পাহাড়িয়া বাঁশি বিশেষ ভ্রমণ

ঢের হয়েছে ঢেল

দীপশেখর দাস

প্রশ্নটা এইরকম – ক্ষণে ক্ষণে রূপ বদল করে কে? উত্তরটা ক্ষেত্রবিশেষে হয় ভিন্ন। প্রাণীবিদরা বলেন গিরগিটি। তাত্ত্বিকরা বলেন মানুষ। আমি বলি হিমালয়।

কর্মসূত্রে একপ্রকার বাধ্য হয়েই হিমালয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছি। হিমালয়ের জঙ্গলে উদ্ভিদের ভিন্ন প্রজাতির সন্ধানে হন্নে হয়ে ফেরাটাই কাজ। মাস দুয়েক আগের কথা। তেমনি এক কাজে হাজির হয়েছিলাম হিমাচলের কুলুর এক জাতীয় অরণ্যে। এখানে আগেও একবার এসেছিলাম। (ছুঁয়ে দিলাম তোমায়, হিমালয়) পথগুলো তাই চেনা ছিল। সেই চেনা পথে দিন ১৫ জঙ্গল চষে ফেলেছিলাম। কিন্তু মানুষের মন যে বড়ই সঙ্কীর্ণ। পুরনো হলে তাকে ঠেলে সরিয়ে দেওয়া আমদের চিরদিনের অভ্যাস। আমরাও ব্যতিক্রম নই। আমরা মানে – বাংলার আমি, বিহারের নিকেশ আর উত্তরাখণ্ডের ডঃ দীনেশ রাওয়াত। শক্তি গ্রামের তীর্থরাম আর আমাদের সঙ্গী দুনিচাঁদ খোঁজ দিয়েছিল এক নতুন পথের। আর সেই পথের পথিক হতে আমরা দুবার ভাবিনি।

শক্তিগ্রামের কাছে স্যাঞ্জ নদী।

শক্তি থেকে হুমখানি হয়ে ঢেল। আগের বার হুমখানি পর্যন্ত এসেছিলাম। কিন্তু তার পরেও যে এগোনোর রাস্তা আছে তার সন্ধান পাইনি। আলোচনা করে ঠিক হল সকাল ৮টায় বেরোনো হবে। একটু আগেই গন্তব্যে পৌঁছতে হবে। নইলে রান্নার কাঠ জোগাড়ে অসুবিধা হতে পারে।

চলার পথে।

কিন্তু ভাগ্যদেবী সহায় নন (দেবীগণ আমার একটু বেশিই বিরূপ)। আগের দিন রাত্রি থেকেই প্রবল বৃষ্টি। তাঁবুর তলায় সারা রাত ঠান্ডা জলের স্রোতে ঘুমের বারোটা পাঁচ করেছে। তাতেও ক্ষান্তি নেই। সকালেও অঝোরে ঝরে চলেছে। ফলে বেরোতেই ৮টার জায়গায় ১০টা। দুনিচাঁদ আমারই বয়সি। তাই আমাদের মধ্যে আলাপটা বেশ জমেছিল। শক্তি থেকে হুমখানির দূরত্ব কিলোমিটার পাঁচেক। ঘণ্টা দুয়েক হেঁটে হুমখানি পৌঁছলাম। এখানেই খানিকক্ষণ বিশ্রাম নেওয়া হবে। কিন্তু, মুশকিল হয়েছে সবারই বোতলে জল শেষ। এখানে একটা ছোট জলের খাদ ছিল। কিন্তু, এখন হিমালয়ের ঘোর বর্ষায় বন্য বীরুৎ-এর দাম্ভিক শাখাপ্রশাখার আবরণে সে মুখ ঢেকেছে। রাস্তা ছেড়ে জলের সন্ধানে যাওয়া একপ্রকার মূর্খামি। অতএব জলের আশা ছেড়ে সামনে এগিয়ে চলাই দস্তুর। খানিক এগোলেই যে জলের দেখা পাওয়া যাবে এমন আশ্বাসও আমরা পেলাম দুনিভাইয়ের কাছে।

কিন্তু হায়! জলের সন্ধানে যাবো কী! পথ সন্ধানই আমাদের কাছে প্রধান হয়ে উঠল। আমাদের মধ্যে দুনিচাঁদই একমাত্র এ পথে এসেছে। হুমখানিতে বসে তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম আর কতখানি যেতে হবে? সে বলেছিল যতখানি এসেছি ততখানি। বিপত্তিটা ঘটল হুমখানির ফরেস্ট হাটটা পেরিয়েই। হাটের খানিকটা পর থেকেই রাস্তা নেমে গেছে সোজা নিচের দিকে। হিমালয়ের রাস্তায় চড়াই উৎরাই আছে। সে ভেবেই আমরা এগোলাম। কিন্তু না। এ উৎরাই যে শেষই হয় না। মিনিট দশেক হাঁটার পর থমকে গেলাম। চোখ যতদুর যাচ্ছে রাস্তা একঢালে নেমে চলেছে নিচের দিকে। দুনিভাইও দেখলাম হকচকিয়ে গেছে। আমাদের চোখাচুখি হতেই বলল, ‘শায়েদ গলত রাস্তা পকড় লিয়া’। আবার আমরা উপর দিকে হেঁটে হুমখানির যেখান থেকে যাত্রা শুরু করেছিলাম সেখানেই উপস্থিত হলাম। সে আমাদের দাঁড় করিয়ে রাস্তা খুঁজতে গেল।

হুমখানির ফরেস্ট হাট।

কিছুক্ষণ পর দুনিচাঁদ ফিরে এল। ফিরে এসে একগাল হেসে জানাল ওটাই একমাত্র রাস্তা। কিন্তু ওর ঠিক মনে পড়ছে না। দীনেশ স্যার পাহাড়ের লোক। সে জানে একটাই যখন রাস্তা তখন এটাই ঢেল গেছে। এবার তাঁর পিছু পিছু চলতে থাকলাম আমরা।

নামছি তো নামছি। উৎরাই আর শেষ হয় না। পাহাড়ের পাতা ঝরা ভেজা রাস্তায় উপরে দিকে ওঠা যতটা না কঠিন, নিচের দিকে নামা তার দ্বিগুণ ভয়াবহ। একবার পা হড়কালে কোন পথে যে নীচে পৌঁছে যাব নিজেও জানি না। কখনও গাছপালা, কখনও ঘাস আঁকড়ে নিচের দিকে নামছি। প্রায় ৪০ মিনিট নামার পর একটু সমতল পেলাম। মিনিট দুয়েক হেঁটেছি, আবার উৎরাই। নামছি আর ভয় পাচ্ছি। হুমখানির উচ্চতা ছিল ৩০০০ মিটার। শক্তির উচ্চতা ২১০০ মিটার। যেখানে যাব, সেই ঢেলের উচ্চতা আনুমানিক ৩৭০০ মিটার। আমরা যেভাবে নেমে চলেছি তাতে ২০০০ মিটারের নীচে পৌঁছে যাবার উপক্রম।

হুমখানি থেকে হিমালয়।

আরও খানিকক্ষণ নামার পর একটা তীব্র ঝরণার আওয়াজ জঙ্গল ফুঁড়ে কানে আস্তে লাগল। সঙ্গে সঙ্গে জল তৃষ্ণা ছাতি ফেটে বার হতে চাইল। তীব্র জল তৃষ্ণা আর খানিক ক্লান্তিতে আমরা পিছিয়ে পড়েছিলাম। দুনিচাঁদ এগিয়ে ছিল। একটা পাথরের মোড় ঘুরতেই জলের আওয়াজ তীব্র হল। সামনে রাস্তাটা একটুখানি নেমে গিয়ে একটা কাঠের সেতুতে শেষ হয়েছে। সেতুর নীচে দিয়ে বয়ে চলেছে এক পাহাড়ি জলস্রোত। যে পাহাড়ে দাঁড়িয়ে আছি, তা একঢালে নেমে গেছে সেই জলস্রোতের দিকে। লম্বা পাইনের দল সামনের দৃষ্টি রোধ করেছিল। তবুও স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম অন্য এক জলের ধারা কোন এক প্রবল আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে এই পাহাড়ের বুকে।

তুষার মোড়া শিখর।

সেতুতে পৌঁছে দেখি দুনিচাঁদ সেতুর উপরেই শরীর এলিয়েছে। যদিও তার দৃষ্টি আমাদের দিকে। আর সেই দৃষ্টিতে বিজয়ীর গর্ব।

(চলবে)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *