ইতিহাস ছুঁয়ে বিশেষ ভ্রমণ

মন্দির নগরীতে অষ্টাদশ টোটোআরোহী

দীপক দাস

অবস্থাটা হয়ে দাঁড়াল নতুন রান্না শেখা কন্যের মতো। এতদিন ঘরে রেঁধেছে। বাবা, কাকা, ভাই-দাদার প্রশংসা পেয়েছে। এবার মেয়ের রান্নার হাত কেমন সেটা জানতে মা তার বান্ধবীদের নেমন্তন্ন করে বসেছে। কন্যে তো টেনশনে ঘেমেনেয়ে একসা!

১৫ অগস্ট ঘুরতে যাওয়ার আগে আমার অবস্থা। এমন হওয়াটাই স্বাভাবিক। এবার দল বাড়তে বাড়তে দাঁড়িয়েছে ১৮ জনে। দলের সবচেয়ে বড় সদস্য ৫৫ বছরের। ইন্দ্রর মা। সবচেয়ে ছোট সদস্য পাঁচ বছরের। ইন্দ্রর ভাইপো অনীক। এতজনের মনের যথাসম্ভব খোরাক জোগানো বেশ চাপের। তাছাড়া নতুন কয়েকজন সদস্যও এবার দলে যোগ দিয়েছে। চাপ আরও বেশি। টেনশনে মনে মনে উতলা হচ্ছি সেইসময়েই ফোনটা এল। ধীরস্থির, নিরীহ গলায় একটা জিজ্ঞাসা, ‘দাদা, ঘুরতে যাওয়ার কোনও ড্রেস কোড আছে? আমি যদি হাফপ্যান্ট পরে যাই?’ ঘুরতে যাওয়ার ইউনিফর্মের কথা বলছে নাকি! মার ব্যাটাকে। ফোনেই বাক্যস্রোতে আচ্ছা করে ধুইয়ে দিয়ে আমিও শান্ত হয়ে গেলুম। তারপর নানারকম আধুনিক পোশাকের সুলুকসন্ধান দিয়ে বললুম, ‘যা খুশি পরতে পারিস। নিজেকে সামলাতে পারলেই হল।’ ইনি কে? দলের লোকেরা এতক্ষণে নিশ্চয় বুঝতে পেরেছে। তবে ওই ফোনেই আমার চাপ কিছুটা কমেছিল। যাক, মজার মুডেই আছে দলের নিয়মিত সদস্যেরা।

স্বাধীনতা দিবসে এবার দুই বৈষ্ণব নগরীতে, মন্দিরনগরীও বলা যায়, সফর ঠিক হয়েছিল। গুপ্তিপাড়া আর কালনা। দেবদ্বিজে ভক্তি আমাদের দলের কতজনের আছে সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ। কিন্তু ভোজনরসিক অনেকে। খোঁজখবর নিয়ে জেনেছি, ওই এলাকায় দু’টো মিষ্টির খুব নাম।

গুপ্তিপাড়ায় রামচন্দ্র মন্দির।

যাত্রার শুরুটা প্রায় ঠিকঠাকই ছিল। লেট লতিফ ইন্দ্রকে জব্দ করতে সামান্য মিথ্যাচার করেছিলাম। হাওড়া থেকে কাটোয়া লোকাল সকাল ৭.৫৫য়। আমি সাড়ে ৭টা বলেছিলাম। এবার গোটা সাউ ফ্যামিলি চলেছে আমাদের সঙ্গে। ইন্দ্রর মা, দাদা-বৌদি, ভাইপো-ভাইজি মিমি আর অনীক, ইন্দ্রর মামার ছেলে দেবব্রত। লটবহর নিলে লেট হতেই পারে। তবে ঘটনা হল, স্টেশনে আসা সাউ পরিবারের শেষতম ব্যক্তিটি ইন্দ্রই। নিজের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী ঠিকঠাক। তবে দলের অনিয়মিত সদস্য জয়ন্তীদি রীতিমতো হৃদকম্প তুলে দিয়েছিল। আমরা স্টেশনে। দূরে ট্রেনের মুখও দেখা দিয়েছে। সেইসময় ফোন এল জয়ন্তীদি আসছেন। বাইকে করে। কী কাণ্ড! হিন্দি সিনেমার মতো ট্রেনের পাশে পাশে বাইক চালিয়ে তারপর সুযোগ বুঝে ঝাঁপ দেবে নাকি! শেষপর্যন্ত জয়ন্তীদির ভাই ট্রেন ধরিয়ে দিতে পেরেছিলেন।

তবে দেরি এবং ট্রেন ফসকানো আমাদের ললাটঙ্ক লিখনং। গুবলেটটা করল আমার কনিষ্ঠ সহোদর। গ্যাজেটের স্তূপের বাইরেও যে দুনিয়া আছে সেটা হঠাৎই মনে হয়েছে তাঁর। তাই আমাদের ধন্য করছেন। মধ্যম সহোদরটিও আছেন। বাড়িতে থাকলে ফেসবুকে ভিডিও দর্শন এবং রিসেপশনিস্টের ভূমিকায় দেখা যায় তাকে। অনবরত ফোন ধরে চলেছেন। সেসবে বোধহয় কিঞ্চিৎ অগ্নিমান্দ্য দেখা দিয়েছিল। বা অন্য কোনও কারণও থাকতে পারে। তাই তিনিও সঙ্গী। কনিষ্ঠটির এক সহকর্মীরও হাওড়া থেকে যোগ দেওয়ার কথা। আমি সকলকে সাড়ে ৭টা বললে কী হবে উনি আবার গুগল করে ট্রেনের আসল সময়টি পাঠিয়ে দিয়েছিলেন সহকর্মীকে। একে বাঙালি তায় মেয়ে। ফলে তৃষাণী এল ৮টার ট্রেনের সময় মেপে। ফলে সাড়ে ৭টার ব্যান্ডেল লোকালটি ফস্কালাম। ওটা পেলে কিছুটা এগিয়ে থাকা যেত।

তারপর ট্রেনে যা হয় আরকী। ইয়ার্কি, ঝালমুড়ি…। ছুটির দিন হলে কী হবে ট্রেনে বেশ ভিড়। এর মধ্যে দরজায় মুখ বাড়িয়ে কী করে ব্যান্ডেল থেকে বাকিদের তুলব কে জানে! ততক্ষণে জেনে গিয়েছি, আমাদের গ্রুপের দ্বিতীয় শাখা ব্যান্ডেলে অপেক্ষা করছে। হুগলি স্টেশন থেকেই ট্রেনের দরজার কাছে যাওয়ার চেষ্টা করছি। কিন্তু পারিনি। ট্রেন তখন ব্যান্ডেলে ঢুকবে বলে সবে গতি কমিয়েছে। একটা ছেলে একবার ডানপাশের দরজা আরেকবার বাঁপাশের দরজায় দাঁড়াচ্ছে। উঁকিঝুঁকি মারছে। বারবার যাতায়াতে বিরক্ত হচ্ছি। আরেকবার দরজা বদল করতেই আমি রাগ রাগ চোখে ছেলেটার দিকে তাকালাম। তবে ওর চেহারার দিকে তাকিয়ে মুখে কিছু বলার সাহস হয়নি।

গুপ্তিপাড়া স্টেশন।

ব্যান্ডেল এল। শাখা অফিস একই কামরায় উঠলেও দরজাটা ছিল অন্য। আমি শুভকে, মানে কচিকে ফোন করে পূজা আর দেবপ্রিয়াকে আমাদের দিকে পাঠিয়ে দিতে বললাম। ওদের বসার জায়গা করে দেওয়া হবে। মেয়ে দু’টি নতুন সফরসঙ্গী। পূজা কচির দিদি। প্রকৃত সহোদর-সহোদরা এরাই। একই সঙ্গে মাতৃগর্ভে আশ্রয় নিয়েছিল। তবে পূজার আত্মপ্রকাশ আগে। জনশ্রুতি, কচি পূজার থেকে আড়াই মিনিটের কচি। দেবপ্রিয়া ওদের বন্ধু। আমাদের গ্রুপে ‘আন্দামানে ২০ টাকার নোটের দ্বীপে’র লেখিকা। ভিড় ঠেলে ওরা দু’জন আমাদের দিকে আসছে দেখলাম। তখনই ঘটনাটা ঘটল। দেবপ্রিয়া এ দরজা ও দরজায় শাটল ককের মতো লাট খাওয়া ছেলেটিকে দেখিয়ে বলল, ‘দাদা, শাশ্বত।’ এই রে! ছেলেটা আমাদেরই দলের? তার ওপর আত্মীয়! ভাগ্যিস কিছু বলিনি। তাহলে তো সেমসাইড হয়ে যেত। এখন বুঝতে পারছি, বেচারার দোষ তো ছিল না। টেনশন ছিল। আত্মীয়পরী(জন) যদি ট্রেনে উঠতে না পারে!

গুপ্তিপাড়ায় নেমে দুই শাখার মহাসম্মেলন হল। আমি ফের একসঙ্গে তিন বালককে দেখতে পেলুম। জয়পুরের জঙ্গল তোলপাড় করে আসা সেই ত্রিমূর্তি, জুয়েল-কচি-আর অরিজিৎ। অনেকদিন পরে দেখা। গলা জড়াজড়ি এবং লেগপুলিং যুগপৎ শুরু। জানিয়ে রাখি, ব্যান্ডেল থেকে ওঠা পুরো দলটাই অধুনা হিমালয়বাসী দীপুর সহপাঠী-সহপাঠিনী।…

এখনকার স্টেশনগুলো দেখে অনেক সময় সেই এলাকার বৈশিষ্ট্য বোঝা যায়। গুপ্তিপাড়া স্টেশন দেখেই বুঝলুম, বেশ ধর্ম ধর্ম একটা ভাব আছে। স্টেশন বিল্ডিংয়ে মন্দিরের ছবি। এবার মন্দির দর্শনের পালা। কিন্তু ঘোরা হবে কীসে? এখানে পর্যটন যান বলতে তো টোটো, রিকশা আর ভ্যানো। যেটাই ভাড়া করি না কেন দল ভেঙে যাবে। আমার পছন্দ ছিল ভ্যানোর। ইঞ্জিনচালিত এই ভ্যানগুলো চাপলে বেশ হুড খোলা জিপের মতো লাগে। আমরা জয়পুর যাত্রীরা ভ্যানোর দিকেই ঝুঁকেছিলাম। কিন্তু ইন্দ্রর মা, বৌদি আর বাচ্চাগুলোর কথা ভেবে ভ্যানো বাতিল হল। হুড খোলা জিপ থেকে কেউ হুট করে ছিটকে পড়লে বিপদ। ফল, টোটো। চারটে। টোটো টো টো করতেই বুঝতে পারলুম, ভুল হয়ে গেছে। বড়সড় ভুল। তার ফল ভোগ করতে হবে।

বৃন্দাবনচন্দ্রের মন্দির। গুপ্তিপাড়া।

অন্য সফরে আমরা খাওয়াকে তত গুরুত্ব দিই না। আগে ঘোরা। তারপর খাওয়া। ব্যাগে রেশন থাকে। পিত্ত রক্ষা করতে মাঝে মুখ চালালেই হল। কিন্তু এবারে সেটি করার উপায় নেই। দলে বাচ্চারা আছে। ট্রেনে এক বৃদ্ধের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। তিনি জানিয়েছিলেন, এখানকার বড়বাজার নামে জায়গায় একটি দোকানে ভাল কাঁচাগোল্লা পাওয়া যায়। আমরা যা মাখা সন্দেশ হিসাবে চিনি, সেটাই এখানে কাঁচাগোল্লা নামে পরিচিত। ঢোকা হল সীতারাম ওঙ্কারনাথ মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে। মিষ্টি মিষ্টি আলু ছেঁচকি আর গরম কচুরি মিলল। তখন আর কেউ মাখা সন্দেশ খেতে চাইল না। পরে খাওয়ার জন্য প্যাকেটে নিয়ে নেওয়া হল। কিন্তু সেই সন্দেশ ব্যান্ডেল শাখা আর জিভের নাগালে পায়নি। হাওড়া শাখার তৃষাণীও বোধহয় পায়নি।

গুপ্তিপাড়ায় কোথায় কোথায় ঘুরব সেটা আগেই ঠিক করে নিয়েছিলাম। জানি, গুপ্তিপাড়ার রথ সুখ্যাত। কিন্তু রথযাত্রা মোটামুটি একইরকম হয়। লোকারণ্য এবং ধুমধাম। আমরা একটু ইতিহাস আর নির্জনতার আশ্রয় পেতে ভালবাসি। তাই সোজা গুপ্তিপাড়ার বৃন্দাবনচন্দ্র মঠে। বাকিদের কথা বলতে পারব না। কিন্তু মঠটা এক ঝলক দেখেই আমার ভাল লেগে গেল। ঢোকার মুখে পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ বিভাগের বোর্ড বলছে, অন্ত্য-মধ্যযুগের তৈরি বৈষ্ণব মন্দির এগুলো। চুন-সুরকির গাঁথুনির মোটা মোটা দেওয়াল। ভিতরের ঢুকলেই পুরনো বাড়ির একটা ঠান্ডা, সোঁদা গন্ধে মন কেমন করে। মঠে প্রচুর গাছপালা। ফলে ছায়া আর মন্দিরের ঠান্ডা ভাবে প্রশান্তি আসে। সেদিন আমাদের সঙ্গে শত্রুতা করে রোদ্দুর যা তেজ দেখাচ্ছিল।

বৃন্দাবনচন্দ্র মঠে স্বাধীনতা দিবস পালন। মঠের মোহন্ত গোবিন্দানন্দ পুরী।

মন্দিরের মোহন্তের পরিচালনায় একদল বাচ্চা স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করছে। আমরা তাদের পিছনে ফেলে ঢুকে গেলাম মন্দির চত্বরে। এখানে মোট চারটে মন্দির আছে। মঠের নামই বৃন্দাবনচন্দ্র। সুতরাং, একটি মন্দির বৃন্দাবনচন্দ্রের। তিনি ছাড়াও বাকি তিন মন্দিরের অধিষ্ঠাতা রামচন্দ্র, কৃষ্ণচন্দ্র এবং চৈতন্যদেব। চারটে মন্দির ঘুরে, ছবি তুলে ক্লান্ত হয়ে গেলাম। রামচন্দ্রের মন্দিরের গায়ে টেরাকোটার কাজ আছে। পোড়ামাটির কিছু মূর্তিগুলো কোনও না কোনও ঘটনার কথা প্রকাশ করছে। কিন্তু অজ্ঞতার কারণে সেই গল্পের সূত্র ধরতে পারিনি। দেদার ছবি তুলল কচি আর ইন্দ্র মিলে। প্রায় সবার হাতেই স্মার্টফোন। ফলে সবাই আলোকচিত্রী। ইন্দ্র এবার ক্যামেরার স্ট্যান্ডটা মনে করে নিয়েছিল। তাতে ক্যামেরা লাগিয়ে কচি কয়েকটা গ্রুপ ফটো তুলল। কিন্তু দলটা এত বড় যে কচি সবাইকে ঠেসেঠুসে ক্যামেরায় ঢোকাতে পারছিল না। হবেই বা কী করে! শাশ্বত ছ’ফুটের বিগ বি। আর অনীক দেড় ফুটিয়া। দলে বৌদির মতো মোটা ইয়ে মানে পৃথুলা তো জুয়েলের মতো দেশলাই শলাকা। এত বৈচিত্র দু’হাতে জড়ো করতে গেলে দু’একটা হাত ফসকে গলে যাবেই।

বেরনোর আগে মঠের মোহন্ত গোবিন্দানন্দ পুরীজির সঙ্গে কথা হল। দীর্ঘক্ষণ। মঠের ইতিহাস, নানা ষড়যন্ত্র মামলা মোকদ্দমার কাহিনী। আমাদের আবার আসতে বললেন। আগের দিনেই ছিল জন্মাষ্টমীর পুজো। আমাদের তালের বড়া আর মিষ্টি দিলেন। সেসবের ভাগও ব্যান্ডেল শাখা আর তৃষাণী পায়নি। ব্যাগেই রয়ে গিয়েছিল। কার ব্যাগে যেন?

মোহনলালের স্মৃতিফলক।

গুপ্তিপাড়া থেকে মঠে আসার পথে ডানদিকে একটা উঁচু ঢিবি মতো জায়গা পড়ে। মঠেক কাছেই। সেখানে দেখতে পাবেন দু’টো স্মৃতিফলক। একটা পুরনো, একটা নতুন। অনুরোধ, ওই স্মৃতিস্তম্ভের কাছে অবশ্যই একবার থামবেন। মোহনলালের স্মৃতিস্তম্ভ এগুলো। মোহনলাল, পলাশির যুদ্ধের মোহনলাল। নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিশ্বস্ত সেনাপতি। কথিত আছে, গুপ্তিপাড়ায় জন্ম মোহনলালের। পলাশির যুদ্ধে হারের পরে তিনি গুপ্তিপাড়ায় পালিয়ে এসেছিলেন। বৃন্দাবনচন্দ্র মঠে নাকি লুকিয়ে ছিলেন। স্বাধীনতা দিবসের দিন। তার ওপর এখন দেশভক্তির রমরমা। তার ওপর মীর জাফরদের সংখ্যাও নেহাত কমতি নয়। এমন পরিস্থিতিতে মোহনলালের স্মৃতিস্তম্ভের সামনে দাঁড়িয়ে বেশ অন্যরকম বোধ হচ্ছিল।

একই অঙ্গে অনেক রূপ গুপ্তিপাড়ার। ঘোরার সময়ে মনে হয়নি। লেখার সময়ে বুঝতে পারছি না, কোন রূপটিকে ধরব। এমনিতে বৈষ্ণবীয় ভাবরসে প্রভাবিত নগরী হিসাবে পরিচিত গুপ্তিপাড়া। কিন্তু এখানেই ভারতের প্রথম বারোয়ারি পুজোর প্রচলন হয়। জগদ্ধাত্রী কিন্তু শক্তির দেবী। সালটা ১৭৯০। কারও দাবি, ১৭৬০। এলাকার জমিদার সেন বংশ। কোনও কারণে সেই বছর সেন বংশের বাড়ির দুর্গাপুজোয় এলাকার কয়েকজনকে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। সেই ক্ষোভেই তাঁদের ১২ জন বন্ধু মিলে পাড়ার লোকের থেকে চাঁদা তুলে পুজো শুরু করেন। বারো ইয়ারের (বন্ধুর) পুজো তাই বারোয়ারি। যা এখন বারো থেকে বারোশোয় পৌঁছছে। এবং নাম বদলে সর্বজনীন হয়েছে।

গুপ্তিপাড়ায়  বারোয়ারিতলায় আঠেরো ইয়ারি বৈঠক। ক্যামেরাম্যান অবশ্য দাঁড়িয়ে।

বারোয়ালিতলাটি অতি ছিমছাম। একটা মাঠের মধ্যে একচালা মন্দির। লোকেরা একে বিন্ধ্যবাসিনী মন্দির হিসাবেই চেনেন। মন্দিরের পাশের রাস্তার পরেই জমি। সেখানে চাষিরা পাট কাচছেন। রাস্তাঘাট ভালো নয়। মন্দিরে আসার একটু আগে আরেকটা মন্দির দেখেছি। মন্দির চত্বরে একটা বটগাছ। তাতে প্রচুর বাদুড়। মানে এলাকাটা খুব একটা কোলাহল মুখর নয়। সারা দেশে বারোয়ারি পুজো মানেই প্রবল মোচ্ছব। সেখানে প্রথম বারোয়ারিতলার এই হাল! লোকে ইতিহাস ভুলেছেন না প্রথম বারোয়ারি ‘ল অফ অ্যাভারেজে’ পড়ে গৌরব হারিয়েছে বুঝতে পারলাম না।

ঘুরতে যাওয়ার সবচেয়ে বিরক্তকর অংশ কী বলুন তো? থাকা-খাওয়া? ওসবকে মোটেও পাত্তা দিই না। রাস্তায় রাত কাটানোর ভাবনা নিয়েই বেরোই আমরা। কিন্তু গাড়িওলাদের সঙ্গে দরকষাকষিটা বিরক্ত লাগে। বারোয়ারিতলা থেকে বেরিয়ে সেনবাড়ি দেখার পর সেই বিরক্তিটা ধরতে শুরু করল। গুপ্তিপাড়া থেকে টোটোতেই কালনা যাব। কিন্তু দরে আমাদের বা টোটোওলা কারওদেরই পোষাচ্ছে না। দরাদরির কাজটা ইন্দ্রই করে। এবার ওর দাদা বাপিও লেগেছে। কিন্তু কাত করতে পারল না দু’ভাই। আমি একবার সেন্টু খাইয়ে কার্যসিদ্ধির চেষ্টা করলুম। জুয়েলকে ডেকে আনলুম। সে বাবু তখন লাল গেঞ্জি, লাল টুপি, কার্গো প্যান্টুল আর কালো চশমা পরে গম্ভীর মুখে প্রাচীন বাড়ি ঘুরে দেখছে। ওকে বললুম, শীগগির চশমা, টুপি খোল। ঘাবড়ে গিয়ে জুয়েল সেসব খুলে ফেলল। ব্যাটাকে ধরে নিয়ে টোটোওলাদের কাছে হাজির করে বললুম, ‘এর চেহারা দেখেছেন। যে টাকা চাইছেন সেটা আমরা দিতে পারলেও এ দিতে পারবে না। ভাল করে খাওয়াদাওয়া করে না।’ টোটোওলারা মহা ঘোড়েল। আমার কাঁচা রসিকতায় হাসলেন কিন্তু দাম ছাড়লেন না। অগত্যা…

ব্যাট ম্যান-ওম্যান। বাদুড়ের খোঁজে।

টোটো ছাড়ল আবার। চলল কালনা। এর ফাঁকে এলাকার দিকে একটু নজর করা যাক। প্রাচীন নগরী গুপ্তিপাড়া। এখনও তার মূলের অনেকটাই বজায় রেখেছে। প্রচুর গাছপালা, আমবাগান, বাঁশঝাড়। আমবাগানের পাশে খেলার মাঠ। জায়গায় জায়গায় বাঁশ টাঙিয়ে পাট শুকোতে দিয়েছেন চাষিরা। পাটকাঠির গোছাগুলো রাস্তার পাশে সার দিয়ে দাঁড় করানো। সেগুলোও শুকোচ্ছে। অনেক পুরনো পুরনো বাড়ি। একনজরেই তার প্রাচীনত্ব বোঝা যায়। একটা জায়গার নাম দেখলাম, মালোপাড়া। গুপ্তিপাড়া গঙ্গা আর বেহুলার নদীর জলে সমৃদ্ধ। তাই এখানে মৎস্যজীবী মালোদের নিজস্ব পাড়া থাকাটাই স্বাভাবিক। পাড়াটার একটা দারুণ বৈশিষ্ট্য আছে। যতদূর দেখেছি, মনে হয়েছে, আঙিনায় গাছ লাগানো নেই এমন একটা পাড়াও এখানে খুঁজে পাওয়া যাবে না।

কালনায় পৌঁছনোর আগে গুপ্তিপাড়ায় গঙ্গার ধারে ছোট্ট একটা মজার ঘটনা ঘটেছিল। আমরা তো নদী, লঞ্চের পারাপার, ডাঙায় তোলা নৌকা দেখছি। চলছে ছবিছাবা তোলা। এখানে গঙ্গা তিনটে শহরকে জুড়েছে। আমরা দাঁড়িয়ে আছি হুগলিতে। লঞ্চ যাচ্ছে নদীয়ার শান্তিপুরে। গঙ্গা আসছে বর্ধমানের একটা জায়গা থেকে। কালনা কি? ভুলে গেছি। হঠাৎ শুনতে পেলাম, দেবপ্রিয়া বলছে, ‘অরিজিৎ যাবি?’ লঞ্চে করে শান্তিপুর যাওয়ার ইচ্ছে আমারও ছিল। শান্তিপুরী ধুতি কিনে আমরা ছেলেরা পরতুম। আর মেয়েরা পড়ত তাঁতের শাড়ি। তারপর ফটোসেশন। স্বাধীনতা দিবসে দারুণ ব্যাপার হতো। হঠাৎ খটকা লাগল। শুধু অরিজিৎ যাবে কেন? একটু তলিয়ে দেখতে বুঝলুম, শান্তিপুর শুধু অরিজিতের জন্যই। ওর মনকেমন ওখানে।

কালনায় যখন পৌঁছলাম তখন দলের অর্ধেক লোক কাত হয়ে পড়েছে। খিদেয়-ক্লান্তিতে। তারা অল্প ঘুরেই ছায়া দেখে বসে পড়ল। আর আমরা কয়েকজন শুরু করলুম ঘোরা। কত মন্দির। কতরকমের কারুকার্য। প্রতাপেশ্বর, পঞ্চরত্ন (পাঁচটি মন্দির একসারিতে), কৃষ্ণচন্দ্র, লালজি, বিন্ধ্যবাসিনী কত মন্দির। প্রত্যেকটি আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্যের। মন্দিরের খিলানে, গায়ে পোড়ামাটির কাজ। সেসব না দেখে ফিরে যাওয়া যায় না। ঘুরে দেখা, ছবি তোলা শুরু হল। সেইসঙ্গে খুনসুটি। এখানে মন্দিরগাত্রে পোড়ামাটির মূর্তিতে কাহিনী বলা হয়েছে। কিন্তু অজ্ঞতার কারণে সেসব বোধগম্য হল না। পরে অবশ্য একটা গাউড বুক থেকে মন্দিরগুলো সম্পর্কে কিছুটা জ্ঞানলাভ হল।

জানলুম, প্রতাপেশ্বর মন্দিরটি মহারানি প্যারিকুমারী তাঁর স্বামী প্রতাপচাঁদের নামে তৈরি করেন। এই প্রতাপচাঁদকে নিয়েই ইতিহাসখ্যাত জাল প্রতাপচাঁদের কাহিনী। মারা যাওয়ার পরেও যিনি সন্ন্যাসী রূপে ফিরে এসে বর্ধমান মহারাজের সম্পত্তির দাবি করেছিলেন। মন্দিরটির নির্মাণশৈলী সারা ভারতে আলোচ্য।

প্রতাপেশ্বর মন্দির। কালনা।

বাইরের মন্দিরগুলো দেখেশুনে ঢুকলুম বিন্ধ্যবাসিনী মন্দিরে। দেখি, দুর্গার মতো প্রতিমার পুজো চলছে। জানা গেল, ইনিই বিন্ধ্যবাসিনী। তাঁর পুজো এইসময়েই হয়। বেশ প্রাচীন মন্দির। এই মন্দিরগুলো সবই বর্ধমানের মহারাজাদের অর্থে তৈরি। বহু অর্থই ব্যয় করেছিলেন তাঁরা।

আমরা ঘুরে দেখতে দেখতে পুজো শেষ। পুরুতমশাই গোছগাছ করে নিচ্ছিলেন। দুই মধ্যবয়সী মহিলা থালা এবং থলিতে ফলমূলের ভার রেখেছেন। তাঁদেরই একজন হাঁক দিলেন, ‘চলে এসো?’ শুনেই হাত দু’টো চরণামৃত নেওয়ার মতো করে জড়ো করে ‘দাও দাও’ বলে এগিয়ে গেল জুয়েল। ভেবেছিল, প্রসাদ দিতে ডাকছে। আসলে ওই ডাক ছিল বের করে দেওয়ার। মন্দির বন্ধ হবে এবার। হতাশ জুয়েল হাত দু’টো পিছনে লুকিয়ে স্মার্টলি ঘোরাফেরা শুরু করল।

মন্দির চত্বরে অনীক আর মিমি।

জুয়েলের ব্যর্থতা প্রাণে বেজেছিল জয়ন্তীদির। আমাদের মাতৃসমা দিদি। প্রসাদ আদায়ে দিদি এগিয়ে এল। ওই দুই মহিলার কাছে গিয়ে দুখখু দুখখুভাব করে বলতে শুরু করল, ‘ছেলেটা খুব কষ্ট পেল। ও প্রসাদ খুব ভালবাসে।’ জয়ন্তীদি ইয়ার্কি মারছিল কিনা বুঝতে পারিনি। মজাই করছিল বোধহয়। জুয়েলের প্রসাদ ভাল লাগে এটা জয়ন্তীদি জানবে কী করে। আমিও মজায় যোগ দিলুম। কাঁচুমাচু মুখ করে বললুম, ‘একটা বাতাসা পেলেও ছেলেটার ভাল লাগত।’

কিন্তু মহিলাদ্বয় বেজায় কিপটে। এখানকার সেবাইত বা জমিদার বংশেরই কেউ হবেন বোধহয়। বললেন, ‘আগে বললে হতো। ঠাকুরমশাই সব গুছিয়ে নিলেন।’ নিজেদের থলিতে যে কতকিছু ভরা সেটা বলছেন না। তবে লাগাতার ঘ্যানঘ্যানে বিরক্ত হয়ে থলিতে হাত গলিয়ে একটা মিষ্টি তুলে দিলেন আমার হাতে। আটজনের জন্য একটা মিষ্টি! স্বভাববশে জোরে হেসে উঠতে যাচ্ছিলুম। সামলে নিলুম। প্রসাদ কণামাত্র খেলেই হয়। মিষ্টিধরা হাতটা বাড়ালুম জুয়েলের দিকে।

কালনায় লালজির মন্দির।

এরপর ১০৮ শিবমন্দির দর্শন। কালনার নবকৈলাস নামে পরিচিত। গোলাকারভাবে অবস্থিত মন্দিরগুলি। বাইরের দিকে ৭৪টা আর ভিতরের গোলে ৩৪টা মন্দির। পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ বিভাগ এগুলো এবং আগে দেখা মন্দিরগুলো রক্ষণাবেক্ষণের ভার নিয়েছে।

মন্দির থেকে কালনা স্টেশন যাব। টোটোয় উঠছি। তখন হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে এল তৃষাণী। ইন্দ্রকে বলল, ‘তুমি এবার সাউ ফ্যামিলির টোটোয় বসো।’ ইন্দ্র চলে গেল। কচিরাও পূজাকে ডেকে নি‌ল। ও এতক্ষণ হাঁ করে বসেছিল সাউ ফ্যামিলির টোটোয়। বিরক্ত হয়ে উঠছিল নিশ্চয়। সেই যে বলেছিলুম না, টোটো ছাড়তেই নিজের বড় ভুলের কথা? এটাই সেই ভুল। আমি ভেবেছিলুম, অচেনা দলের সঙ্গে বসালে চেনা পরিচিতি বাড়বে। কিন্তু বিলিতি কায়দা যে বাংলায় চলে না। কিশোর কুমার সেই কবে গেয়েছেন, বাংলায় ফিরে এসো বাবা।

বাংলা পদ্ধতিতে ফেরা হল। আর দলের অনেকেই বাড়ি ফিরতে চাইল। মধ্যম সহোদর তো পারলে তক্ষুণি ট্রেন ধরে ফেলে। কীসের তাড়া কে জানে! ফলে গণতন্ত্র মেনে, সংখ্যা গরিষ্ঠের মতকে মর্যাদা দিয়ে আমরা খাওয়াদাওয়ার পরে কালনা স্টেশনে।

কৃষ্ণচন্দ্র মন্দির। কালনা।

আমার মোটেও ফিরতে ইচ্ছে করছিল না তখন। স্টেশনের বাইরে মনে মনে মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তখন হিসাব করে নিয়েছি, অনেক কিছু না দেখেশুনেই ফিরতে হচ্ছে। গুপ্তিপাড়ায় ভোলা ময়রার জন্মস্থান। কবিওয়ালা ভোলা ময়রা। উত্তম কুমারের ‘অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি’ সিনেমার দৌলতে নামটা চেনা হলেও হতে পারে। জেনেছি, মাখা সন্দেশ নয়, গুপ্তিপাড়ায় বিখ্যাত গুঁফো। এখানেই গুঁফোর জন্মস্থান। গুঁফো একধরনের সন্দেশ (মিষ্টিমহলের আনাচেকানাচে দ্রষ্টব্য)। ভিতরে জলীয় পদার্থ থাকে। খেতে গেলে গোঁফে লেগে যায় বলে এমন নাম। কালনায় বিখ্যাত মাখা সন্দেশ আর বিখ্যাত নোড়া পান্তুয়া। নোড়া পান্তুয়া নামটা শোনা ইস্তক মনে হয়েছে, মুখে ঢোকাব কী করে? ইন্দ্র কতবার যে বলেছে! সেসব না চেখেশুনেই ফিরে যেতে হবে? ট্রেনের তখন কিছুটা দেরি আছে। ইন্দ্রকে বললুম, ‘চল তো একবার।’

টোটো ধরে বাজারে। একটা বইয়ের দোকানে গাইডবুক কিনে পুরনো ভাল মিষ্টির দোকানের খোঁজ। বইয়ের দোকানের পাশেই সেটি। হাজির হলাম। আমাদের কৌতূহলে দোকানদার হেসে বললেন, ‘নোড়া পান্তুয়া আর কিছুই নয়, ল্যাংচা। নোড়ার মতো দেখতে হয় বলে এমন নাম।’ তবে আকারে মোটেও নোড়ার মতো নয়। সেই আয়ুর্বেদ রোগের ওষুধ বাটার খল-নুড়ির নুড়ির মতো। খেতে দুর্দান্ত। অন্য জায়গার ল্যাংচার (এটা শুধু তৃষাণী পায়নি) থেকে আলাদা। আর মাখা সন্দেশ? সে তো ‘তোমার তুলনা তুমি’। দানা দানা। কিন্তু মুখে দিলেই মিলিয়ে যায়। এই সন্দেশের দাম নাকি প্রতিদিন ওঠানামা করে। ছানার দাম বাড়লে মাখা সন্দেশের দাম বাড়ে। কমলে কমে। আমরা কিনলুম ২০০ টাকা কিলো। তার আগের দিন দাম ছিল ১৮০ টাকা। সন্দেশের দাম শেয়ার বাজারের মতো ওঠানামা করে, এই প্রথম শুনলুম।

বিন্ধ্যবাসিনী। কালনা।

আমাদের মিষ্টিগুলো যখন প্যাকেট করা হচ্ছে তখন সেই বইয়ের দোকানি ঢুকলেন। এলাকার মাস্টারমশাই উনি। ওঁর কাছ থেকে কালনার ইতিহাস শুনছিলাম। তখনই ফোন ছোটভাইয়ের, ‘কোথায় তোরা? ট্রেন আসছে যে!’ হন্তদন্ত হয়ে ফিরে এলুম।

তখনও ট্রেনের অনেক বাকি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কী গল্প করা যায়! আমরা সবাই জুয়েলের পোশাক পাল্টানো দেখতে লাগলুম। পুরো পোশাক নয়। শুধু জামা। সারাদিন তো রং বদলাল ছেলেটা। কখনও লাল, কখনও বেগুনি, কখনও ছকরাবকরা। কার তরে এসব? উত্তর নাই।

যাত্রার আগে ফোনটা কে করেছিল? সে উত্তরও কি দিতে হবে!

ছবি-ইন্দ্রজিৎ সাউ এবং শুভ (কচি) বৈদ্য।

 

সমাপ্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *