্য সম্পূর্ণ পুরুষ অপেক্ষায় যুগের ওপার হতে। ছটফটানো পাখিটাকে উড়িয়ে দিয়ে এসেছি, বলেছি ‘আবার আসব কেবল তোমাতে ধরা দিতে’।

কলসপত্রী।

বাউন্ডুলের কম্বল গায়ে জড়িয়ে নেক্সট এলিফান্ট্যা ফলস। তিন ধাপ, তিন রকম জলের শব্দ, তিন রকম বন। ভীষণ রকম চটক সুন্দরী এরা, ততোধিক এরা প্রচণ্ড রকম বুনো। বরং বলা যায় খাসি ফর্সা না, সাঁওতাল কালো। এরপর গাড়ি ছুটল শিলং শহরের ‘wards lake’ এর দিকে। ১০০ বছরেরও পুরনো এই লেক জুড়ে গোলাপি চেরি গাছ, রাজহাঁসের রোদ পোহানো দল, ইতি উতি প্রেমিক প্রেমিকা জুটি সব মিলে বেশ বিদেশ বিদেশ গন্ধ। এছাড়াও পোলো মাঠ, পুলিশ বাজারের রঙ্গিন পসরা সাজানো আলোঝলমলে বিকিকিনি। এক বিকেলে এক দিদির সাথে ভুটানি সোয়েটার কিনতে বেড়িয়ে ক্রমশ অনেকটা গিয়ে ভিতরে গিয়ে ওই সুপুরি কারবারিরা, অন্ধ গলির শূকর বেচা ব্যাপারিদের অবাক চোখ বোঝাচ্ছিল শহরের ওই বিন মেকাপ হিন চামড়াও কত সত্যি ওই জরিদার পশমি জুতোগুলোর চেয়েও, যার সঙ্গে কোনও মিল নেই ওই পাহাড় বেয়ে নামা কেতাদুরস্ত সম্ভাব্য Miss shillong দের।

শিলং মুগ্ধ এক পর্যটক

গত বছর রাস পুন্নিমের চাঁদ দেখেছিলাম পারুল্যের রুক্ষ প্রান্তর থেকে, এবার ও দেখছি রাসের থালা চাঁদ, মেঘের হাত ছোঁয়ানো হাসাহাসি ,শীত কাঁপানো পাইন বনে, হিমেল হাওয়ার ঠিক উপরে, নিচে দেওয়ালির মত সাজানো শহর। ওই ঢালু নিঃশব্দ ছাদে কেউ নেই, নেই শব্দ, কেবল শব্দ ভূতের রাজার রিংটোন।

ফিরে চললাম সমতলে উমিয়াম লেকের সাথে। ঠিক জানি আবার ফিরবো ওই পথে, ফিরতে হবেই আমায়, রক্তে যে ওই বুনো পাহাড়িয়া ভালোবাসার বীজ পুঁতে এসেছি।

(সমাপ্ত)

2 thoughts on “শিলং ছুঁয়ে, মেঘের বাড়ি আড়ি–ভাব

  1. খুবই সুন্দর বর্ণনা। লেখিকার পর্যটকীয় ছবিটিও (নিজস্বী) অসাধারণ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *