পাহাড়িয়া বাঁশি বিশেষ ভ্রমণ

ও মেঘ, সামলে রাখো…

দীপক মহারানা

 

কথায় আছে বামুন গেল ঘর, চাষ লাঙল তুলে ধর।

না, কাজে ফাঁকি নৈব নৈব চ। তবে হাজারো ব্যস্ততার মাঝে একটু ফুরসত মিললেই মনের ভাবখানা এমন, ‘কাঁধে ঝোলা, চলল ভোলা’।

কিন্তু জিজ্ঞাসু মনের প্রশ্নের যেন শেষ নেই! সে জানতে চায় কোথায়?

কেন, যেখানে চেনা মুখ তোমায় খুঁজবে না। চেনা-পরিচিতের গণ্ডী ছাড়িয়ে দূরে কোথাও। হোক না সে অরণ্যের গাছ-গাছালির কোলে। কিংবা নীলচে মেঘের আঙিনায়।

কানে ফিস ফিস করে জানিয়ে দিল মন, চল না কোনও মেঘের দেশে। তার নাকি ডাক এসেছে মেঘালয় সুন্দরীর কাছ থেকে। অতএব, বাঁধো তল্পিতল্পা, ছাড় ঘর। হাওড়া স্টেশনের কলকাকলি ছেড়ে ট্রেনে নিজের আসনটিতে যখন গুছিয়ে বসলাম তখন বলিছে হাতের ঘড়ি ঠিক ঠিক ঠিক, সাড়ে তিনটে। মেঘসুন্দরীর কাছে যাওয়ার প্রথম সওয়ার। দিনের সূর্য, রাতের তারা দেখে একদিন পর গুয়াহাটি। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সুন্দর প্রকৃতিকে নিজের করে পেতে হলে গুয়াহাটির বুড়ি ছুঁতে হবেই। ব্রহ্মপুত্র নদের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা শহরটা প্রথম দর্শনে খারাপ লাগল না। গুটি গুটি পায়ে এক ফাঁকে চলে গেলাম জলের ধারে। নদীর জল মাথায় ছোঁয়ালে নাকি পূণ্য হয়, নদের জলে হয় কি না জানা নেই।

ঘর বসত।

বিশাল ব্রহ্মপুত্রকে টা টা জানিয়ে সওয়ারি এ বার অটোয়। অটো আমাকে নিয়ে চলল সতীর একান্ন পীঠের একটিতে, কামাখ্যায়। পুরাণ জানিয়েছে এখানে পতিত হয়েছিল দেবীর যোনি। মন্দিরের বয়স খুব কম নয়। ১৫৬৫ সালে মন্দির স্থাপন হয়েছিল। অসমে তখন কোচ রাজাদের দাপট। কোচরাজা নরনারায়ণ এবং চিলা রায় পাহাড়ের গুহায় তৈরি করেন এই দেবী মন্দির। জনমনে বিশ্বাস দেবী জাগ্রত। দেবীর প্রধান উৎসব অম্বুবাচীর সময়, আষাঢ় মাসে। মন বলল দেবীর কাছে নত হও। দেবীকে প্রণাম জানিয়ে এ বার উঠব আরও উপরে। সেখানে যে রয়েছেন দেবী ভুবনেশ্বরী। দেবীদর্শন শেষ করে চোখ ফেরাতেই অপেক্ষা করছিল বিস্ময়।  কামাখ্যা পাহাড়ের চূড়া থেকে অতলে ব্রহ্মপুত্রের সে কী দৃশ্য!

ঘোর ভেঙে দিল অটোর ছেলেটি, ‘দাদা, এ বার নামবেন তো’। বড় তাড়া ওর, কিন্তু আমার তো নেই। তবু পা বাড়ালাম। ক্ষুণ্ণ মন ঠিক করল, আজ সে শুধু মন্দিরে মন্দিরে ঘুরবে। কামাখ্যা ছেড়ে রথ ছুটল বশিষ্ঠ পাহাড়ে। যেখানে রয়েছে মহামুনি বশিষ্ঠের আশ্রম। রয়েছেন স্বয়ং মহাকাল। সেখান থেকে এগোলাম উমানন্দে। সন্ধে নামছে। ব্রহ্মপুত্রের জলে রং লেগেছে। ব্রহ্মপুত্রের একেবারে বুকের মাঝে দাঁড়িয়ে যেন উমানন্দের সগর্ব ঘোষণা, ‘আমাকে না দেখে যাবে কোথায়’! পাহাড়ের মাথায় বসে রয়েছেন মহাদেব। গোটা পাহাড়ে সবর্ত্রই তিনি বিরাজমান। উমানন্দ থেকে ব্রহ্মপুত্রে সূর্যাস্ত না দেখলে আমার সঞ্চয়ের ভাণ্ডার পূর্ণ হত না।

কিন্তু মেঘালয় সুন্দরী সমানে হাত নাড়ছে। গুয়াহাটি থেকে চেপে পড়লাম শিলঙের বাসে। ঘণ্টা চারেকের পথ প্রকৃতির রূপটানের সৌজন্যে কেটে গেল অনায়াসে। বাস থেকে নেমে পা চলল ঠাঁই খুঁজতে। হোটেলের আরাম নিতে অপারগ পকেট। অগত্যা পা বাড়ালাম ইয়ুথ হস্টেলের দিকে। আমার একার জন্য মন্দ নয়। বরং, একটু বেশিই ভাল। সঙ্গের ঝোলাঝুলিকে জায়গামত রেখে বেরিয়ে পড়লাম মিষ্টি ঠান্ডার ছোঁয়া গায়ে মাখতে।

গবাক্ষে শৈলচূড়া দর্শনের অনুভূতি।

পাহা়ড়ে সূর্য একটু তাড়াতাড়িই মুখ লুকোয়। আনমনে হাঁটতে হাঁটতে কখন যেন চোখ চলে গিয়েছিল দূরে আঁধার নেমে আসা সারিবদ্ধ পাহাড়ে। কোলে থাকা ঘরবাড়িগুলোর আলোকবিন্দু যেন আকাশের তারাদের সঙ্গে সখ্যতা পাতিয়েছে। ভোরের কুয়াশার হাত ধরে পরদিন ফের পথে নামি। খাসি হিলসের চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে এলিফ্যান্ট, সুইট, বিশপ জলপ্রপাতগুলো। উমিয়াম লেক তো আছেই। শহর থেকে এ বার দূরে, শহর ছাড়িয়ে মন পাড়ি দিল চেরাপুঞ্জির পথে। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাতের খ্যাতি বাঁধা রয়েছে যার আঁচলে। পা রাখতে না রাখতেই শুরু হয়ে গেল মেঘ-রোদের লুকোচুরি। খেলার মাঝেই চোখ চলে গেল ওপার বাংলায়। বাংলাদেশ। প্রায় সাড়ে চার হাজার ফুট নীচে সিলেট শহর। চেরাপুঞ্জি থেকে ফেরার পথে ঢুকে পড়লাম গুহায়, মসুমাই কেভ-এ। এক টুকরো লাঠির মাথায় কাপড় জড়িয়ে তাতে তেল দিয়ে আগুন ধরিয়ে হাতে দিল গুহার মুখে দাঁড়িয়ে থাকা খাসি কিশোরীটি। গুহার নিকষ কালো অন্ধকারে ওই জ্বলন্ত লাঠিটাই অন্ধের ষষ্টি। মনে পড়ে গেল বেতালের খুলি গুহার কথা। গা ছমছমে পরিবেশ। বেশিক্ষণ থাকতে সাহসে কুললো না, কারণ সঙ্গের কয়েকজন আগেই ফিরে গিয়েছে।

নীচে নামার পালা শুরু। পথ গড়িয়ে নেমে গিয়েছে পাহাড় থেকে। মন বলতে শুরু করেছে, কী গো একবার কবির বাড়ি যাবে না! শিলঙের রূপে, ভালবাসায় বাঁধা পড়ে রবীন্দ্রনাথ এখানে তৈরি করেছিলেন ছোট্ট কটেজ। চলে আসতেন মাঝেমধ্যেই। সেই অবসরের ফাঁকেই তাঁর কলম উপহার দিয়েছিল ‘রক্তকরবী’। লিখেছিলেন ‘শিলঙের চিঠি’।

পথের পাশে জীবন।

ওহ, একটা তথ্য দেওয়া দরকার। মেঘালয় রাজ্যটাকে দুটো হিল নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিয়েছে। একটা খাসি হিলস ও একটা গারো হিলস। খাসি হিলসের তুলনায় গারো যেন একটু বেশিই বন্য। শিলঙের অবস্থান খাসি হিলে। শিলংকে বিদায় জানিয়ে এ বার পা বাড়ালাম গারো হিলে তুরার দিকে। ভ্রমণপিপাসুদের কাছে খুব একটা পরিচিত নাম নয়। শিলঙের সুবাস অনেক দূরে ছড়িয়ে পড়লেও তুরা সেদিক থেকে অনাম্নী। তার সারা শরীরে এখনও লজ্জা না ভাঙার চিহ্ন। চেপে পড়লাম বাসে। ঘণ্টা সাতেকের বর্ণময় পথে শুধু জঙ্গল আর পাহাড়। সবুজে মুড়ে যাওয়া পাহাড়ের মাথাগুলো দেখে মনে হচ্ছিল, যেন সবুজের গালিচা পেতে কেউ অপেক্ষা করছে আমার জন্য।

ছোট্ট পাহাড়ি শহর একটু যেন গায়ে গা লাগিয়েই থাকতে ভালবাসে। শহরের বহিরঙ্গের রূপটান এড়িয়ে গহীনে ঢুকলেই সবর্গ্রাসী সবুজ। পথের মাঝে উপত্যকা, ছোট ছোট গ্রাম, চাষের খেত। কর্মব্যস্ত গারো মেয়েরা বেরিয়ে পড়েছে কাজে। শিলঙের মতো সহজে না হলেও একটা আশ্রয় জুটে গেল। হয়তো ট্যুরিস্টদের তেমন ছোঁয়া পায়নি বলেই এখনও দেহাতি ভাবটা যায়নি। হয়তো রূপের তেমন জৌলুস নেই যা টেনে আনবে ধোপদুরস্ত পর্যটকদের। কিন্তু যা রয়েছে, তাই বা কম কী! প্রকৃতির হাত ধরে পাহাড়, জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে এগোতে এগোতে হঠাৎই নজরে আসে পাহাড়ি নদী। ভুল ভাঙে একটু পরেই। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা গারো মেয়েটির হাসিতে ধরা পড়ে যায় আমার শহুরে বোকামো। ওর হাসি বুঝিয়ে দেয় ওটা নদী নয়, ঝোরা। ওর জলেই ফুলে-ফলে ওঠে চাষের খেত।

মেঘালয়ের পথে।

তুরা থেকে প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার দূরে নকরেক বায়োস্ফিয়ার রিজার্ভ ফরেস্ট। হাতি ছাড়া অন্য জন্তুও রয়েছে। আর আছে অগুন্তি পাখি। যার অনেকেরই নাম জানা নেই। এখান থেকে পা বাড়াই চার কিলোমিটার দূরে সিজি অভয়ারণ্যে। সিমসাং নদীকে ছুঁয়ে থাকা এই অরণ্যে দেখা হল আগর গাছের সঙ্গে। এর থেকেই তৈরি হয় আতর, সুগন্ধী তেল। দেখা পেলাম ছোটবেলায় বিজ্ঞান বইতে পড়া কলস উদ্ভিদের। সিজু ছেড়ে আবার পা বাড়াই জঙ্গলের পথে। এ বার যাব বালফাক্রাম ন্যাশনাল পার্ক। পার্কে ঢোকার মুখ মহাদেও। ফরেস্ট রেস্ট হাউসও এখানেই। তবে আমার মতো ভবঘুরের দরকার হয়নি।

এখানকার উপজাতিদের কাছে এই অরণ্য পবিত্র ভূমি। যুগ যুগ ধরে তাদের বিশ্বাস, মৃত্যুর পর মানুষের আত্মা এখানে থাকতে আসে। জীবদ্দশায় তাদের পাপ-পূণ্যের বিচারও হয় এখানে। তাই বালফাক্রাম তাদের কাছে ‘মিত্তে আদালত’।

দেবী দর্শনে শুরু হয়েছিল পথচলা। অবসানও সেই দেবীকে দর্শন করেই। বালফাক্রাম পর্ব চুকিয়ে ছুটলাম মানকাচারের পথে। তুরা থেকে ঘণ্টা তিনেকের রাস্তা। অসম-বাংলাদেশ সীমান্তের এই জায়গাটির পরিচিতি যে মন্দিরের জন্য, তাকে এখানকার মানুষ বলেন দ্বিতীয় কামাখ্যা। এই মন্দিরও পাহাড়চুড়োয়। নির্জন পাহাড়ে অধিষ্ঠাত্রী দেবী কামাখ্যা। প্রণাম সেরে এ বার পালা বিদায় নেওয়ার, মেঘালয় সুন্দরীর কাছে। কিন্তু খাসি-গারোর দুই চোখ যেন ছলচল করছে! মেঘলা আকাশ থেকে নেমে এল জলের ফোঁটা। আবার দেখা হবে, প্রতিশ্রুতি দিয়ে পেলাম ছাড়পত্র।

চার দেওয়ালের ঘেরাটোপে ডানা গুটিয়ে ফের কাজে বসে পড়ে মন।

 

ছবি— শ্রেয়সী সেনশর্মার সৌজন্যে

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *