অন্য সফর বিশেষ ভ্রমণ

পথেই পেলাম তাদের

দীপক দাস

ট্রেনটা চলে যেতেই দেখতে পেয়েছিলাম ছেলেটাকে। গালে হাত দিয়ে টিকিট ঘরের সিঁড়িতে চুপটি করে বসে আছে।

বেগুনকোদর স্টেশনে। সেবার পুজোয় ভূত দেখতে গিয়েছিলাম। স্টেশনটা তখন ইন্টারনেট কাঁপাচ্ছে। এশিয়ার অন্যতম ভূতুড়ে স্টেশনে। দিনে নাকি কয়েকটা ট্রেন চলে। সন্ধের পরে কেউ স্টেশনের ত্রিসীমানা মাড়ায় না। চোখ-কানে দেখে গুজবের মাত্রাটা মাপতে গিয়েছিলাম আমি, ইন্দ্র আর শুভ। ভূত কোথায়? এত সুন্দর একটা স্টেশন দেখে আমরা মুগ্ধ। ছবির পর ছবি তুলছিল ইন্দ্র। প্রকৃতি যেন বিশাল ক্যানভাসে ইচ্ছে মতো ছবি এঁকে রেখেছে। আর এই স্টেশনকে কোন উজবুক ভূতুড়ে স্টেশন বলে! এখন অবশ্য রেল কর্তৃপক্ষ আর বিজ্ঞান মঞ্চ মিলে ভূতুড়ে স্টেশনের বুজরুকি ধরে ফেলেছে।

সে অন্য প্রসঙ্গ। যে ছেলেটির কথা বলছিলাম। ট্রেনটা চলে যেতেই লাইনের ওপারে ছেলেটাকে দেখতে পেয়েছিলাম। স্টেশনটায় ওই দুপুরেও বেশ লোকজন। তার মধ্যেও ছেলেটা নজর কাড়ে। ট্রেন গেল, এল, লোকজন নামল। হকারেরা কাউন্টারে ঝালমুড়ি, চানাচুরের মশলা মাখছে। কিন্তু ছেলেটার মাথা আর ওঠে না। কী যে ওর চিন্তা, জানা হয়নি। তখন তো ভূতের নাগাল পেতে ব্যস্ত আমরা।

বেগুনকোদরের মোজেস।

বেগুনকোদরেই দেখা পেয়েছিলাম মোজেসের। পাশেই নলকূপিতে বাড়ি। নামটা জিজ্ঞাসা করা হয়নি। ভদ্রলোক স্টেশন চত্বরে গরু চরাচ্ছিলেন। ভূতের ব্যাপারটা যে পুরোটাই গালগল্প (একটি ভূতুড়ে স্টেশন) সেটা ওই মোজেসের কথা থেকেই জেনেছিলাম। অনেকক্ষণ কথা হয়েছিল। বুঝেছিলাম, ওই বৃদ্ধ নিজের গ্রামকে ভালবাসেন। তাই বদনাম করেননি। নিজের গ্রামের কিছু লোকের জন্যই এলাকার এরকম কুখ্যাতি। কিন্তু তিনি দোষারোপের করার সময়ে সব কিছুই ইঙ্গিতে বলেছিলেন। নয়তো ভাববাচ্যে। সবচেয়ে দর্শনীয় হল, ভদ্রলোকের সক্ষমতা। ষাটের বেশি বয়স। কিন্তু ভীষণ কর্মক্ষম। কথার মাঝে কোনও গরু জমির দিকে চলে গিয়েছিল, দেখতে পেয়েছিলেন। পাঁইপাঁই করে ছুট লাগালেন। ওই দৌড় অনেক তরুণকেও লজ্জায় ফেলে দেবে। এখনও ওই দৌড়ের কথা চোখে লেগে আছে। সিঁড়ির দু’ধাপ উঠতে গিয়ে যখন স্টিম ইঞ্জিনের মতো হাঁফ ছাড়ি, মোজেসের কথা মনে হয়। নিজের মধ্যপ্রদেশের দিকে তাকিয়ে সংকোচ হলেও ওই বৃদ্ধের দৌড়ের ছবি আমাকে লজ্জায় ফেলে দেয়। বৃদ্ধকে মনে পড়লে ওই সফরে আমার সঙ্গী ইন্দ্র আর শুভর একই অবস্থা হয় নিশ্চয়।

শুশুনিয়া পাহাড়ের পাথর শিল্পী।

খুব ছোটবেলায় আনন্দমেলায় একটা ভ্রমণ কাহিনি পড়েছিলাম, ‘জামু পারের জীবন বৃত্তান্ত’। লেখক বিক্রমণ নায়ার। কেনিয়া সফর নিয়ে লেখা। সেই প্রথম মাসাইদের সম্পর্কে জানা। তাদের পশুপালক জীবন, অতিথি আপ্যায়নের রীতি, সিংহ শিকারের গল্প পড়ে মুগ্ধ। কিন্তু আমার মনে ধরেছিল জামু পারে কে। জামু কেনিয়ার এক যুবক। লেখকের গাড়ি চালক। অত্যন্ত ভাল লোক। যখন ঘোরাঘুরি শুরু করলাম তখন প্রায়ই মনে হতো, সফরে জামুর মতো একটা চালক পাব, বেশ মজা হবে। কিন্তু বাস্তবটা বেশ কঠিন। গ্রুপের প্রথম বড় সফরে গাড়ি চালক আমাদের লুটে নিল। একেবারে রাস্তায় দাঁড় করিয়ে লোটা যাকে বলে। সেবার বাঁকুড়া সফরে গিয়েছিলাম। শুশুনিয়া মোড় থেকে ট্রেকারে শুশুনিয়া। স্ট্যান্ডে গাড়ি ঘোরাচ্ছেন চালক। আমরা যাব আরণ্যক গেস্ট হাউসে। জিজ্ঞাসা করলাম। উনি দেখিয়ে দিলেন। কিন্তু বুঝতে পারছিলাম না। একটু দিয়ে আসতে বললাম। সঙ্গে অনেক মালপত্র। চালক ৫০ টাকা হাঁকলেন। দুপুর রোদে তাই সই। কিন্তু গাড়িতে উঠলাম আর নামলাম। দূরত্বটা এতই কম যে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বন্ধ করে দিলে গড়িয়ে পৌঁছে যাওয়া যায়। কী আর করা। ৫০ টাকা দণ্ড নিয়ে সবাই কড়া চোখে ইন্দ্রর দিকে তাকিয়ে রইলাম। গাড়ির জন্য ঘ্যানঘ্যান ও-ই তো করছিল।

ভালকিতে তপিস্যার সেই ভ্যানো।

তা বলে কি জীবনে জামু পারের দেখা পাইনি? অনেক বার। প্রথম বার ভালকি মাচানে দেখা হয়েছিল তপিস্যার সঙ্গে। বা কপিস্যার সঙ্গে। নাম নিয়ে সে বড়ই কড়া। কিন্তু উচ্চারণ দোষে বা আমাদের কান চিনতে না পারায় ঠিক করে উঠতে পারিনি ওর নামটা আসলে কী। বন্ধু মিন্টু একবার ঠিক করার চেষ্টা করেছিল, তপস্যা? সে শুধু বলে, তপিস্যা। আর সেটা আমাদের কানে বাজে কপিস্যা হয়ে। নামে কী কাম। তপিস্যার, বা কপিস্যার, একখানা গাড়ি যা ছিল তাতেই মন খুশ। গাড়িটা ভ্যানো। কিন্তু তাতে স্টিয়ারিং লাগানো। বসলে হুড খোলা জিপের মতো অনুভূতি। আমি সামনে বসার চেষ্টা করেছিলাম। যাতে সেই অনুভূতি জাগে। কিন্তু মিন্টু কায়দা করে হটিয়ে দিয়ে জায়গা দখল করেছিল।

বিহারীনাথের জামু পারে।

ভালকি মাচানেই পরের বারে আরেক জামু পারের সঙ্গে দেখা। গুসকরা থেকে আমাদের ভালকিতে নিয়ে গিয়েছিল। বড় মায়াময় সে। ভালকি যেতে যে ভাড়া হেঁকেছিল তা আমাদের পোষায়নি। শখানেক টাকা কম বলেছিলাম। ও রাজি হয়নি। কিছুক্ষণ পরে এসে সে বলেছিল, ‘একশ টাকার জন্য কেন এমন করছেন?’ কথাটা এমন মায়ায় ভরা ছিল, আমরা রাজি না হয়ে পারিনি। ছোটখাট গাড়ি তার। ইন্দ্র, শুভ, দীপুর মতো হুমদোদের চাপে আমার আর বাবলার কী হাল! কিন্তু আমাদের জামু পারে খুব ভাল। কত গল্প শুনিয়েছিল। আমাদের সাহায্য করেছিল।

শুশুনিয়া ভ্রমণের সময়ে আমরা বিহারীনাথে গিয়েছিলাম। যে অটোচালক আমাদের বিহারীনাথ নিয়ে গিয়েছিলেন তিনিও খুব ভাল। নামটা জেনেছিলাম। এখন ভুলে গিয়েছি। আমাদের কত গল্প শুনিয়েছিলেন। আদিবাসীদের জীবন, তাদের শিকার পরব, স্থানীয় সমস্যা। তবে শুশুনিয়া পাহাড়ের কোলে দেখেছিলাম এক পাথরশিল্পীকে। একমনে পাথর কেটে থালা, বাটি, তৈরি করে চলেছেন। লোকে ঝরনার জল নিতে আসছে। পর্যটকেরা ঝরনা দেখতে আসছে। সামনের মন্দিরে পুজো হচ্ছে। কিন্তু তাতে কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই শিল্পীর। তিনি কর্মে মগ্ন।

মুরগুমার গাড়ির চালক তাপস আবার অযোধ্যা পাহাড়ে সামাজিক বৈষম্যের কথা শুনিয়েছিলেন। তখন পুজোর সময়। অযোধ্যা বাসস্ট্যান্ডে মেলা বসেছিল। খাবার দেখলেই ইন্দ্রর সমস্যা হয়। জিলিপি আর গুটলি গুটলি বেসনের বড়া। চপ আর কী। চেখে দেখার ইচ্ছে হয়েছিল। তাপস বারণ করল। বলল, ‘ওগুলো ভাল নয়। আদিবাসীদের জন্য তৈরি করা।’ কথাটা শোনার পরেই একটা অট্টহাসি আমার কানে এসেছিল। জঙ্গলমহলের হাসি! হাসি থামলে মনে পড়েছিল সাঁওতাল বিদ্রোহের কথা। ইতিহাসে পড়া সেই বিদ্রোহের অন্যতম কারণ ছিল, আদিবাসী সমাজকে উঁচুতলার মানুষগুলোর নানা ভাবে বঞ্চনা। সেই ট্র্যাডিশন কি সমানে চলিতেছে? কে জানে!

অযোধ্যার বসত।

বরন্তিতে দেখা হয়েছিল এক বৃদ্ধ দম্পতির সঙ্গে। শীতের বিষণ্ণ বিকেলে দু’জনের জলাধারের পাশের রাস্তায় ঘুরছিলেন। কলকাতায় বাড়ি। ঘোরাঘুরির গল্পই করেছিলাম। জিজ্ঞাসা করিনি, কেন আপনারা দু’জনে? আর কেউ নেই? ভয়েই করিনি। হয়তো সেই চেনা গল্পই বেরবে। মেয়ের বিয়ে হয়েছে বিদেশে। ছেলে ভিন রাজ্যে। বুড়ো বুড়ি একা পড়ে আছে। কিংবা বৃদ্ধা যদি গেয়ে ওঠেন, ‘ছেলে আমার মস্ত বড়…’।

জয়পুরের জঙ্গলে দেখা হয়েছিল একদল মহিলার সঙ্গে। আমরা সকালে হরিণ দেখতে বেরিয়েছি। আর ওঁরা কাঠ কুড়োতে বেরিয়েছেন। একদলের ভ্রমণ বিলাস। আরেক দলের জীবন যুদ্ধের উপকরণ তল্লাস। আমাদের হাতে ক্যামেরা দেখে নিজেরাই মজা করছিলেন, ছবি তুলছো, ভাল করে তোলো। জঙ্গলে কাঠ ভাঙা নিয়ে কোনও নিষেধাজ্ঞা আছে বোধহয়। এদিকে রোজকারের জীবন চালানোরও দায় রয়েছে। তাই হয়তো এমন মরিয়া ভাব। কচি, দীপু ক্যানেলের পারের ছবি তুলতে গেলে ওপারের জঙ্গলে কাঠ ভাঙা এক বৃদ্ধা ঘুরে দাঁড়িয়ে পোজ দিয়েছিলেন। মানে সেই ভাল করে তোলোর জেহাদ। জঙ্গলের ওপরে জঙ্গলবাসীর অধিকার আছে কি নেই? রাষ্ট্র আর নাগরিকের মধ্যে সমাধান না হওয়া দীর্ঘদিনের সমস্যা এটা।

জয়পুরের জঙ্গলের জীবন যোদ্ধারা।

ঘোরাঘুরিতে বহু মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। তাদের সকলের কথা লিখতে গেলে ইতিহাস। কিন্তু জয়পুরে বাসুদেববাটি বিট অফিসে যাওয়ার আগে দেখা হওয়া লোকটার কথা না বললেই নয়। ক্যানেলের পাড়ে একটা ঝুঁকে পড়া লম্বাটে টিনের ছাউনি দেওয়া ঘরে থাকে। ওই ঘরটা নাকি চায়ের দোকান! এখানে চা খায় কারা? সে প্রশ্নের জবাব মেলার আগেই চাওয়ালার দর্শন মিলল। লম্বা লোকটার পরনে ময়লা পোশাক। কিন্তু দু’হাতে নানা রঙের কাপড়ের ফেট্টি বাঁধা। গলায় নেকটাইয়ের মতো করে আরেকটা ফেট্টি। আমাদের ভ্যানোর সারথি বলল, ‘ওটা ওর স্টাইল। নানা কেত আছে লোকটার। সারাদিন গাঁজা খায় আর ঘরের সামনে বসে থাকে।’

শুনেই ভাল লেগে গেল। গাঁজাটা বাদ দেওয়া যাক। এমন নিরুদ্বেগে এই সুন্দর ক্যানেল পার, এই জঙ্গলে বসে থাকার একটানা সৌভাগ্য ক’জনের হয়! জীবন যে আমাদের প্রতি মুহূর্তে ‘দম লাগা কে হেঁইসা’ করে চলেছে!’

ছবি- ইন্দ্রজিৎ সাউ, দীপশেখর দাস, শুভ বৈদ্য

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *