ইতিহাস ছুঁয়ে বিশেষ ভ্রমণ

বিদ্যাসাগর, সত্যজিৎ রায়ের স্মৃতির সিংহ রায় বাড়ি

চন্দন দত্ত রায়

বর্ধমানের নানা জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে নানা ধরনের ইতিহাস। আজ জমিদার বাড়ি দর্শন হোক।

চকদিঘির সিংহ রায় বাড়ি

বর্ধমানের জামালপুরে কাছ‌ই চকদিঘি। আজ থেকে প্রায় ৩৫০ বছর আগে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রাজত্বকালে বুন্দেলখণ্ডীয় রাজপুত নল সিং এই জমিদারির পত্তন করেন। বাড়িটি তাঁরই তৈরি। যা আজও চকদিঘির রাজবাড়ি নামে পরিচিত। পরবর্তী কালে সিংহ রায় উপাধি গ্রহণ করে তাঁরা পাকাপাকিভাবে এখানেই বসবাস শুরু করেন। প্রায় ১০০ বিঘে জায়গার ওপর বাড়ি পুকুর, বাগান সহ এই পাঁচিল ঘেরা জায়গা। সুবিশাল গাড়ি বারান্দা আর বড় বড় তিনটি প্রাসাদ।

রাজবাড়ির একটি অংশ।

লর্ড কার্জন

এই বাড়ির সঙ্গে জড়িয়ে আছে লর্ড কার্জনের নাম। কার্জনের সঙ্গে এই বাড়ির জমিদারের সুসম্পর্ক ছিল। তিনি মাঝে মধ্যেই এখানে আসতেন ও থাকতেন। তার জন্য একটি বাড়ির দোতলা নির্দিষ্ট ছিল। যেখানে বিলিয়ার্ড খেলার ব্যবস্থা ছিল এবং ছিল লাইব্রেরি রুম। এই বিশেষ রুমটি কার্জন রুম হিসাবে আজ‌ও পরিচিত।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

সিংহ রায় বংশের এক পুরুষ ছিলেন সারদা প্রসাদ। তিনি ছিলেন বিদ্যাসাগরের বন্ধু স্থানীয়। বিধবা বিবাহ, স্ত্রী শিক্ষার প্রসারে একযোগে কাজ করতেন। সারদা প্রসাদের আমলেই বিদ্যাসাগরের পরামর্শে চকদিঘির পার্শ্ববর্তী অঞ্চলেরও উন্নতি সাধন করা হয়। বিদ্যাসাগর এই বাড়িতেই এক গ্রন্থাগার স্থাপন‌ও করেছিলেন। যদিও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে কালের নিয়মে তা আজ শুধুই ধ্বংসস্তূপ। তবে কিছু ব‌ই আজ‌ও সংরক্ষিত আছে। বিদ্যাসাগরের বিশেষ পছন্দের বাগান সংলগ্ন পুকুর ধারের হাওয়ামহল ঘরটি তাঁর নামেই।

সত্যজিৎ রায়

সন্দীপকে মনে পড়ে? তার সেই উদাত্ত কণ্ঠে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান। জমিদার নিখিলেশ সন্দীপের বিশেষ বন্ধু। যিনি স্বাধীনতা সংগ্রামী জানা সত্ত্বেও সন্দীপকে জমিদার বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলেন। আর সেই পর্দানশীন বিমলাকে যিনি স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় বলুন আর প্রেমের জোয়ারে ভেসে গিয়ে বলুন সোনা দানা-সহ নিজেকে সন্দীপের কাছে সমর্পণ করেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ঘরে বাইরে’। চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় এখানেই তাঁর সেই সিনেমার শ্যুটিং করেছিলেন। তাদের সকলের জন্য বৈঠকখানা ঘরটি আজ‌ও এক‌ই রকম ভাবে আছে। যতদিন তাঁরা শ্যুটিং করতেন এই নির্দিষ্ট জায়গাতেই থাকতেন। এছাড়াও এই বাড়িতে পদধূলি পড়েছিল তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, রমেশচন্দ্র মজুমদার, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র-সহ নানা গুণীজনদের।

বছরের বেশিরভাগ সময়ই এই বিশাল প্রসাদ ও তার চারিপাশ নিঝুম হয়ে থাকে। কয়েকজন কেয়ারটেকার ও একজন ম্যানেজার ও সারা বছর ভর রক্ষণাবেক্ষণের কাজে যুক্ত কয়েকজন শ্রমিক ছাড়া কেউ থাকেন না। তবে অন্দরের বাড়িগুলোতে বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া কারও প্রবেশাধিকার নেই। দুর্গাপুজোর সময় এই বাড়ির অন্দরের বড় বড় ঝাড়বাতিগুলি আলোর রোশনাই ছড়ায়। বছরের এই সময়টিতে পরিবারের সদস্য ও তাঁদের আত্মীয়স্বজনরা এখানে আসেন। দেবীর ঘটে আবাহন থেকে বির্সজন সব কিছুই বাড়ির ভিতরের পুকুরেই হয়। একবারে মূল প্রবেশপথ থেকে মন্দির-সহ সব জায়গাতেই টিউবের আলোয় আলোকিত হয়। পিছনের বাগান ও তার সংলগ্ন জায়গা অন্ধকারাচ্ছন্ন‌ই নজরে এল।

দুর্গামণ্ডপ।

দুর্গাপুজোর টিনের সাবেকি আটচালাটি অনেকটাই বড় ও সুন্দর। ওই আটচালার‌ই সামনে ডানদিকে একটি চালায় কলাগাছ সহ দেবীর বোধন চলছে পঞ্চমীতেই। সেখানে বসে আছেন এক অতি বৃদ্ধ দীর্ঘকায় ব্যক্তি। এই বংশের বর্তমান পুরুষ দীর্ঘকায় দু’জন ব্যক্তিকে দেখলাম হাতে গঙ্গাজল নিয়ে বোধনের চালায় গিয়ে দাঁড়ালেন। জানতে পারলাম এখানে দুর্গাপুজোয় স্থলপদ্ম ব্যাবহার করা হয়।

বর্তমান ম্যানেজার গোপাল দত্তর কাছেই জানতে পারলাম যে এখানে অন্দরমহলে যেমন বাইরের কারও প্রবেশাধিকার নেই। একমাত্র জমিদার বংশের কার‌ও বিশেষ অনুমতি ব্যতিরেকে। আর তেমনই ছবি তোলাও নিষিদ্ধ। ততক্ষণে আমার মোবাইল কিছু কথা বলে দিয়েছে।

ছবি- লেখক

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *