অন্য সফর বিশেষ ভ্রমণ

ভুলির দিনগুলো— তৃতীয় পর্ব

সৌগত পাল

রাতে রান্না হয়ে যেতে খাবার নিয়ে ঘরে চলে এলাম। সবাই একসাথে বসে গেলাম খেতে। কিন্ত কারোর খাওয়াতে তেমন মন নেই। কারন রান্না অতি জঘন্য। খাওয়া শেষ করলাম কোনো মতে। যার ৩০টা রুটি খাবার কথা ছিল সে জানাল মাত্র ২২টা খেয়েছে। রান্না ভালো হলে আরো খেত। তখন আমরা ঠিক করলাম আরো একদিন ক্যান্টিনে রান্না করিয়ে খাওয়া হবে।

পরদিন ক্লাসের শেষে একটা নোটিশ এল যে আগামীকাল ভোর ৫টায় সবাইকে যোগা ক্লাসে থাকতে হবে। সকালে উঠা আবার যোগা! সবার মুখ ব্যাজার হয়ে গেল। সেদিন রাতে খাওয়া সেরে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম।

ভোরে উঠে চললাম যোগা ক্লাসে। দেখি যোগগুরু এসেছেন। গেরুয়া পোশাকে মাথা থেকে পা অব্দি ঢাকা।  তিনি যোগার নানা গুণাগুণ বর্ণনা করতে লাগলেন। আজকাল নাকি ডাক্তাররা ওষুধ না দিয়ে যোগা করতে বলছেন। এক সিনিয়র মন্তব্য করলেন, “ডাক্তার না মোদীজী বলছেন”। গুরুজী না থেমে দ্বিগুন উৎসাহে বলে চলেছেন। এদিকে আমাদের কান ঝালাপালা হয়ে যাচ্ছে। ১০মিনিট টানা বলে উনি থামলেন। তারপর শুরু হলো ক্লাস। আনভ্যাসের দরুন শরীরের কলকব্জা প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠল। দীর্ঘ ৩০মিনিটের পর যোগা ক্লাসের ইতি।

দেখতে দেখতে অক্টোবর শেষ হয়ে গেল।। দুর্গাপুজোর পর কালীপুজো দীপাবলিতে বাড়ি এলাম আবার ছুটি শেষে ফিরে গেলাম। বাড়ি থেকে ফেরার সময় মজার ঘটনা ঘটল। রাতে ট্রেনে উঠে ফাঁকা আমরা সিট খুঁজতাম শুয়ে যাবার জন্য। ধানবাদ অবধি ফাঁকা সিট পাওয়া যেত। তো সেদিন নীতিশ, ভরত আর সায়ন্তন এ সি কামরাতে উঠেছে। সেখানে এক বাঙালি টি টি ই ছিলেন। তিনি সোজা বলে দেন গার্ডদের তিনি তাঁর কামরাতে উঠতে দেবেন না। কারন? একদিন তিনি শিয়ালদহ তে এক লোকাল ট্রেনের গার্ডকে তার গার্ড ভ্যানে নিয়ে যেতে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্ত গার্ড সেই অনুরোধ রাখেননি।

পলাশ সারি।

নীতিশ আবার একদিন ট্রেনে আসছিল। তখন টি টি ই বলে বিনা ইউনিফর্মে তাকে নিয়ে যাবে না। নীতিশ ও ছাড়ার পাত্র না। সে সাদা প্যান্ট পরে ছিল। সেটা দেখিয়ে বলে  অর্ধেক ইউনিফর্ম আছে। এতে হবে না?

একদিন দেখি ভরত খুব হাসতে হাসতে ঘরে ঢুকল। বলল আমাদের ঘর ভেবে পাশের ঘরে ঢুকে পড়েছিল। আসলে ঘর গুলো একইরকম হওয়াতে ভুল হতো। পাশের ঘরের একজন তো আরো সাংঘাতিক কাণ্ড করেছিল। সে স্নান করে আমাদের ঘরে তার জামাকাপড় খুঁজছিল।

দুপুরের খাবার সময় একদিন একটা ব্যাপার লক্ষ করলাম। দুপুরে ১ঘন্টা ব্রেক থাকত। আমরা খাওয়া দাওয়া করে একটু শোবার পর ক্লাসে যেতাম। সেদিন বুধবার মানে মেনুতে বিরিয়ানি। ক্লাস শেষ হতেই কিছু ছেলে প্রায় দৌড়ে ক্যান্টিনে পৌছে যেত। সেদিনও কিছু ছেলে আগে খেতে বসে গেছে তখন আমরা বসলাম। খাওয়া দাওয়া সেরে যাবার সময় আরো কিছু ছেলে খেতে বসল। তাদের একজনকে দেখে কেমন একটা খটকা লাগল। আরে এতো আমাদের আগে খাচ্ছিল। আবার এখন খেতে এসেছে। তফাত বলতে তখন ইউনিফর্ম পরে ছিল এখন বিনা  ইউনিফর্মে এসেছে। যাতে চিনতে না পারে তাই ভোল পালটে এসেছে। দুবার খেলে মাংসের পরিমাণ বেশী পাবে। ঘরে সবাইকে বললাম। সবাই শুনে হতবাক।

আজ আবার মাংস রান্না করাবো। তবে এবার বাইরে না ক্যান্টিনে। তাই বিকেলে ক্যান্টিনে জানিয়ে এলাম আর মাংস কিনে দিয়ে এলাম। এবার খাবার এতো সুস্বাদু হয়েছিল যে পাতে পড়তে না পড়তে শেষ। এবারে অনেকগুলো রুটি বেশী হয়ে গেল। কারন সেই ৩৫টা রুটি খাবে বলে বেশী রুটি নিয়ে এসে আর খায়নি। এবারে তার অজুহাত মাংসটা শুকনো ছিল। একটু জুস থাকলে ঠিক খেয়ে ফেলত।

পরের বার তাকে বেশী জুস দেওয়া হবে এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে সেদিনের খাওয়া শেষ হল।

রেলগাড়ির কামরা থেকে।

খাবার পর বড় চমক। গোটা দেশের সাথে আমাদেরও ধাক্কা দিলেন মোদীজী। ৮ই নভেম্বর। নোটবন্দী। খাবার পর রাজীব ফোন নিয়ে ঘাঁটছিল। সেই এসে সবাইকে খবরটা দিল। কাল থেকে ৫০০ আর ১০০০ টাকার নোট বাতিল। শুনে আমরা সবাই হাসাহাসি শুরু করলাম। ধুর এরকম হয় নাকি। কিন্ত পরে সবাই এক এক করে খবর পেলাম। তারপর সবাই হিসেব করতে বসলো কার কাছে কটা নোট আছে। কি করে নোট পালটাবো এই চিন্তা নিয়ে ঘুমোতে গেলাম। ওই সপ্তাহে ছুটিতে বাড়ি এসে নোট পালটাতে ব্যাঙ্কে লাইন দিতে গিয়েই ছুটি শেষ হয়ে গেল। ছুটি শেষে এখানে রোজের কাজ ছিল এ টি এম এ লাইন দেওয়া। আমাদের দিন শেষ হয়ে আসছে এখানে। খরচ মেটালে তবে এখান থেকে ছাড়বে। এবার এখানে বলে দিয়েছে বাতিল নোট নেওয়া হবে না। তাই প্রতিদিন ক্লাস শেষে অটো করে চলে যেতাম ধানবাদ স্টেশন। টাকা তুলে অটো ধরে ভুলি। এদিকে দরজায় কড়া নাড়ছে পরীক্ষা। ২৬, ২৮, ২৯ তিনদিন পরীক্ষা সকাল ৯টা ৪৫ থেকে ১২টা ৪৫। কিন্ত কিছুই তো পড়িনি। বই নিয়ে বসছি কিন্ত কিছুক্ষণ পর আর ভালো লাগছে না। বাকি সবাই পড়াশোনা করছে। সবচেয়ে বেশী পড়ছে ভরত। সব সময় বই নিয়ে বসে আছে। আর আমি এমনি এমনি বসে আছি। বন্ধুরা বলছে, “তুই কি পড়বি না?” আমি চেষ্টা করছি কিন্ত ভালো লাগছে না। আমাকে বোধহয় দ্বিতীয়বার আসতে হবে।

আবার আজ মাংস হবে। শেষবার সবাই মিলে। এক সপ্তাহ পর পরীক্ষা হয়ে যাবে সবাই যে যার চলে যাবো। আগের দিন রুটি বেশী হয়েছিল তাই আজ গুনে গুনে রুটি দেওয়া হবে। ৩০টা রুটি খাবার লোক আপাতত ১০টা নিয়েছে। পরে আবার নেবে। আজ মাংস অন্য দুদিনের থেকে বেশী নেওয়া হয়েছিল তাই সবাই যা বলেছিল তার থেকে ১-২টো রুটি কম খেল। কিন্ত দেখা গেল ২৫টা রুটি বেশী। ব্যাপারটা কি। একজন ১০টা রুটি নেবারপার আর নেয়নি। বোঝা গেল ৩০টা রুটির দৌড় ১০টা অব্দি।

পরীক্ষার ৩দিন আগে ক্লাসে নোটিশ এল আজ সন্ধেবেলা ফাংশন হবে। সবাইকে থাকতে হবে। এমনিতে পড়া হয়নি আবার ফাংশন। সবাই ঘোষণা করল কেই যাবে না। সেই মতো সবাই বই নিয়ে বসলাম। কিন্ত একটু পরই উসখুস। “দেখেই আসি” বলল নীতিশ। নীতিশ আমার মতোই ঘোষণা করেছে সেও দ্বিতীয়বার আসবে পরীক্ষা দিতে। তারপর সবাই মিলে বেরিয়ে পড়লাম ফাংশন দেখতে। ভালোই লাগলো। তবে শেষে শিল্পীদের থেকে বেশী আনন্দ দিলেন আমাদের দুজন শিক্ষক মুকেশ স্যার আর সিনহা স্যার। মুকেশ স্যার অসাধারন গান গাইলেন আর সিনহা স্যার মজার মজার কথা বলে মাতিয়ে দিলেন। অনুষ্ঠানের শেষে খেতে গেলাম। সেখানে চমক। প্রথমবার রাতের খাবারে আমিষ পদ। ডিমের কারি। খাওয়াদাওয়া শেষে ঘরে এসে আবার পরীক্ষার কথা মনে পড়ে গেল। দুরু দুরু বুকে বিছানায় শুয়ে চোখ বুজলাম।

প্রতীক্ষার অবসান। আজ থেকে পরীক্ষা। স্কুলজীবনের মতো স্নান খাওয়া সেরে ব্যাগ গুছিয়ে রওনা দিলাম পরীক্ষা হলের দিকে। পরীক্ষা হলটা আগের দিন দেখে গিয়েছিলাম। দেখে হিসাব করছিলাম কাকে কোথায় বসাতে পারে। পরীক্ষা শুরু হল। শেষ ২দিন একটু পড়েছিলাম। মনে হল ভালোই লিখেছি। তবে পরীক্ষা দিয়ে ঘরে এসে মন খারাপ হয়ে গেল। ভাবলাম আর দুদিন মাত্র। তারপর হাসি মজা আনন্দের দিন গুলো শেষ হয়ে যাবে।

দেখতে দেখতে যাওয়া।

আজকেই শেষ পরীক্ষা। আর আমাদের মেয়াদ ও শেষ। পরীক্ষা শেষ হলেই অফিসে রিপোর্ট করতে হবে। পরীক্ষা দিয়ে এসে খাওয়া দাওয়া করেই ব্যাগ গুছানোর পালা। তারপর সব ক্লাসমেটদের বিদায় জানিয়ে এলাম। কিছুক্ষণ আগে হাতে পেয়েছি সবাই মিলে তোলা ছবির কপি। ওটাই এই দিন গুলোর স্মৃতি হয়ে থাকবে। তিন বছর পর আবার আসতে হবে। কিন্ত তখন সবাই একসাথে আসবো এরকম নিশ্চয়তা নেই। ৪নম্বর হস্টেলের ১৫নম্বর ঘরকে বিদায় জানিয়ে চললাম ধানবাদ স্টেশনের উদ্দেশ্যে। ৫জন চলে যাবে বাড়ি। পরদিন যে যার অফিসে রিপোর্ট করবে। কিন্ত আমি আর পৃথ্বীশ যাব মুঘলসরাই। তাই এখান থেকে রাতে ট্রেন ধরবো। অপেক্ষা করতে লাগলাম ওয়েটিং রুমে।

ট্রেনের সময় রাত ৯টা ৩০। গঙ্গা শতদ্রু এক্সপ্রেস। বিদায় ধানবাদ। এবার যাত্রা মুঘলসরাই।

(শেষ)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *