অন্য সফর বিশেষ ভ্রমণ

ভুলির দিনগুলো— প্রথম পর্ব

সৌগত পাল

ভুলির ট্রেনিংয়ের চিঠি আনতে যেতে হয়েছিল মুঘলসরাই। এই নিয়ে তৃতীয়বার। তখনও জানি না ট্রেনিং কোথায় হবে। চিঠিতে দেখলাম ধানবাদের ভুলি। দেখে আনন্দ হল। বেশ কিছু বন্ধুর সঙ্গে দেখা হবে। ট্রেনিং এর দিন কটা আনন্দেই কাটবে।

সেই আনন্দেই সারা রাত কষ্ট করে ট্রেনে ফিরে পড়লাম বাড়ি। বাড়ি এসেও ফুরসত নেই। হাতে মাত্র দিন তিনেক সময়। গোছগাছ করতে হবে। প্রথমবার বাইরে থাকতে যাচ্ছি। কত লোক কত রকম পরামর্শ দিচ্ছে। চাকরি পেয়েছি রেলে। গুডস ট্রেনের গার্ড। ইন্দ্রদা, দীপু, বাবলা, রাজারা বলে মালগাড়ির গার্ডবাবু। তারই ট্রেনিং ভুলিতে। ঝাড়খণ্ডে জায়গাটা।

মোটামুটি গোছগাছ সারা। এখন সমস্যা ইউনিফর্ম নিয়ে। কেউ সঠিক ভাবে বলতে পারল না সঠিক ইউনিফর্ম কি। বন্ধুদের ফোন করলে কেউ বলে সাদা জামা আর খাকি প্যান্ট আবার কেউ বলে জামা প্যান্ট সবই সাদা। ভেবে দেখলাম প্যান্ট নিয়ে সমস্যা যখন তখন ওটা ওখানে গিয়েই কিনব। আপাতত জামা কিনতে বেরলাম বড়গাছিয়া বাজারে। সামনে খিরিশতলায় পাড়ার কাকুর দোকান। প্রথমেই হতাশ। সাদা জামা কিন্ত তা স্কুলের ছাত্রদের, আমার গায়ে তা আঁটবে না। বোঝাতে গেলাম, আমিও স্কুলেই যাব। কিন্ত কিছুতেই শুনলেন না।

যাক এরপর এক এক করে চার পাঁচটা দোকান ঘুরেও সাদা জামা আর পেলাম না। সবার এক কথা, সামনে পুজো। এখন কেউ সাদা জামা কেনে না। হতাশ হয়ে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চোখে পড়ল একটা দোকান আর হ্যাঁ, দোকানের শো কেসে সাদা দেখে দৌড়ে গেলাম এবং ইউরেকা! পেয়েছি।

ট্রেনিংয়ে ভবিষ্যতের গার্ডবাবুরা।

যাত্রা শুরু

সকাল ৬টা ১৫ মিনিটে হাওড়া থেকে ছাড়ে ব্ল্যাক ডায়মন্ড এক্সপ্রেস। ধানবাদ যাবার ট্রেন। ব্যাগ লটবহর নিয়ে উঠে পড়লাম। বাকি বন্ধুরা উঠবে ব্যান্ডেল থেকে। একটা ভয় ভয় আনন্দের অনুভূতি নিয়ে ছেড়ে দিল ট্রেন। ব্যান্ডেলের পর বন্ধুরা উঠল গল্পে গল্পে ১২টা নাগাদ পৌঁছনো গেল ধানবাদ।

ট্রেন থেকে নামতেই খিদেতে পেট চুঁইচুঁই করতে শুরু করল। স্টেশনের বাইরে খাবারের দোকান খুঁজতে শুরু করলাম। খানিক খোঁজার পর বুঝলাম আমাদের মনের মত খাবার পাচ্ছি না। সব দোকানে একই খাবার লিট্টি আর আলু চোখা। তাই খেয়ে রওনা দিলাম ভুলির উদ্দেশ্যে। ধানবাদ থেকে ভুলি যাবার অটো পাওয়া যায়। দশ মিনিটে পৌছে গেলাম ভুলি।

অফিসে ঢুকে সইসাবুদ ঘর পেয়ে গেলাম। একটা ঘরে সাতটা বেড। ট্রেনে এক সঙ্গে আসা পাঁচ বন্ধু এবং আরও দু’জন সেই ঘরে জায়গা পেলাম। সবাই বলাবলি করতে লাগলাম আড্ডা গল্প করে দিনগুলো ভালো কাটবে।

ট্রেনিং ইনস্টিটিউট।

দুপুরে খাবার জন্য ক্যান্টিনে খোঁজ নিতে গেলাম। গিয়ে শুনলাম আমাদের আজ হিসাবের মধ্যে ধরা হয়নি। তাই খাবার পাওয়া যাবে না। ক্যান্টিনকর্মীদের অনুরোধ করতে বললেন, ভাত ডাল আর সবজি পাওয়া যাবে। আজ মেনুতে মাছ ছিল। কিন্ত শেষ। সেই ভাত সবজি খেতে বসলাম। ক্যান্টিনকর্মীরা পরিবেশন করতে করতে জানালেন মাছ নেই কিন্ত মাছের মুড়ো পাওয়া যাবে। সবাই লাফিয়ে উঠলাম। মুড়ো কি মাছ নয়? নিয়ে আসুন।

খাওয়া দাওয়া শেষ করে বিছানাতে লম্বা দিলাম। সকাল থেকে অনেক ধকল গেছে। কিন্ত কিছুক্ষণ পর বাইরে কোলাহল শুনে বেরিয়ে দেখি সামনে মাঠে কিছু ছেলে জমায়েত হয়েছে। আর তাদের হাতে ব্যাট উইকেট। ব্যাস সব ক্লান্তি ধুয়ে সাফ। সোজা মাঠে। অনেকদিন পর মাঠে নেমে খুব আনন্দ হলো। সন্ধেবেলা আবার অফিসে গিয়ে হস্টেলের কার্ড, পরিচয়পত্র নিতে হলো। অফিস থেকে জানানো হল কাল থেকে ক্লাস। সকাল ৯টা ২৫মিনিটে প্রার্থনা আর ৯টা ৩০থেকে বিকেল ৪টে অবধি ক্লাস। মাঝে দুবার বিরতি।

এবার আমাদের ঘরের বাসিন্দাদের পরিচয় দেওয়া যাক। আমার সঙ্গে মুঘলসরাই এর অন্য ছেলেটি- পৃথ্বীশ। আগে আমরা একে অন্যকে চিনতাম না। নিয়োগপত্র পাবার পর ফোনে আলাপ। আসানসোল ডিভিশনের হাবিবুর আর সায়ন্তন এর সাথে আলাপ ছিল রেল আফিসে যাতায়াতের সূত্রে। হাওড়া ডিভিশনের ভরত ভূষণ শিয়ালদহ ডিভিশনের রাজীব আর আসানসোল ডিভিশনের নীতিশকে আগে চিনতাম না। এদের মধ্যে সায়ন্তন আর রাজীব আগে রাজ্য সরকারী কর্মচারী ছিল। ভরত রেলের অন্য বিভাগে কাজ করত। হাবিবুর, পৃ্থ্বীশ আর আমার নতুন চাকরি।

প্রথম দিন ক্লাসের জন্য সকলে তৈরি হয়ে সকলে চলে গেলাম ক্যান্টিনে। আমাদের ক্যান্টিনের নাম ‘আহার’। নিরামিষভোজী এবং মহিলাদের ক্যান্টিনের নাম “অন্নপূর্ণা”। আমাদের থাকার হস্টেলগুলোরও আলাদা আলাদা নাম ছিল। “মধুবন”, “তপোবন”, “সুন্দরবন” ইত্যাদি। আমাদের হস্টেলের নাম ছিল “সুন্দরবন”। যাই হোক “আহার”এ আহার সেরে ক্লাস। ক্লাস এর আগে প্রার্থনা। সেখানে সমবেত কণ্ঠে প্রথমে ভক্তিগীতি, তার পর জাতীয় সঙ্গীত। জাতীয় সঙ্গীত কোরাসে গাইতে গাইতে মনের মধ্যে একটা অন্য রকম অনুভূতি হচ্ছিল।

ক্লাসে প্রথম দিন বিশেষ কিছু হল না। আলাপ পরিচয় হল। আমাদের ক্লাস মোট ২৭ জনের যার মধ্যে একজন ছাত্রী। ক্লাস চলাকালীন দু’বার বিরতি। একবার ১১টার সময় চা-বিরতি। এর সাড়ে বারোটা থেকে দেড়টা অবধি দুপুরের খাবার বিরতি। প্রথম দিন ক্লাস শেষে ঘরে এসে গল্পগুজব হলো। তারপর একটু তাস খেলা শেষে রাতের খাবার খেয়ে ঘুম।

স্কুলের পরিবেশটা মন্দ নয়।

কিন্ত মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। কি নিয়ে যেন শোরগোল চলছে। আমাদের ঘরের মধ্যেই। পাখা নিয়ে শোরগোল। পাখা রাতে চালিয়ে ঘুমিয়ে ছিলাম। রাতে ঠান্ডা লাগতে কেউ পাখা বন্ধ করেছে। তাতে কারও খুব গরম করতে সে আবার পাখা চালিয়ে দিয়েছে। এবার পাখা চলবে কি চলবে না সেটা নিয়েই দ্বন্দ্ব। যার ঠাণ্ডা লাগছে তার বক্তব্য পাখা বন্ধ থাকুক। তাতে যার গরম লাগছে সে খালি গায়ে থাকুক। পালটা যুক্তিও তৈরি, যার ঠান্ডা লাগছে সে চাদর গায়ে দিক। পাখা চলুক। শেষে মধ্যপন্থা অবলম্বন করে ঘরের দুটো পাখা বন্ধ করা হল। বাকি দুটো চলতে লাগলো।

পরদিন সকালে উঠে তৈরি হয়ে ক্যান্টিন। ক্যান্টিনের মেনুতে বেশ একটা বৈশিষ্ট্য আছে। সোম, বুধ, শুক্র সকালে পুরী আর চানা। মঙ্গল, বৃহস্পতি রুটি, ছোলার তরকারি, মিষ্টি আর শনিবার পাউরুটি, কলা, জ্যাম। আর রোজ খাবার শেষে চা। আর দুপুরের মেনু সোমবার ডিমের কারি, মঙ্গল আর বৃহস্পতি নিরামিষ, বুধবার চিকেন বিরিয়ানি, শুক্রবার মাটন কারি। শনিবার মাছ আর রবিবার চিকেন কারি। এগুলোর সঙ্গে রুটি আর ভাত দুটোই দেওয়া হত। কেবল বুধবার শুধুই বিরিয়ানি। রাতের খাবারে রোজ নিরামিষ থাকত। রুটি বা ভাতের সাথে সয়াবিন, রাজমা আর ডাল। সপ্তাহে দুদিন দিত ক্ষীর আর রবিবার রাতের বিশেষ মেনু পুরি আলুর দম আর ক্ষীর।

দ্বিতীয় দিন ক্লাসে গিয়ে সবার মুখ চুন। প্রথম দেন গল্পে কেটে যাবার পর দ্বিতীয় দিন জানিয়ে দেওয়া হল, তিনটি পেপার পরীক্ষা নেওয়া হবে ১০০ নম্বর করে। সব পেপারে পাশ করতে হবে। পাশ মার্কস হল ৬০। শুনে সবার প্রশ্ন, পাশ না করলে? তার উত্তর আসে ভয়ানক। প্রথম সুযোগে পাশ না করলে আর একবার সুযোগ। সেই সুযোগে পাশ না করলে আর কোনো সুযোগ নেই। শুনে সবাই মুখ  চাওয়া চাওয়ি করলাম। এত পরীক্ষা পাশ করে এসে আবার পরীক্ষা পাশ করতে হবে?

(চলবে)

One thought on “ভুলির দিনগুলো— প্রথম পর্ব

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *