পাহাড়িয়া বাঁশি বিশেষ ভ্রমণ

সুন্দরী সিকিমের সঙ্গ যাপন-তৃতীয় পর্ব

স্মৃতিমাধুরী দাস

বিষণ্ণ বিকেলের ছায়া দীর্ঘতর হয়ে নির্জীব হলদেটে আলো। প্রত্যেক বাঁকে বাঁকে অন্ধের দিক বদল। সে কিন্তু চোখ ফেরাতে দিচ্ছে না নিজের দিক থেকে। তার পায়ের কাছে শাড়ির পাড়ের মতো নেচে চলা লাচুং চু সঙ্গে চলল। চুংথাংয়ে লাচেন চু ওর সঙ্গে একপ্রাণ হলে নতুন নামে সকলে ডাকবে, তিস্তা। তখন কী উন্মত্ত রূপ তার! কিন্তু অমোঘ আকর্ষণ! বিরাট বড় বড় পাথর-তারাও তার নাচের ধকলে ক্রমশ পরিবর্তিত হতে হতে নুড়ি, তারপর বালি। সে রূপান্তর দীর্ঘসূত্রী। কিন্তু মানুষের লোভের জিভ অনেক লম্বা। তাই যন্ত্র বসেছে নদীর বুক থেকে পাথর তুলে সুবিধামত গুঁড়িয়ে নেওয়ার।

দেখছি লাচেন চু বাঁদিকে চলেছে। আর ডানদিকে মাঝে মাঝেই পাহাড়ি বাঁশের বাহারি জঙ্গল। রাস্তার উপরে ঝুঁকে পড়ে আলো-আঁধারি গ্রামের রাস্তার ভ্রম তৈরি করেছে। কিন্তু এ তো জাতীয় সড়ক!

পাকানো পথের এক বাঁক ঘুরে উঠে দেখি এক মা কোলের বাচ্চাটিকে নিয়ে দিব্যি নিশ্চিন্তে বসে খাদের কিনারে। ওদের পেরিয়ে চোখ হাঁটল উল্টোদিকের পাহাড়ে। সেখানে তখনও পাতলা পরত তুষারের। একটু নীচেই গাছেদের মাথায় মাথায় ছাতার মত মেঘপুঞ্জ। উপরে ঝকঝকে নীল চাঁদোয়া-আকাশ।

সন্ধে নামতে তখনও কিছুটা বাকি। পেরিয়ে এলাম অন্য একটা পাহাড়। থেমেছে যন্ত্রবাহন। চারিদিকে গাছেদের মজলিশ। পথের পাশে নাম না জানা ফুল। লাচেন পৌঁছলাম সন্ধে ছুঁয়ে। কাছেই হাইডেল পাওয়ার প্রোজেক্ট। অথচ লোডশেডিংয়ের দাপট কম নয়। টেবিলে মোমবাতি। জানলা খুলতেই ঘরে মেঘ। তাড়াতাড়ি পাল্লা বন্ধ করে পর্দা সরাই। প্রত্যন্ত এ গ্রাম ততক্ষণে অন্ধকারে ডুবে গেছে। কিন্তু এই অন্ধকারের টানও কি একটু বেশী? হবে নিশ্চই।

হোটেল ‘সো লামো’। আপ্যায়ন হোম স্টে’র। পরনের শীতপোশাক খুলিনি। সঙ্গে একটা লেপ, একটা কম্বলের উষ্ণতা। তা-ও হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি কাঁপুনি।

সকাল পৌনে পাঁচটা। তখনও অন্ধকার লেগে চারপাশে। উল্টেপাল্টে চেখে নেওয়ার আজকের দিন শুরু। প্রকৃতির একেবারে অন্দরমহলের পথ। কী তার বাহার! আলো বেড়ে উঠছে একটু একটু করে। দেখা দিচ্ছে ওদের তুষারঢাকা মাথা। পাকানো রাস্তা ঘুরে উঠতে উঠতে কোনও কোনও বাঁক থেকে দেখছি অনবদ্য ল্যান্ডস্কেপ। ছবির মতো পর্বতমালা। দু’দিক দিয়ে গিয়ে যেখানে মিশেছে তার মাথায় রজতমুকুট। কখনও বা তার আগের কয়েকজনও তাকে সঙ্গ দিচ্ছে। অন্যরা সবুজ ঝালরে ঝলমল করছে। নীচের উপত্যকা দিয়ে বয়ে চলেছে উচ্ছ্বসিত তরঙ্গিনী। যত উপরের দিকে উঠছি তত তার উদ্দামতা বাড়ছে। চলার পথে প্রবল নাচে ভরিয়ে দিচ্ছে দু’চোখ। পাহাড় পেরিয়ে পাহাড় পেরিয়ে গুরুদোংমার রোড। জাতীয় সড়ক। এ পর্যন্ত তার গায়ে পোশাক নেই। ধারে ধারে ইতিউতি দু’তিনঘর বাসিন্দা। কেউ গাই দুইছে, কেউ কাঁচা পাতা জ্বালিয়ে ধোঁয়া দিচ্ছে। নদীর ধারে নেমে যাওয়া বাড়ির উঠোনটিতে কারও একচিলতে চাষবাস। মুলো, বাঁধাকপি, সরষে, গাজর।

দীর্ঘ এলাকা পুরোই সেনাছাউনি। একটু পরপরই পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা রুপোলি ফিতের মত তুষারগলা ধারা। কোনও কোনওটি সরু দড়ির মত। গাঢ় সবুজ মখমলে যেন রুপোলি জরির বুনোট।

দেখতে দেখতে উঠে এসেছি ১৭০০০ হাজার ফুটের বেশি। আমুল বদল ঘটে গেছে প্রকৃতিতে। পাহাড় এখন রুক্ষ সুন্দর। যেদিকে চোখ যায় বরফ মেখে নিশ্চুপ অচলায়তন। সবুজের লেশমাত্র নেই। কোথাও কোথাও ছোট ছোট অগভীর গহ্বরে জমে আছে বরফগলা জল। বিস্তীর্ণ উপত্যকা রুক্ষ। মাঝখান দিয়ে চলে গেছে সরু জলধারা। মাটির লাগোয়া শুকনো ঘাস খেতে অসংখ্য ইয়াক আপন খেয়ালে চরে বেড়াচ্ছে। রোদ উঠেছে চড়চড়িয়ে। বরফ নেই আজ। আপাদমস্তক বরফের চাদরে সেজে দাঁড়িয়ে আছে ভারত-চীন সীমান্তের পর্বতমালা। তাদের গায়ে প্রতিফলিত হয়ে তেজিয়ান রোদ। ১৭২০০ ফুট। দাঁড়িয়েছি অপরূপের সামনে। তার সৌন্দর্যের কাছে হার মেনেছে শ্বাসকষ্ট। গুরুদোংমার হ্রদ। স্ফটিকস্বচ্ছ জল। হ্রদের তিনদিক ঘিরে তুষারাবৃত পর্বতমালা। মাথার উপরে ঝকঝকে নীল আকাশ প্রতিফলিত হচ্ছে হ্রদের জলে। অসহ্য সুন্দর। আর কি এ জীবনে কখনও তোমার কাছে এভাবে আসা হবে!

তিনদিন পরে আবার গ্যাংটক।এবারের মতো শেষবার সন্ধেবেলার ম্যাল।

নামচি যাওয়ার পথে রোদের মিতালি। কিন্তু শুরুতেই বিপত্তি। চালকের কানে তখন চলভাষ ট্রাফিকপুলিশের তীক্ষ্ণ নজরবন্দি। কোনও কথা নয়, কোনও পারিতোষিক নয়।লাইসেন্সটি জমা দিতে হল।পরবর্তী পথটুকুতে কি তা বলে চলভাষ অচল থাকল? তা নয়, তবে ব্যবহৃত হল নামমাত্র। এ রাজ্য হলে? সে অবান্তর প্রসঙ্গ।

সুন্দরের উপর মন রাখি। বাঁক ঘুরলেই নতুন ছবি। দু’দিকে সুউচ্চ পাহাড়, একেবারে নীচে গভীর উপত্যকা দিয়ে সরু সুতোর মত তিস্তা। বর্ণনা করে বোঝানো যায় না। শুধু মনের সিন্দুকে যত্নে তুলে রাখতে হয়। বাঁকের মুখে নিজে নিজে বেড়ে ওঠা ফুলের গাছ, কসমসের মত দেখতে, হলুদ রঙে চোখধাঁধানো। রাস্তা থেকে উপরের দিকে তাকালে ঢালে ঢালে ছোট ছোট সুন্দর বাড়ি, পরপর স্কোয়াশের চাষ। মাচা ভরে ঝুলে আছে গাঢ় সবুজ, হালকা সবুজ, ঘিয়ে রঙা স্কোয়াশ।

চারধাম, নামচিতে মানুষের তৈরি দ্রষ্টব্য। বছর ছয়েক মাত্র বয়স তার। ধর্মীয় তাস পর্যটনমঞ্চে। নান্দনিক প্রকৃতির মধ্যে মানুষিক নন্দনতত্ব। বিশালবপু কিরাটেশ্বর বহু দূর থেকে নয়নপথগামী। প্রাঙ্গন থেকে দৃষ্টিপথজুড়ে শুধু অপরূপ প্রকৃতিতে মেঘ রোদের লুকোচুরি খেলা। সামদ্রুপসেও এ রকমই। পার্থক্য-সেখানে বুদ্ধদেব আসীন।

রাবাংলাতেও (আসলে রাভং লা) প্রকৃতি অপরূপ। মেঘপিয়নেরা বাহুবল দেখাতে প্রস্তুত। বুদ্ধপার্ক চেখে নেওয়ার অবসরে একেবারে মেঘের ঘেরাটোপে বন্দি হয়ে পড়লাম বেশ কিছুক্ষণের জন্য। অভূতপুর্ব অভিজ্ঞতা।

আপার পেলিংয়ে মূল উদ্দেশ্য কাঞ্চনজঙ্ঘাকে কাছ থেকে দেখা। কিন্তু এত সহজ কি তার দেখা পাওয়া যায়? মেঘের পর্দার আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রাখাই তার দস্তুর। এই ফাঁকে গোটা দিন লোয়ার পেলিং, আপার পেলিং দেখে কাটালাম। লোয়ার পেলিংয়ে রিম্বি ঝরণা মিশেছে গিয়ে রিম্বি নদীতে। রিম্বি নদী চঞ্চল তরুণী। তার তীরে পাহাড়ের ঢালে কমলালেবুর বাগান, এলাচের ধাপচাষ। সবুজ কমলালেবুতে ভরে আছে গাছ। এলাচের দেখা মিলল না। ঢালে কোথাও কোথাও আখরোট ভরা গাছ। কাঞ্চনজঙ্ঘার শরীর থেকে নেমে আসা দুরন্ত কাঞ্চনজঙ্ঘা ফলসের সঙ্গে দেখা হল। আরও আছে মিথ-আদিমতা-জঙ্গলে জড়ামড়ি খেচিওপালরি হ্রদ। শিক্ষার্থী লামা (নিতান্তই অল্পবয়স) এবড়োখেবড়ো বনপথে পিঠে বয়ে নিয়ে চলেছে কাঁচা পাতা, শুকনো ডালপালার ভারী বস্তা। হ্রদের প্রবেশমুখে পুণ্যলোভী পর্যটক। মাছেদের খাবার খাইয়ে মনস্কামনা পূরণে ব্যস্ত। পাহাড় জঙ্গলের মধ্যে স্বাভাবিক প্রস্রবণের জলাশয়। লোকমুখে খেচিপেরি লেক।

শহর থেকে মাত্র পাঁচ কিলোমিটার।আপার পেলিংয়ে এশিয়ার দ্বিতীয় উচ্চতম ঝুলন্ত সেতু সিংসোর ব্রিজ। দৈর্ঘ্যে ২০০ মিটার। ৭২০০ ফুট উঁচুতে ঝুলন্ত। সেতুর মাঝখানে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক নীচে তাকালে ঝরণা, নদী, অরণ্য উপত্যকার দমবন্ধকরা ফ্রিজশট।

গোছগাছ রাতেই শেষ। সকালের জন্য শুধু স্নান আর জলখাবারের পর্বটুকু রাখা। ভোরবেলা জানলার পর্দা সরাতেই তার আভাস। উত্তেজনায় গলার পারদ চড়ল। অন্য দু’জনকেও হাঁকডাক করে তুলে দিয়ে সকলে মিলে লাগোয়া বারান্দায়। তারপর ঘণ্টাদুয়েক ধরে শুধু তার রূপবদল চাক্ষুষ করা। প্রথম দেখা দিল মেঘের চিকের আড়ালে। ক্রমশ সরল মেঘ। আগুনের গোলার মত সুর্য লাফিয়ে বেরিয়ে এল অন্ধকারের আড়াল ছিঁড়ে। তার মুকুটের রং বদলাতে থাকল। সোনালি মুকুটের বিস্তীর্ণ রেঞ্জ একেবারে চোখের সামনে। ইচ্ছে হচ্ছে হাতটা লম্বা করে বাড়িয়ে একবার ছুঁয়ে দিই।

কাকস্য পরিবেদনা। উপায়বিহীন বলে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চোখে, মনে, সবটুকু সত্তায় শুষে নিতে থাকি অমল সৌন্দর্য্। কাঞ্চনজঙ্ঘার সে ঝলক তোলা রূপ এ জীবনের সম্পদ হয়ে থাকল।

ছবি-লেখিকা

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *