জলযাত্রা বিশেষ ভ্রমণ

ছোট মোল্লাখালির যাত্রী— শেষ পর্ব

শতাব্দী অধিকারী

পরের দিন ঘুম ভাঙল বেশ দেরিতে। এমনিতেই আমার ঘুম দেরিতে ভাঙে। অন্য কোথাও থাকলে নয় মা ফোন করে ঘুম ভাঙায়। বলে, ‘‘এবার ওঠ। অনেক বেলা হল, আর ঘুমোস না।’’ এবারও সেইরকমই কিছু হয়েছিল বোধহয়। ঘুম থেকে উঠে দেখলাম পুকুর থেকে মাঝ ধরা হয়ে গিয়েছে। আমি জানতাম না যে ১ বৈশাখ উপলক্ষে পুকুর থেকে মাছ ধরবে কল্পনার বুনোই। আর সেই মাছ কেটে রান্না হবে, ভোজ হবে আল্পনা-কল্পনাদের বাপের বাড়িতে। আগে যদি জানতাম, মাছ ধরা দেখা কখনওই মিস্ করতাম না।

মাছ ধরা দেখতে আমার দারুণ লাগে। ছোটবেলায় মায়ের মামার বাড়িতে ‘অষ্টম প্রহর’ হতো। অষ্ট প্রহর হরিনাম। তার পরে ভাইফোঁটা। ভাইফোঁটার আগে পুকুরে জাল পড়ত। মাছ উঠত ইয়া বড় বড়। বিশাল বিশাল হাঁড়িতে বিশাল বিশাল কাতলা ভরা হতো। গোটা মাছ ধরার সময়টা উত্তেজনায় কাটত আমাদের। কল্পনাদের পুকুরের মাছ অতো বড় না হলেও কয়েকটা বেশ বড় ছিল। কচিগুলোর মুখেচোখে সেই রকমই উত্তেজনা। ছেলেবেলার মতো। ভারী ভাল লাগছিল সকালটা। তবে এবার যে আমায় ফিরতে হবে। সকাল ১০টার বোট না ধরতে পারলে ফিরে অফিস করব কী করে?

ছেলেবেলার স্মৃতি। চোখের সামনে।

আল্পনাকে কথাটা বললাম। প্রথমে যেন ও গুরুত্বই দিল না। আরও কয়েকবার ঘ্যান ঘ্যান করার পর বলল, ‘‘আজ কেন যাবেন! থেকে যান কাল বন ঘুরে পরশু যাব।’’ আমার তো উপায় ছিল না। আমাদের অফিসে রবিবার ছুটি নেওয়া রীতিমতো অপরাধ। তার উপর ১ বৈশাখ, আরও কে কে ছুটি নিয়েছে তা-ও জানা নেই, তার উপরে নাইট, তার উপরে কো-অর্ডিনেশন। আমায় যে ফিরতেই হবে। ঘর থেকে দাওয়ায় ব্যাগ বার করে বললাম, আমায় বোটে তুলে দিতে, আমি একাই ফিরে যেতে পারব। শুনেই সবাই রে রে করে উঠল। কল্পনা এবং কল্পনার বরও থেকে যাওয়ার জন্য বলল অনেকবার। কিন্তু আমার যে উপায় ছিল না। বললাম, শীতে আবার আসব! আল্পনা বলল, ওর বাপের বাড়িতে যেন একবার দেখা করে যাই, ওখানে সবাই অপেক্ষা করছে। আমরা রওনা দিলাম, মাছভর্তি ব্যাগ নিয়ে। প্রথমে মাঠ। তারপরে ক্ষেত, তারপরে ক্যানাল পেরিয়ে।

আল্পনাদের বাপের বাড়ির পুরনো ঘরের চাল অনেক নিচু। চালের নীচে সোজা হয়ে দাঁড়ানো যায় না। নতুন ঘর, ওই আল্পনাদের মতোই মাটি থেকে অনেকটা উঁচু। উঠোনে একটা ছোট জায়গায় রান্না করছে বৌদি। সবেমাত্র মাংস রাঁধা হয়েছে। এরপর মাছ বসবে। ভাত ফুটছে পাশের উনুনে। আল্পনার মা বঁটি নিয়ে মাছ কুটতে বসলেন। তারপর সে মাছ রান্না হল। ও, তার আগে তো বলাই হল না। কল্পনাদের বাড়িতে সকাল ৮টায় এক থালা ভাত খেয়ে বেরিয়েছি। আর ভাত খাওয়া আমার পক্ষে অসম্ভব। আল্পনার বাবা-মা খুব জোরজার করলেন, ‘‘পুকুরের মাছ, ঘরের মুরগি। খেয়ে দেখ।’’ বাধ্য হয়েই খেতে হল। তবে সে স্বাদ অদ্ভুত। বাজার থেকে কেনা মাছ-মাংসের থেকে আলাদা। তবে কোথায় আলাদা সে কথা বলে বোঝাতে পারব না।

এ করুণানিধানের গ্রাম। রান্না চলছে।

খেতে খেতে বহু গল্প শুনছিলাম। তার বেশিরভাগই আয়লার গল্প। কীভাবে আয়লার সময় এই ঘর অর্ধেক ডুবে গিয়েছিল। কীভাবে গোটা গ্রাম স্কুলবাড়িতে জড়ো হয়েছিল। আকাশ থেকে কীভাবে চিঁড়ে-মুড়কি ঝরে পড়ত, তার গায়ে কীভাবে লেখা থাকত, ‘সবাই ভাগ করে খাবেন’। এইসব। শেষে বাড়ির হাঁস-মুরগিদের সঙ্গে আলাপ হল। উফ তারা যে কী মিষ্টি!! কল্পনা বলছিল, ‘‘তোমার ছাওয়ালগুলো তো বেশ হয়েছে মা!’’ ছাওয়াল শব্দটা কানে ভারী মিঠে ঠেকল। কল্পনার বাবা ভারী গর্ব করে জানালেন, প্রতি নাতিকে তিনি ঘর করার টাকা দিয়েছেন। প্রতি নাতনিকে দিয়েছেন একটা করে গরু। গরু ওদের কাছে সম্পদ। কল্পনা আর আল্পনা দু’জনের মেয়ের গরুরই গত শরতে ছানা হয়েছে।

গল্প শেষে এবার ফেরার পালা। কল্পনার মা দিলেন খেজুর পাতার চাটাই। তা ছোট্ট করে বেঁধে দিলেন কল্পনার বাবা। কল্পনার বড়দার ছেলে পাশ থেকে ভ্যান ডেকে দিল। ভ্যানে চড়লাম।

বাড়ির কচিকাঁচারা।

ভ্যানদাদা ঝড়ের বেগে ঘাটে পৌঁছে দিয়েছিলেন। কিন্তু ঘাটে পৌঁছে দেখলাম বোট ছেড়ে দিয়েছে। তবে সে মাঝ নদীতে। ঘাট থেকে জাহাজ দাঁড় করানোর মতো হাত নাড়তে লাগলাম আমি আর ভ্যানদাদা। যদি ফেরে বোট। যদি থামে। অদ্ভুত ব্যাপার বোট থামল। বাঁক নিল। শুধু আমায় ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। ভ্যানো দাদা বসিয়ে দিলেন বোটের ছাদে। ব্যাগ, চাটাই গুছিয়ে রেখে দিলেন পাশে। তারপর বিদায় নিলেন। বোট চলতে শুরু করল নদীপথ বেয়ে। দু’পাশে সন্দরবন রেখে। এই বোট বড়। সাড়ে তিন থেকে চার ঘণ্টায় পৌঁছয় চুনোখালি। বেশ বন, নদী, মানুষ দেখতে দেখতে ফেরা যায়।

বোটে আমার পাশে বসেছিলেন এক দিদা, আর এক দাদু। দু’জনেই ভীষণ রকম গল্প শুরু করলেন আমার সঙ্গে। আমারও দুর্দান্ত লাগছিল। বৃদ্ধার চুলে পাক ধরেছে। কানে অদ্ভুত সুন্দর রুপোর দুল। কানের লতি দুলের ভারে কেটে গিয়েছে অনেকখানি। এইসব চিহ্ন আমার চেনা এবং প্রিয়। অপরিচিত শহুরে এক মেয়ের হাওয়ায় উড়ে যাওয়া কুচো চুল তিনি পরম স্নেহে কানের পাশে সরিয়ে দেন। কোথাও কোনও আগল নেই, থমকে যাওনা নেই, দ্বিধা নেই। স্নেহ যে সাবলীল, তা-ই আরেকবার মনে করিয়ে দিলেন দিদা। মাথায় গোড়ায় ছাতা খুলে রেখে আমরা গরম দুপুরে ঘুমোলাম। তিনি তাঁর বৌমার, ছেলের, মৃত স্বামীর গল্প করলেন। অনেক। বললেন কলকাতায় কোনওদিনও যাওয়া হয়নি তার। এখন আর ইচ্ছেও নেই।

এ-ও এক মুহূর্ত।

দাদু আগেই নেমে গিয়েছিলেন। দিদা নামার সময় বলে গেলেন, ‘‘জল খেও। ওই ওখানে রাখা আছে। বোট থামবে মাঝে মাঝে, কোনও ঘাট থেকে খাবার কিনে খেও। অনেক সময় লাগবে কিন্তু।’’ আমি ঘাড় নেড়ে বিদায় দিচ্ছিলাম। হঠাৎ, ঘুরে দাঁড়িয়ে অদ্ভুত স্বরে বললেন, ‘‘কী অদ্ভুত না! আর কোনওদিন দেখা হবে না।’’ আমারও দোলা লাগল যেন। সত্যিই তো! হাসলাম। দিদা একই কথা বলতে বলতে এগিয়ে গেলেন, ‘‘কী অদ্ভুত ব্যাপার না! আর কোনওদিন দেখা হবে না।’’

এই দেড়দিনে যা যা ঘটল, তার মধ্যে এক অস্বাভাবিকত্ব রয়েছে। সেই অস্বাভাবিকত্ব হল যা ঘটেছে তার সবটাই স্বাভাবিক। বইয়ে পড়া সোজা পথে এগোনো সোজা গল্প। ক্লিশে। যেখানে সব ঠিক। এরপর চুনোখালি থেকে ক্যানিং, ক্যানিং থেকে শিয়ালদহ। শিয়ালদহ থেকে বালি। বালি থেকে বাড়ি। দোরগোড়ায় মা অপেক্ষা করছিল। আমায় দেখামাত্রই বলল, ‘‘দেখালি বটে! আর কোনওদিনও যদি একা ছাড়ি দেখ!’’ পায়ের পাটিয়ালা হাঁটুর উপর তুলে ঘরের মেঝেয় বসার পর বাবাই জিজ্ঞেস করল, ‘‘গিয়েছিলিটা কোথায়?’’ আমি গল্প বলতে শুরু করলাম। আর কী আশ্চর্য! গল্প বলতে গিয়ে মনে পড়ল বিদায় ক্ষণটা।…

ওরা সবাই দোরগোড়ায় এসে দাঁড়াল। সব্বাই। কল্পনা, আল্পনা, আল্পনার বুনোই ,ওদের ছেলে মেয়ে, বৌদি, ভাই, তাদের ছেলে সব্বাই। বন্ধুর সঙ্গে সম্পর্কে দূরত্ব আসার পর তার বাবা বলেছিলেন, ‘‘আর আসো না কেন? একদিন বাড়ি এসো!’’ আমি বলেছিলাম, ‘‘আচ্ছা, যাব।’’ তখন কোন একটা গল্পের উপমা দিয়ে বলেছিলেন, ‘‘আসবে না। জানি। তুমি ওই চরিত্রের মতো কথা বলছ।’’ গল্পটা তখনও আমি পড়িনি। চরিত্রটা কী বলেছিল তা-ও অজানা। তুলনা বুঝতে পারলাম না। কাকুকে বললাম বুঝিয়ে দিতে। কিন্তু দিলেন না। ছেলের মতোই বললেন, ‘‘নিজে পড়ে দেখো।’’

বোটের সহযাত্রীরা।

পড়েছিলাম, কোনও এক গ্রামে এক অন্ধ মায়ের সঙ্গে তার মেয়ে থাকত। সেখানে গিয়েছিলেন লেখক। কীভাবে যেন, অনেক গরুর গাড়ি, ঠেলা, নৌকো পেরিয়ে। মায়ায় জড়িয়েছিলেন। শেষে ফিরছেন যখন, সেই মেয়েটি, যার প্রেমে তিনি পড়েছেন সদ্য, তার মা দাঁড়িয়ে রয়েছেন তাঁর বিদায়কালে। লেখক স্থিরপ্রতিজ্ঞ তিনি ফিরবেনই। মেয়েটি ঠিক জানে, যে চলে যাচ্ছে, সে ফিরবে না। কখনও। এই গ্রাম থেকে যে চলে যায়, সে আর ফেরে না। ফেরার চেষ্টা করে হয়ত।

এটাই নিয়ম।

(সমাপ্ত)

4 thoughts on “ছোট মোল্লাখালির যাত্রী— শেষ পর্ব

  1. দারুন লাগলো চার পর্বের ছোট মোল্লাখালির যাত্রী ৷ শুধু মনে পড়ছিলো ছোট বকুলপুরের যাত্রীর কথা ৷ অনেকদিন আগে পড়া ৷ কিছুই আর মনে নেই ৷ একবার দেখলেই মনে পড়ে যাবে ৷ আসলে নামের মিল বলেই মনে পড়লো ৷ ছোটবেলাটা আমারও গ্রামেই কেটেছে ৷ উত্তর ২৪পরগণাব গ্রাম ৷ সেসব কথাও মনে পড়ে যাচ্ছিলো ৷ চড়কের মেলা আমাদের গ্রামেও হতো ৷ কলেবরে দুর্গাপুজোর মেলার পরেই ছিলো সেই মেলাটা ৷ লেখাটা পড়তে পড়তে অনেক স্মৃতিই ভীড় করে এলো মনে ৷ সেই গোসাবায় ১৯৮৬-‘৮৭ সাল নাগাদ আমরা অনেকজন মিলে বেড়াতে গেছিলাম ৷ ভটভটিতে করে সুন্দরবন এলাকায় অনেক ঘুরেছিলামও ৷ রাজনীতির যে রকম বর্ণনা দিলেন সেটাও আমার চেনা ৷ আলপনার লেখা অনেকদিন থেকেই পড়ি বলে খুব আগ্রহ নিয়ে লেখাটা পড়ে ফেললাম ৷ খুবই ভালো বর্ণনা দিয়েছেন ৷ এমন স্বাদু লেখা পড়লে আনন্দ হয় ৷ মুগ্ধ হয়েছি আপনার লেখায় ৷ আপনার জন্য অনেক শুভেচ্ছা জানালাম ৷

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *