জলযাত্রা বিশেষ ভ্রমণ

চাঁদিপুরের চৌকাঠে

মধুরিমা দত্ত

লেগেছে লেগেছে আগুন: “এই চাঁদি ফাটা রোদ্দুরে চাঁদিপুরে!”- এই চার শব্দের বাক্যটা অন্তত চল্লিশবার শুনতে হল বন্ধুদের কাছে। কোথাও একটা না গেলে স্রেফ মরে যাব, এমন একটা ক্রুশিয়াল সময়েই এই প্ল্যানটা করা। হাতে টাকা নেই, লম্বা ছুটিও না। আবার কোথাও একটা না গেলে নির্ঘাত মরে যাব। সুতরাং বাড়ির পাশের আরশিনগরগুলোই হাতড়াতে হচ্ছে। দীঘা, পুরী, মন্দারমণি, শান্তিনিকেতন- এসব নিয়ে যখন বাছাইপর্ব চলছে তখন দলে রয়েছে ৬ জন।

ইতিহাসে বরাবরই যখন গ্রুপ প্ল্যানের কথা লেখা হয়েছে তাতে দেখানো হয়েছে, বড় একটা বাহিনী কীভাবে একক নিধিরাম সর্দারে পরিণত হয়েছে। সুতরাং এক্ষেত্রেও যে তার গত্যন্তর হবে না জানাই ছিল। সমস্ত জায়গা ছাঁটাই হয়ে যখন মন্দারমণি বেঁচে রইল আমাদের দলেও বেঁচে রইল হারাধনের দুই সন্তান। যেখানে ঘুরতে যাওয়া ইজ ইক্যুয়াল টু বেঁচে থাকা সেখানে এমন গদ্দারি মোটে পোষায় না। তাই বিশ্বাসঘাতকতার শেষ নিশানিটুকু মানে মন্দারমণি অপশনটাও বাদ। হাতে রইল গোল্লা, আর মাথায় রইল বিরক্তি।

অফিসে বসে নেট ঘাঁটতে ঘাঁটতে গিয়ে দেখলাম সস্তায় পুষ্টিকরের তালিকায় বেশ কিছু আনকোরা সৈকত যুক্ত হয়েছে। মাথাতেই ছিল কলকাতা থেকে ঘণ্টা চারেকের মধ্যে পড়ে এমন কোনও জায়গাতেই যেতে হবে। দু’রাত তিনদিন ম্যানেজ করাই আছে। এ সমুদ্র ও সমুদ্র পেরোতে পেরোতে শেষ ক্লিক চাঁদিপুর, ওড়িশা। মোটামুটি ফাইনাল করে একক যাত্রার প্ল্যান জনসমক্ষে আনতেই সেই মোক্ষম প্রশ্ন! “এই চাঁদি ফাটা রোদে চাঁদিপুর যেতেই হবে?” যেতে যে হবেই সে কথা আগেই বলেছি। কেউ যখন যাচ্ছেই না একাই যাব। যদিও একা হল না, প্রিয় বন্ধুকে সঙ্গে করেই হোটেল বুকিং, ট্রেনের টিকিট সেরে রাখলাম।

গন্তব্য বালেশ্বর: যেহেতু গ্রুপের বাকি সদস্যদের রাজি হওয়ার অপেক্ষায় দিবস রজনী গুনিতেছিলেম- এই সুযোগে বাকি লোকজন, যারা আমার মতোই ছুটি পেলে পালিয়ে বাঁচে তারা ট্রেন বুকিং সব সেরে ফেলেছে। বহু কষ্টে ধৌলি এক্সপ্রেসে দু’খানি আসন পাওয়া গেল। ফিরতি ট্রেনও একই, রিজার্ভেশন ছাড়া। হাওড়া স্টেশন থেকে ভোর ছ’টা নাগাদ ছাড়ল ট্রেন। এরকম দুই বন্ধুর সফর এই প্রথম। ছিমছাম বহু স্টেশন পেরোচ্ছে গাড়ি। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই খড়্গপুর। আরও ঘণ্টাখানেক পর বালাসোর(বালেশ্বর)। নামতে হবে এখানেই। ট্রেন থামা মাত্রই দেখলাম পর্যটকের ভিড়। পর্যটক একটি বিশেষ প্রজাতি। দেখলেই বোঝা যায় এরা ঘুরতে এসেছে। কাঁধে ব্যাগ, মাথায় টুপি, চোখে সানগ্লাস, হাতে জলের বোতল, ক্যাজুয়াল পোশাক। ছিটকে আসা কথোপকথন শুনে বুঝলাম বেশিরভাগই বাঙালি। স্টেশন থেকে অটোভাড়া করে যেতে হবে চাঁদিপুর বিচ। হোটেল বিচের ধারেই। ওড়িয়া ভাষার আমি একটা নাম দিয়েছিলাম অনেক ছোটবেলায়। ‘ঘুঘু ভাষা’। আসলে ওড়িয়া ভাষার হরফগুলো এমনই যে আমার কেবল মনে হত ‘ঘুঘু’ লেখা রয়েছে। এখানেও স্টেশনের মহিলা এবং পুরুষ শৌচালয়কে আমি ‘ঘুঘুলা’ এবং ‘ঘুঘুষ’ পড়ছিলাম।

বন্ধুর ডাকে এসব ভাষা-খিল্লি থামিয়ে চোখ গেল অটোস্ট্যান্ডে। স্টেশনের বাইরে পা রাখতেই বুঝলাম, চাঁদি ফাটার গল্পটা অক্ষরে অক্ষরে মিলতে চলেছে। স্ট্যান্ডের কাছে যেতেই হাঁক, এই চাঁদিপুর……..চাঁদিপুর। যে ভদ্রলোক আমাদের গন্তব্যে পৌঁছাবেন তাঁর নাম রামহরি দাস। ঝরঝরে বাংলা বলছেন দেখেই কৌতূহল ছিল, আলাপের পরে জানলাম বাঙালিই তিনি। মূল শহর থেকে অনেকখানি পথ চাঁদিপুর। শহর ছাড়তেই বাড়িঘরহীন রাস্তা, খুবই শুষ্ক একঘেয়ে ভূমিরূপ। রাস্তার ধারে ইতস্তত কৃষ্ণচূড়া আর রাধাচূড়া গাছ পাশাপাশি। পিচরাস্তায় হালকা গ্রাফিতি করেছ যেন ঝরে পরা লাল হলুদ ফুলগুলি। সমুদ্র থেকে যতই মূল ভূখণ্ডের দিকে ঢোকা যায় আবহাওয়া বদলাতে থাকে। তেমনই যত সমুদ্রসৈকতের দিকে এগোচ্ছিলাম চাঁদি ফাটা রোদও মোমের মতই মনে হচ্ছিল। হাওয়া নোনতা, ঘাম শুকিয়ে যাচ্ছে নুনের জন্ম দিয়ে। রামহরিবাবু বলছিলেন, চাঁদিপুর থেকে ঘণ্টাখানেকের দূরত্বেই বেশ কিছু ঘোরার জায়গা আছে। সিমলিপালের জঙ্গল তো আছেই, অতদূর না গেলেও কাছেই পুরনো রাজপ্রাসাদ, হাতির জন্য সংরক্ষিত জঙ্গল, মন্দির এসব তো আছেই। ফেরার দিনক্ষণ জেনে নিজের মোবাইল নম্বর দিয়ে রামহরি জানালেন তাঁকেই যেন ডেকে নিই, তিনি ফাঁকা রাখবেন ওই দিন। আগে থেকে বুকিং থাকায় হোটেলে হয়রানি কম। ব্যাগ রেখেই সোজা সৈকতে।

নীল নির্জনেঃ   নির্জন। বড় বড় ঝাউ বনে হাওয়া ঢুকে খেলা করছে। গরম বালি। কয়েকটি কুচো বাচ্চা বালিতে নাম লিখছে, ঢেউ নিয়ে মুছিয়ে দিচ্ছে ফের। একটু এগিয়েই বোল্ডার। তার উপরে জামাকাপড় রেখে স্নানে নেমেছেন কেউ কেউ। জল বড্ড ঘোলাটে। গর্জনও নেই তেমন। পর্যটক বেশিরভাগই উইকএন্ড প্রিয় বাঙালি। স্নানের জায়গা থেকে আরও খানিকটা হেঁটে এগোলেই নির্জন সমুদ্র। এখানে সৈকতে খালি পায়ে হাঁটা যায় না। গোটা সৈকত জুড়েই ছড়িয়ে রয়েছে গুঁড়ো গুঁড়ো শামুক, ঝিনুক। মৃত রাজকাঁকড়ার খোলসও ছড়িয়ে রয়েছে ইতিউতি। বুঝলাম, এখনও মানুষ এসব জায়গায় পা রাখেনি তেমন। তাই ঝিনুক কুড়ানো যায় প্রাণ ভরে। হাঁটলেই পায়ের নীচে মড়মড় শব্দ তুলে গুঁড়িয়ে যায় ঝিনুক। খানিক এগোতেই ঝিনুক সন্ধানী চোখে ধরা পড়ল মৃত তারামাছ (starfish)। ভেবেছিলাম কুড়িয়ে  নিই। বাড়ি নিয়ে যাব। প্রিয়বন্ধু কটমট করে তাকিয়ে জানিয়ে দিল প্রিজারভেশনের অভাবে ওটা শুকিয়ে দুর্গন্ধ ছড়াবে। তাই মায়া বাড়িয়ে কাজ নেই। খানিক ঘোরাঘুরির পর ঠিক হল নির্ভেজাল ছুটি কাটাতে এবং ল্যাদ খেতেই যখন এসেছি বেশি ঘোরাঘুরিতে কাজ নেই। এই সমুদ্র, এই ক্লান্তি তাড়ানো হাওয়ায় বরং কেটে যাক দিনগুলো।

পরিকল্পনামাফিকই সন্ধ্যাবেলা হাওয়া খেতে বাইরে বেরনো। সন্ধ্যাবেলা ভিড় আরেকটু বেশিই। ওড়িশা পর্যটন দফতরের একখানা অথিতিনিবাস সমুদ্রের ধারেই। তাঁর সামনে অনেকখানা জায়গা জুড়ে সাজানো রয়েছে বসার বেঞ্চ, কারুকাজ করা আলোকস্তম্ভ এবং বাদামভাজা। সার দিয়ে হস্তশিল্পের দোকান, বেমানান চাউমিন, এগরোল। সমুদ্রে তখন ভাটা, ফলত জল অনেকটা দূরে। বাঁধানো বসার জায়গায় যা আলো আছে তা সৈকতে পৌঁছায় না। অন্ধকার সমুদ্র, অনেক অনেক দূরে টিমটিমে আলো। সব সমুদ্রেই এই দৃশ্যটা আমার বিশেষ কৌতূহলের। একটা কবিতার লাইন বারবার তোলপাড় করে। “…………বহুদূর সমুদ্রে হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা”। কে যে দিশা হারায়নি এই প্রশ্নের উত্তর মেলে না। সমুদ্রে স্নানের আকর্ষণ বরাবরই নেই। শুধু মনে হত, জীবনের সব সন্ধ্যাগুলোয় সমুদ্রের ধারে বসে এই উথালপাথাল হাওয়ায় নিজের না বলা সব কথাগুলো উচ্চারণ করতে পারলেই দমবন্ধ করা ভাবটা কেটে যেত। কাকে বলতাম সেসব কথা? এই নির্জনতা, এই শূন্যতাকেই সামনে বসিয়ে আউড়ে যেতাম। জীবনে সমুদ্রের মতো এমন ভরসা যোগ্য শ্রোতা পাওয়া বড় কষ্টের। আসলে কেউ শোনে না। না তো সমুদ্র, না তো এই নোনতা হাওয়া, না তো এই ট্যুরিস্ট সন্ধ্যা।

না বলা কথাগুলো আসলে নিজেকেই বলতে চাই আমরা। বাকিগুলো অ্যাম্বিয়েন্স তৈরি মাত্র। অনেকটা, ধূপ প্রদীপ জ্বেলে, স্নান করে সুন্দর কাপড় পরে প্রার্থনায় বসার মতো। নিজের অন্তরের সাথে নিজের কথোপকথন। সমুদ্রের ধারে এমন কত প্রার্থনা ঘুরে বেড়ায়। কত চোখের জল আছে, কত প্রথম হাত ধরা, কত বাচ্চার খিলখিল হাসি মিশে আছে প্রতিটা সৈকতে তা শুধু সময়ই জানে। বেশ কিছুক্ষণ পরে খেয়াল হল এবার ফিরে যাওয়াই ভালো। হাতে এখনও একটা গোটা দিন।

এখানে আসার আগে নেট সার্চ করে এবং রামহরিবাবুর কথা শুনে মাথার মধ্যে কতগুলো নাম ভাসছিল। ফেরার পথে দেখি একটা ছোট গুমটি। ভেতরে কম্পিউটার নিয়ে বসে আছেন এক ব্যক্তি। বাইরে হাতে লেখা সাইনবোর্ড- সিমলিপাল, পঞ্চলিঙ্গেশ্বর মন্দির, কুলডিহা জঙ্গল, নীলগিরি প্যালেস…। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়ছি দেখে প্রিয় বন্ধুটির বোধহয় মায়াই হল।  “একবার খোঁজ করে দেখবি নাকি কত টাকা নেবে?” বলামাত্রই মনে হল এতদূর যখন এলামই গোটা দিন, বিশেষ করে দুপুরটা হোটেলে ল্যাদ খাওয়া খুব একটা যুক্তিসঙ্গত হবে না। তাই পুছতাছ শুরু হয়ে গেল। পান চিবতে চিবোতে অ্যাক্টিভা স্কুটির উপর পা ঝুলিয়ে বসে আমাদের যিনি প্যাকেজ বোঝাচ্ছিলেন তাঁর নাম বাবু। পরে জানা গেল উনিই মালিক। পকেট ফ্রেন্ডলি একটা প্যাকেজও বেছেই ফেললাম। তক্ষুণি খেয়াল হল ক্যাশ টাকা নেই সাথে। বুকিং করার মিনিমামটাও দিতে পারব না। কী মনে হতে বাবুদা বললেন, “কাছেই দু’টো এটিএম আছে। আপনারা আমার স্কুটি নিয়ে যান, তুলে আনুন। তবে স্কুটি নিয়ে বাড়ি চলে যাবেন না যেন, হেঁহেঁ”। চাঁদিপুরে ল্যান্ড করা ইস্তক আমার কোনও এটিএম চোখে পড়েনি।

বাবুদার নির্দেশিত পথে মিনিট দশেক গাড়ি চালানোর পরেও কোনও এটিএম চোখে পড়ল না। যে রাস্তায় গিয়েছি সেখানে স্ট্রিট লাইটের দর্শন পাওয়া আর ঈশ্বরের দেখা পাওয়া প্রায় একই। উল্টোদিক থেকে আসা এক সাইকেল চালক জানালেন আরেকটু এগিয়ে একটা পেট্রোল পাম্প আছে, সেখানেই এটিএম। বেশ কিছু রাস্তা তাঁর ভরসায় এগিয়ে পেট্রোল পাম্পের দেখা পেলাম ঠিকই কিন্তু এটিএম বন্ধ। পেট্রোল পাম্পের লোকও নেই। উল্টোদিকের দোকানি জানালেন, এখানে একটাই সবেধন নীলমণি এটিএম। তাও রাত ৮টায় বন্ধ হয়ে যায়। এ তো ভারি তাজ্জব দেশ! মোবাইল ঘড়ি বলছে রাত ৮.২০, এটিএমের ঝাঁপ দেখে যদিও মনে হচ্ছে বছর কুড়ি খোলাই হয়নি।

খানাখন্দময় অন্ধকার রাস্তা পেরিয়ে বাবুদার দোকানেই ফেরা। ভাবছিলাম অনুরোধ করে দেখব যদি আগাম ছাড়াই বুকিং করে দেন। বাবুদা অন্তর্যামী কিনা জানি না, কাঁচুমাচু মুখ দেখে নিজেই বললেন, “কাল কখন বেরবেন বলুন, গাড়ি পৌঁছে যাবে”। ঠিক হল সকাল ৯.৩০ নাগাদ বেরবো ব্রেকফাস্ট সেরে। আমাদের ঘোরার তালিকায় আছে নীলগিরি প্যালেস, কুলডিহা জঙ্গল এবং পঞ্চলিঙ্গেশ্বর মন্দির। এখানে প্রতিটি জায়গার একটা করে বর্ণনা আছে, যাকে বাবু ভার্সন বা বাবু উবাচ বলা যায়। ঘুরতে যাওয়ার অংশ বলার আগে এগুলো জেনে রাখা দরকার।

নীলগিরি প্যালেস।

“নীলগিরি প্যালেস কাছেই। আপনাদের যেতে টাইম লাগবে না। ওর কাছেই ফরেস্ট রেঞ্জার অফিসারদের আস্তানা। সেখানে গিয়ে আপনাদের জঙ্গলে ঢোকার একটা পারমিট করাতে হবে বুঝলেন”। বুঝলাম তো বটেই। জঙ্গলে সাফারি করার সাধ কী আর আজকের! কিন্তু বরাবরই মন্দ কপাল। এমনকি চিড়িয়াখানাতেও দেখেছি জন্তু জানোয়ার পাখি সব লুকিয়ে থাকে। আমাকে দেখে কখনোই বেরিয়ে আসে না। এমনকী মুখপোড়া বাঁদরগুলো অব্দি পাত্তা দেয় না। তাদেরই উত্তরপুরুষ, থুড়ি উত্তরমহিলা যে দাঁড়িয়ে রয়েছে তাদের দেখবে বলে, ব্যাটারা গ্রাহ্যই করে না। সুতরাং কুলডিহা জঙ্গলে আমাকে দেখে হাতি এসে হ্যান্ডশেক, মানে শুঁড়শেক করে যাবে এমনটা স্বপ্নেও হবে না হয়ত। কিন্তু বাবুদা অভয় দিলেন। “কুলডিহা ঘুরতেই যা সময় লাগবে আপনাদের। মানে ধরুন, কোথাও দেখলেন হাতির পাল জল খাচ্ছে একটু দাঁড়ালেন, ছবি তুললেন। কোথাও হরিণ দেখলেন ঘাস খাচ্ছে, গাড়ি থামালেন, ছবি নিলেন। তবে দূর থেকে নেবেন ছবি। হাতির মন তো, গাছ তুলে আছড়ে দেয়। গাড়ি দূরে রাখবেন। তবে হরিণগুলো ভালো, গাড়ির পাশেই চলে আসে”।

এসব শুনেই আমার চোখের সামনে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেল ভেসে উঠেছে তখন। হাতিদের সাম্রাজ্যে দুই মানুষের অনুপ্রবেশ! হাতিদের শাবকের মায়ের সাথে লেপ্টে থাকা। ক্যামেরা আনিনি তো কী হয়েছে? চোখের স্মৃতি বলে তো একটা ব্যাপার হয়। সাথে আবার হরিণ, বড় মায়াময় চোখ। ঘন জঙ্গল, বুনো গন্ধ- দিনটা চমৎকার হতে চলেছে।

এ যে বন্য, এ অরণ্যঃ     ব্রেকফাস্ট সারতে না সারতেই গাড়ি হাজির। পথে এটিএম থেকে টাকা তুলেই গাড়ি ছুটল নীলগিরি। বাজারহাট পেরোতেই শহরটা বড় নিরিবিলি হয়ে যায়। রাস্তাও শুনশান। প্রায় মিনিট পঁয়তাল্লিশ পেরিয়ে যে হাইওয়েতে এলাম তার একদিকে পাহাড়। ওই পাহাড়ের গায়েই আমাদের নীলগিরি প্রাসাদ। নীলগিরি কেরলার পাহাড়, যার সবচে উঁচু শৃঙ্গের নাম দোদাবেতা এই লিখেই নম্বর পেয়েছি এককালে। ওড়িশার নীলগিরির নাম এই প্রথম শোনা, দেখবও এই প্রথম। নীলগিরি আসলে ব্রিটিশ আমলের প্রিন্সলে স্টেট। ১১২৫ সালে ছোটনাগপুরের কোনও এক রাজা এসে এখানে ভিত্তিস্থাপন করেন। রাজপুত ঘরানার লোকই ছিল এখানের বাসিন্দা। স্বাধীনতা সংগ্রামীরা এই প্রিন্সলে স্টেটটিকে রাজাদের হাত থেকে ছিনিয়ে নেয়। পরে ভারত স্বাধীন হলে নীলগিরি আলাদা শহর রূপে গড়ে ওঠে। গাড়ি যেখানে থামল তাঁর সামনেই এককালের রাজপ্রাসাদ। জীর্ণ সিংহদুয়ার। ভেতরে তখন মেরামতের কাজ চলছে।

রাজপুতানা ঘরানার শিল্পকর্ম।

একেবারেই ভগ্নদশা। দেওয়ালে রাজপুতানা চিত্রশিল্পের ভগ্নাবশেষ। বোঝা যায়, এককালে দাপটে চলত রাজত্ব। মেরামতির জন্য বেশিরভাগটাই বাঁশ দিয়ে ঘেরা। একটা অংশে যত্নআত্তি করে রঙ করা। তাতে লেখা ‘নিজাগড় প্যালেস’। এই নামের ইতিহাস জানার মতো কাউকেই হাতের সামনে পাওয়া গেল না। বেরিয়ে এসে কয়েক হাত দূরেই পাহাড়টা স্পষ্ট দেখা যায়। যদিও রাস্তা নেই সেদিকে যাওয়ার। এক ভদ্রলোক জানালেন, ওদিকে রাস্তা ছিল আগে, তবে তা এখন বন্ধ। কেন? “আগে ভাল্লুক বেরোত, তাই এখন রাস্তাটাই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে”। এর পরে অবধারিত বাঙালি প্রশ্ন যা হতে পারে তাই হল। “বাঘ আছে?” “নাহ! বাঘ তো শুনিনি, ভালুকই আছে, আর হয়ত হায়না, শেয়াল”। একদিকে হাতি, এদিকে ভাল্লুক, হায়না, পরের গন্তব্যই কুলডিহা! আমাদের আর পায় কে!

যথাযোগ্য পারমিট করিয়ে চললাম জঙ্গলের পথে। প্রাসাদ থেকে বেশ খানিকটা রাস্তা। জঙ্গলে যখন ঢুকছি বেলা প্রায় ১২টা। রোদ জব্বর। কিন্তু জঙ্গল বলে তেমন তাপ নেই। ঘন সবুজ শ্যাওলা গন্ধ, মোটা গাছের গুঁড়ি। পারমিট দেখিয়ে গাড়িশুদ্ধ ঢুকলাম ভেতরে। কিছুটা এগোতেই দেখি একটা গাছের গুঁড়ি অস্বাভাবিক ভাবে ভাঙা, যাকে বলে দুমড়ানো। শান্ত গলায় ড্রাইভার জানালেন, হাতি এসেছিল, ওরাই উপড়েছে। শুনেই প্রিয়বন্ধুর নির্দেশ, “তুই সামনের সিটে চলে যা। হাতি দেখলেই ভালো ছবি তুলবি”। আমি গেলাম না, হাতি দেখে দরজা খুলে নেমে যদি ছবিই না তুললাম, কিসের ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফি! কানে বাবুদার কথা বাজছে, চোখে ন্যাশনাল জিওগ্রাফি। মাথার উপর গাছেদের শামিয়ানা। ঝিঁঝিঁর ডাক। পথের মঝে মাঝে বিশালাকার উইপোকার ঢিবি। চাক্ষুষ করে বুঝলাম কীভাবে আস্ত রত্নাকরকে বাল্মীকি বানিয়েছিল এরা।

নিজাগড় প্যালেস।

হাতির দেখা নেই, ফিরতি ট্যুরিস্ট গাড়ির দেখা পাচ্ছি যদিও। ইচ্ছে করছিল তাঁদের জিজ্ঞেস করি, “জঙ্গলমে হাতি হ্যায় ইয়া নহি হ্যায়!” তবে যারা ফিরছিলেন সকলেই বেশ হাসিখুশি দেখে আমরা ধরেই নিয়েছিলাম এরা অভীষ্টের দেখা পেয়েছেন। এদিকে শুকনো পাতার সরসর শব্দ পেলেই আমার বন্ধুটি কৌতূহলী হয়ে পড়ছে। “কীসের একটা শব্দ হল যেন!”- কথাটা প্রতি পাঁচ মিনিটে অন্তত দু’বার করেই বলছিল। তখনও পর্যন্ত উইয়ের ঢিবি ছাড়া একটা পাখিও চোখে পড়েনি। ঢিবির সাথে খানকতক সেলফি তুলে আরও গভীর জঙ্গলে প্রবেশ। একটা ছোট বাংলো মতোন জায়গায় গিয়ে গাড়ি থামল। গভীর জঙ্গলে যারা ক্যাম্প করে থাকতে চান তাঁদের জন্য বন দফতর এমন ব্যবস্থা করেছে। গাড়ি থেকে নেমে কিছুদূর এগিয়ে আঙুল উঁচিয়ে ড্রাইভার দেখালেন, “ এটা সল্টপিট, হাতি এখানে খেতে আসে”।

একটা প্রশস্ত জায়গা, আমাদের থেকে অন্তত পঞ্চাশ ষাট ফুট দূরে মাটিতে নুন মিশিয়ে হাতির জন্য সল্টপিট বানানো হয়েছে। ড্রাইভার বললেন এখানে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে। ভাগ্য ভালো হলে হাতির ভোজন দেখা যাবে। ঘড়ি বলছে দুপুর দেড়টা। মানুষের লাঞ্চটাইম আর হাতিদের লাঞ্চটাইম এক কিনা সেটা নিয়ে গভীর আলোচনা করতেই পারতাম। কিন্তু পেট চুঁইচুঁই করছে খিদেয়, এদিকে হাতি না পাওয়ার হতাশা। সব মিলেয়ে গভীর নিম্নচাপ!

পঞ্চলিঙ্গেশ্বরের পথে।

হাতি কেন, একটা কাঠবিড়ালি অব্দি সল্টপিটের ধারে কাছে এল না। হরিণ তো স্বপনচারিণী! বুঝলাম, এবং মনকে বোঝালাম, পৃথিবীতে বাবুদার মতো আশাবাদীরা থেকেই থাকেন। তাঁদের কাজই হল মানুষের মনে আশার সঞ্চার ঘটানো। অপটিমিজম জাগিয়ে ব্যবসা তো জুকারবার্গ থেকে মোদী সকলেই করছে- বাবুদার আর কী দোষ! জঙ্গলের পথ থেকে বেরনোর সময় আমাদের মনমরা দেখে ড্রাইভার নিজেই মুখ খুললেন। “এত গাড়ি ঢোকে যে আওয়াজে, ধোঁয়াতে পশুপাখি আর কাছেই আসে না, এখানে এসে যদি তিন চারদিন থাকেন তাহলে হয়ত দেখা পেতেও পারেন”। এই কথার পর আর রাগও করা যায় না। ঠিকই তো, ওদের রাজত্বে ঢুকে রীতিমতো গাড়ি নিয়ে দূষণ ছড়িয়ে যাচ্ছি আর ভাবছি ওরা দেখা দেবে। নিজেরা শান্তি খুঁজতে জঙ্গলে আসি আর ওদের শান্তির বারোটা বাজিয়ে দিই। তবু, এই জংলা গন্ধ, এই ইন্টারনেট এবং নেটওয়ার্ক হীনতা আর প্রগাঢ় এক নির্জনতাই প্রাপ্তি হয়ে রইল। জঙ্গল থেকে বেরোতেই বনমুরগি আর শুয়োরের দল হয়তো সান্ত্বনা পুরষ্কার দিতেই দেখা করতে এসেছিল। খিদে পেয়েছে জানাতেই ড্রাইভার জানাল এখানে কোথাও ভাত খাওয়ার মতো হোটেল নেই। বলে কী! পর্যটকের জায়গায় ভাতের হোটেল নেই? সত্যিই নেই।

পঞ্চলিঙ্গেশ্বর মন্দির যাওয়ার পথে একখানা হোটেলও চোখে পড়ল না। রাস্তার অবস্থাও ততখানিই রুক্ষ। লু বইছে। আর চারপাশে এবড়ো খেবড়ো পাথুরে পাহাড়। ওড়িশার মন্দিরের শিল্প এবং ভাস্কর্য নিয়ে আমার বরাবরের একটা কৌতূহল এবং তারিফ রয়েছে। সেই বাবুদা, মানে আশাবাদী বাবুদা বলেছিলেন, তিনশো সিঁড়ি পেরিয়ে পাহাড়ের গায়ে সেই মন্দির। গাড়ি থেকে নেমেও খাবার কোনও দোকান পেলাম না। জল কিনেই কাজ চালাতে হল। সামান্য ঠান্ডা জলে তিনশো সিঁড়ি ওঠার ক্ষমতা নেই, কিন্তু এসেই যখন পড়েছি, হয়তো পাহাড়ের গায়ে কোনও এক অদ্ভুত সুন্দর মন্দির তার শিল্প নিয়ে অপেক্ষা করে আছে আমাদের। একেবারে টানা তিরিশটা সিঁড়ি ভেঙে তারপর মিনিট তিনেকের বিশ্রাম, এই করে প্রায় ২০০ সিঁড়ি চড়ার পর টের পেলুম কান ভোঁ ভোঁ করছে, মাথায় আগুন জ্বলছে। কম করে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস উষ্ণতা। হাতের বোতলের অবশিষ্ট জল মাথায় ঢেলে নিজেদের আশ্বস্ত করলাম, আর তো মোটে একশো খানা সিঁড়ি! ভোলেবাবা পার করেগা।

পঞ্চলিঙ্গেশ্বরের মন্দির।

চলতে শুরু করলাম আবার। তবু মন মানে না, ফিরতি এক ভক্তকে জিজ্ঞেস করাতে তিনি আঙুল দেখিয়ে বললেন ওই তো মন্দির। এসেই গেছেন। তাঁর আঙুল বরাবর চোখ নিয়ে গিয়ে দেখি একটা ভাড়া ঘরের মতো ঘর। প্রচুর আলতা সিঁদুর লাগানো দেওয়াল, মাথায় ধর্মীয় পতাকা উড়ছে। এই তবে মন্দির!  কোনারক, লিঙ্গরাজ এমনকি ধবলগিরি মন্দিরের সাথেও যার গঠনগত কোনও শিল্প সুষমা নেই। পাঁচটা শিবলিঙ্গ রয়েছে জলের ধারা নিচে, তা ছুঁয়ে পেন্নাম করছেন অনেকে।

আড়াইশো সিঁড়ি উঠে যত ক্যালোরি পুড়েছে তাতে আর ওই মন্দিরে যাওয়ার ইচ্ছা জন্মায়নি। ঈশ্বরে ভক্তি না থাকার এই এক সুবিধা, এই এক অসুবিধাও। যারা উঠছেন এতটা কষ্ট করে তারা এক অদ্ভুত বিশ্বাসে উঠছেন, ভোলেবাবা পার করেগা। কোথায় কীভাবে পার করেগা জানার দরকার নেই। আসলে বিশ্বাসে মেলায়, অবিশ্বাসে ক্যালোরি পোড়ায়। সিঁড়ি নামার সময় দেখলাম ধারে ধারে জিরোবার জন্য অনেক বসার বেঞ্চ। তারই একটায় দেহ রাখলাম। একপাশে সিঁড়ি, অন্যপাশে খাদ, বড় বড় পাথরের চাঁই। তারই গায়ে কে আবার খোদাই করে প্রকাশ + রিংকু লিখে ভালবাসা প্রকাশ করেছে। অত উঁচুতে নাম লিখতে হলে ট্রেকিং ছাড়া সম্ভব না। কীভাবে যে প্রেম এই উচ্চতায় পৌঁছল ভেবে অবাকই হলাম। হয়তো বা হৃদয়ে লেখা নাম মুছে গেছে, তাও পাথরে লেখা নাম ক্ষয়ে যায়নি। সিঁড়ি নামা শেষ হলে দেখি বেলা গড়িয়ে সাড়ে তিনটে। পাহাড় প্রমাণ খিদে নিয়ে সফর শেষ হল এই বেলার।

পঞ্চলিঙ্গেশ্বর থেকে তোলা।

সৈকতে শেষবারঃ তিনশো সিঁড়ি, ৪২ ডিগ্রি গরম আর ভুখা পেটের যন্ত্রণা সয়ে ঘুম ভাঙল সন্ধ্যেয়। ঠিক করলাম সমুদ্রের হাওয়া খেয়েই ক্লান্তি কাটাতে হবে, সাথে বাবুদাকেও অভিজ্ঞতা জানাতে হবে। সমুদ্র ঘুরে ফেরার পথে দেখি স্বমহিমায় নিজের গুমটিতে বসে আছেন বাবুদা। কানে ধরা ফোনে ওড়িয়া ভাষায় কাউকে কিছু বলছেন। ফোন রাখা মাত্র দু’জনে প্রায় একসাথে বলে উঠলাম, “হাতি-হরিণ কিছুই তো পেলাম না দাদা”। বাবুদার এর পরের উত্তরটা বড়ই ফিল্মি। “পেলেন না? ও! ওরকম হয় মাঝে মাঝে”। তা বটে, বড়ি বড়ি দেশো মে ছোটি ছোটি বাতে………..

পরদিন সকালে ঠিকই ছিল সমুদ্র স্নানে যাওয়া হবে। আসলে যাবে বন্ধুটি, আমি যাব জামা কাপড় চটি গামছা সামলাতে। সকাল ৮টার রোদে চামড়া জ্বলে যাচ্ছে। স্নান করছেন গুটিকয় মানুষ। জলও গরম হয়ে আছে ততোধিক। স্নান শেষে ঝিনুক কোড়ানোর পালা। স্মৃতি আর ঝিনুক ছাড়া মধ্যবিত্ত ট্যুরিস্ট মন কিই বা কোড়াতে পারে! যে ঝিনুক কোড়ানো হয় না, তারা এক অদ্ভুত অপেক্ষায় থাকে। ফের এসে কোনও পর্যটক কোলে নেবে তাকে, গয়না হয়ে যাবে মৃত ঝিনুকের ভবিষ্যৎ। অথবা কিছুই হবে না, কেউ হদিশ পাবে না। কোনও ঢেউ এসে ঝিনুকের লাশ নিয়ে চলে যাবে অতলে।

কথামতোই লাঞ্চ সেরে রামহরিবাবুকে ডাকার পালা। ফেরার পালা। একই রুক্ষ পথ, একই ফুলের গ্রাফিতি। কিছুদূর এগোতেই চোখে পড়ল সাদা ধুতির জনাপাঁচেক লোক। রাস্তার ধারেই বানানো হয়েছে চিতা, পাশে বাঁশের খাটে শোয়ানো মৃতদেহ। এক ব্যক্তির হাতে আগুন জ্বালানো কাঠ। কী ব্যাপার! রামহরিবাবুকে জিজ্ঞেস করতেই তিনি জানালেন কোনও তেমন ব্যাপার না। আদিবাসী মানুষ মারা গিয়েছে তাই পোড়াচ্ছে। তাবলে এভাবে মূল রাস্তার ধারে জ্বলন্ত চিতা! “শ্মশানে পোড়াবার টাকা কই। জঙ্গল থেকে কাঠ এনে বাড়ির পাশেই জ্বলিয়ে দেয়। এখানে এভাবেই রাস্তার ধারে মরা পোড়ে”।

এসব শুনে চুপ করে থাকা ছাড়া কিছু করার থাকে না। যেদিন এসেছিলাম একেবারেই ঘটনা বৈচিত্রহীন ছিল এই পথ। সামান্য মৃত্যুতেই রাস্তার চরিত্র বদলে গেল। মড়া পোড়ানো হাওয়া হয়তো আজ সফরসঙ্গী হবে কোনও পর্যটকের। সমুদ্রের হাওয়ায় মিশে যাবে স্বজন পোড়ানো গন্ধ।

আসলে এই জন্যই সমুদ্রের হাওয়া এত চমৎকার। এখানে প্রেম মিশে আছে, বিরহ মিশে আছে, শিশুর হাসি আছে আবার মড়া পোড়ার অভিজ্ঞতাও। সব নিয়ে একা এক প্রাজ্ঞ সৈকত পর্যটকের অপেক্ষা করে, অনন্ত শ্রোতা জীবন তাঁর।

ছবি— লেখিকা

সমাপ্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *