ইতিহাস ছুঁয়ে বিশেষ ভ্রমণ

অবশেষে গড় মান্দারণ

দীপক দাস

চেষ্টা করা হয়েছিল বহুবার। কিন্তু নাগালের বাইরের থেকে গিয়েছিল গড় মান্দারণ। অথচ ভূমিকাটুমিকা সব তৈরি। সেই বঙ্কিমচন্দ্রের ‘দুর্গেশনন্দিনী’ টুকলি ‘৯৯৭ বঙ্গাব্দের নিদাঘশেষে একদিন একজন অশ্বারোহী পুরুষ বিষ্ণুপুর হইতে মান্দারণের পথে একাকী গমন করিতেছিলেন’। শুধু ৯৯৭ বঙ্গাব্দ স্থলে হইবে ১৪২৫ বঙ্গাব্দ। আর একাকী অশ্বারোহী নয়। তিন বাইকে ছয় আরোহী। কিন্তু ভূমিকার পরে উপসংহারে আর পৌঁছনো হয়নি।

জঙ্গলপথে।

অবশেষে ইচ্ছেপূরণ। নিদাঘ নয় প্রবল শৈত্যর কালে দলবল নিয়ে পৌঁছনো গেল গড় মান্দারণ। বাসে। খান চল্লিশের দল। আমরা ‘যথা ইচ্ছা তথা যা’ গ্রুপ থেকে প্রতি বছরই বনভোজনে বেরোই। কিন্তু ইতিহাস সফর খুব একটা হয় না। একবার আমতায় দামোদরের তীরে বনভোজন হয়েছিল। সেবার সকলকে গাড়িতে তুলে আমি আর ইন্দ্র ঘুরে এসেছিলাম ছোট কলকাতায়। হাওড়াতেও একটা কলকাতা আছে, শুনেছিলাম।। কাছাকাছি এসে একবার দেখে নিয়েছিলাম। এ বছর গড় মান্দারণ।

চরে চরা।

কী দেখলাম বঙ্কিমী জনপদটিকে? মাথা পিছু ১৫ টাকা দিয়ে টিকিট কেটে পাঁচিল দিয়ে ঘেরা গড় চত্বরে ঢুকলাম। সেখানে খালি মাথা আর মাথা। বড়দিনের খুশিতে পিল পিল করে লোক এসে হাজির। হরেক কিসিমের লোকজন। স্কুলের বাচ্চা, সাহিত্য পত্রিকা, ছোট পরিবার, বন্ধুদের নিয়ে হুল্লোড় পার্টি। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে দোকানদানি। কাগজের হাওয়াকল, পানের পসরা, চপের দোকান, চানাচুর, ছোলা মটর, হাতে মেহেন্দি ছাপানোর লোকজন। মেলা আর কাকে বলে।

ইহাই কি আমোদরের চিহ্ন!

আমাদের দলটা চিরকালই নির্জনতা প্রিয়। এত লোক দেখে প্রথমে একটু ঘাবড়েই গিয়েছিলাম। পরে ধাতস্থ হয়ে ঘোরা শুরু হল। যে যার সুবিধে মতো দল করে নিয়ে আলাদা হয়ে গেল। আমরা বর্ষীয়ান সদস্যদের নিয়ে দল পাকালাম। দীপু, বাবলা, চিনি, প্যাটিশ, তুহিন, ইন্দ্র, আমি, আমার মেজো সহোদর আর জয়ন্তীদি। দলকে দল পিননিক পার্টিকে পাশ কাটিয়ে ঘুরে দেখা। এলাকায় প্রচুর গাছপালা। ঝোপঝাড়। দলগুলো গাছের ফাঁকে ফাঁকে বসে পড়েছে। এখানে প্রকৃতি দেখার কিছু নেই তেমন। তাই হাঁটতে হাঁটতে তাই পিননিক পার্টির রান্না দেখছিলাম। কত রকম যে মাংস রান্না দেখলাম। কোনও একেবারে বাড়ির রোজকারের রান্নার মতো। কড়াই ভর্তি কালচে ঝোল। মাংস আর আলুর ফাঁকে সেই ঝোল আগ্নেয়গিরির লাভার মতো বগবগিয়ে নাচছে। আরেক জায়গায় কষে কষা চলছে। বোঝাই যাচ্ছে এর রেসিপি অনেক কসরত করে আয়ত্ত করা। কোথাও আবার মাংস ঝোল ঝোল। কিন্তু সেটা লালচে। বাবলারা এক জায়গায় অদ্ভুত মাংস রান্না দেখেছে। ওই দলটা মাংসগুলোকে কেমন ভাবে যেন কেটেছিল। কেমন ভাবে সেটা আর স্পষ্ট বর্ণনা করতে পারেনি। আরও দেখেছি, কোনও কোনও দল সেই দুপুর বারোটাতেই বোতলের ছিপি খুলে ফেলেছে। পকোড়া, মাংস কষার টাকনা দিয়ে খাওয়া চলছে। তবে হল্লাগুল্লা নেই। গোঘাট থানা এখানে প্রচুর পুলিশ দিয়েছে। খাকি পোশাক দেখে হল্লা কম।

গড়াভিমুখী।

ঘুরতে ঘুরতে এক সময়ে পথ শেষ হয়ে গেল। ঢিপির রাস্তার পাশে একটা জলাশয় মতো আছে। বিশাল এলাকা তার। কিন্তু অনেকটা অংশেই চড়া পড়ে গিয়েছে। সেই চর দিয়ে লোকজন যাতায়াত করছে। কিন্তু গড়টা কোথায়? খাকি পোশাকেই জিজ্ঞাসা করা গেল। তারপর চরে নেমে পড়া। চরেই দেখা হয়ে গেল বাকিদের সঙ্গে। একটানা ফটোসেশনের পরে গড়ের দিকে হাঁটা।

গড় মানে একটা ঢিপি মতো অঞ্চল। গাছপালা আছে। উঠে দেখা গেল বাগানও রয়েছে। একটা ঘেরা জায়গায় খরগোশও। পাশে একটা দরগা। একটা অংশে দোলনা, স্লিপার আর নানা রকম উপকরণে ঠেসে পার্ক মতো বানানো হয়েছে। ঢিপির চুড়োয় একটা দরগা রয়েছে। কিন্তু গড় নেই।

খাওয়াদাওয়া শেষে এক খাকি পোশাককেই জিজ্ঞাসা গেল। তিনি বললেন, ওই ঢিপির নীচেই একটা দরজা ছিল। এক সুড়ঙ্গ মতো ছিল। সেই সুড়ঙ্গ নাকি কিছু দূরে গিয়ে এক মন্দিরে উঠেছে। সুড়ঙ্গ দিয়ে রাজা পুজো দিতে যেতেন। এই সুড়ঙ্গের গল্প আমরা বহু জায়গায় শুনেছি। রাজবাড়ি থাকলেই একটা সুড়ঙ্গ জুড়ে দেওয়া হয়। পুলিশটি জানালেন, সেই সুড়ঙ্গ এখন বুজিয়ে দেওয়া হয়েছে। আর যে চর দিয়ে আমরা হেঁটে এলাম সেটা নাকি দুর্গের চারপাশের পরিখা।

গড়ের বাইরের দিকে।

গড় মান্দারণ তার অতীত গৌরব বহুদিনই হারিয়েছে। আসলে সেই হারানোটা বঙ্কিমচন্দ্রের কালের আগেই। ‘দুর্গেশনন্দিনী’তে বঙ্কিম সেটা লিখেও গিয়েছেন। উপন্যাসের পঞ্চম পরিচ্ছদটা একটু পড়ে নেওয়া যাক— ‘যে পথে বিষ্ণুপুর প্রদেশ হইতে জগৎসিংহ জাহানাবাদে প্রত্যাগমন করিয়াছিলেন, সেই পথের চিহ্ন অদ্যাপি বর্ত্তমান আছে। তাহার কিঞ্চিৎ দক্ষিণে মান্দারণ গ্রাম। মান্দারণ এক্ষণে ক্ষুদ্র গ্রাম, কিন্তু তৎকালে ইহা সৌষ্ঠবশালী নগর ছিল। যে রমণীদিগের সহিত জগৎসিংহের মন্দিরমধ্যে সাক্ষাৎ হয়, তাঁহারা মন্দির হইতে যাত্রা করিয়া এই গ্রামাভিমুখে গমন করেন।

গড়-মান্দারণে কয়েকটি প্রাচীন দুর্গ ছিল, এই জন্যই তাহার নাম গড়-মান্দারণ হইয়া থাকিবে। নগর-মধ্যে আমোদর নদী প্রবাহিত; এক-স্থানে নদীর গতি এতাদৃশ বক্রতা প্রাপ্ত হইয়াছিল যে, তদ্দ্বারা পার্শ্বস্থ এক খণ্ড ত্রিকোণ ভূমির দুই দিক্ বেষ্টিত হইয়াছিল; তৃতীয় দিকে মানবহস্ত-নিখাত এক গড় ছিল; এই ত্রিকোণ ভূমিখণ্ডের অগ্রদেশে যথায় নদীর বক্রগতি আরম্ভ হইয়াছে, তথায় এক বৃহৎ দুর্গ জল হইতে আকাশ-পথে উত্থান করিয়া বিরাজমান ছিল। অট্টালিকা আমূলশিরঃ কৃষ্ণপ্রস্তর-নির্ম্মিত; দুইদিকে প্রবল নদী-প্রবাহ দুর্গমূল প্রহত করিত। অদ্যাপি পর্য্টক গড়-মান্দারণ গ্রামে এই আয়াসলঙ্ঘ্য দুর্গের বিশাল স্তূপ দেখিতে পাইবেন। দুর্গের নিম্নভাগমাত্র এক্ষণে বর্ত্তমান আছে; অট্টালিকা কালের করাল স্পর্শে ধূলিরাশি হইয়া গিয়াছে; তদুপরি তিন্তিড়ী, মাধবী প্রভৃতি বৃক্ষ ও লতা সকল কাননাকারে বহুদূর ভুজঙ্গ-ভল্লুকাদি হিংস্র পশুগণকে আশ্রয় দিতেছে। নদীপারে অপর কয়েকটা দুর্গ ছিল’।

পাশের গ্রামের মাঠে।

বঙ্কিমচন্দ্র গড় মান্দারণকে নগর বলেছেন। এবং নগরের মধ্যে দিয়ে একটি নদী প্রবাহিত হত বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু সেই নদী এখন কোথায়? জলাশয়ের যে চর দিয়ে আমরা হেঁটে এলাম সেটাই আমোদর নয় তো? পুলিশটি বলছিলেন, বর্ষাকালে ওই চর জলে ভরে যায়। আমরা যেখানে বাস রেখেছিলাম সেই জায়গাটাও জলে ভরে যায়।

আমোদর নদী এখনও রয়েছে। এবং গোঘাটের বন্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। নেই শুধু গড় মান্দারণের গড়।

ছবি- দীপশেখর দাস

সমাপ্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *