পাহাড়িয়া বাঁশি বিশেষ ভ্রমণ

ঘুরতে ঘুরতে মুরগুমা— মুগ্ধতা পর্ব

দীপক দাস

পরদিন ঘুম ভাঙল শুভরই বিস্ময়ে। হুড়কো খুলেই ওর আলতো চিৎকার, ‘দেখেছ! কাল রাতে বোঝা যায়নি।’

শুভকে দিয়ে এক লাইন লেখাতে হলে সাত ঝুড়ি চিকেন পকোড়ার তেল ফুরবে। কিন্তু কথায় রহস্য করতে বলো, সাত শব্দেই জাল বিছিয়ে দেবে। রহস্যের। ধড়মড়িয়ে উঠে গেলাম আমি আর ইন্দ্র। আর দু’জনেই বিস্ময়ে হাঁ। বারান্দার গ্রিলের বাইরেই আস্ত পাহাড়। যেন মখমলি সবুজের তাঁবু। শুভ কাল টেম্পোয় আসতে আসতে বলেছিল ‘হাত বাড়ালেই পাহাড়’। সত্যি সত্যিই তাই। ঘুম চোখে সেই বিস্ময়ের কোনও বর্ণনা হয় না। শুভর মতো পাহাড়াহত হয়ে গেলাম। ভাবছিলাম, এমন সকাল যদি রোজ হতো! পরক্ষণেই মনে হল, সৌন্দর্যের ক্ষেত্রে আশুতোষ হওয়া উচিত। অল্পেই তুষ্ট হও। সুন্দরের স্বাভাবিক একটা দূরত্ব আছে। সেই দূরত্ব ঘুচে গেলেই নষ্ট।

দরজা খুলেই বিস্ময়!

পাহাড় মগ্নতায় এতক্ষণ খেয়াল করিনি। দুর্গামন্দিরে তারস্বরে গান ঠিক বেজে চলেছে। গানের বিষয়বস্তু, পাড়ার কোনও ছোকরার বৌদির সঙ্গে কথোপকথন। দেবরটির ভাষা দ্ব্যর্থক। তাতে আলোআঁধারির খেলা। সক্কাল সক্কাল এমন গানে পাহাড়ের আবেশটা যেন কেটে যাচ্ছিল। তাড়াতাড়ি শৌচালয়ে সেঁধিয়ে গেলাম।…

চায়ের কিছুক্ষণ পরেই জলখাবার এল। আটার লুচি, সেই আলুর তরকারি আর সেই বোঁদে। এবার একটু রসসিক্ত হয়েছে বোঁদে। খাবার পরিবেশন করছেন স্বয়ং মালিক। রাতেও এনেছিলেন। আমাদের আরও লুচি সাধছিলেন। আমি না বললাম। ইন্দ্র, শুভও নেতিবাচক। ইন্দ্রর দিকে তাকাতে দেখি, ওর চোখগুলো যেন একটু বড় বড় হয়ে গিয়েছে। এবার ওদের লুচিতে না বলার কারণটা বুঝলাম। আটার মোটা মোটা লুচি। তরকারিটাও জুতসই নয়। গলা দিয়ে সেসব উপকরণ পেটে চালান করতে পারছে না। না হলে চারটে লুচিতে হাল ছাড়ার পাত্র ওরা নয়।

খেতে খেতে বাড়ির মালিকের কাছ থেকে এলাকার হাল-হকিকত জানার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু লুচির মতোই তেমন জুত হল না। ভদ্রলোক অত্যন্ত অমায়িক। সব কথাতেই হাসেন। ফলে ঘটনার গভীরতা বোঝা যায় না। এই যেমন আমরা জানতে চাইলাম, এখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতি কী? উনি বললেন, ‘এখানকার পঞ্চায়েতে দল ভাঙাভাঙির খেলা চলছে।’…হাসি। এখানে হাতিটাতি আসে? উনি জানালেন, গত সপ্তাহেই কাছেই হাতি একজনকে আছড়ে মেরে ফেলেছে। আবার হাসি। এই এলাকায় একসময় মাওবাদীদের প্রভাব ছিল। এখন কী অবস্থা? মালিক ভদ্রলোক কিছুই বললেন না। নীরবে হাসতে লাগলেন।

চোখ ফেরানো যায় না।

কাল রাত থেকেই বাসিন্দাদের মধ্যে মাওবাদীদের প্রভাব মাপার চেষ্টা করছি। পুজোমণ্ডপের সেই আলাপি ভদ্রলোক এক ঘটনার কথা বলেছিলেন। কিছুদিন আগে নাকি কলকাতার খানদশেক অভিযাত্রী বাইক নিয়ে সফরে এসেছিলেন। দিনের বেলায় বাইকের আলো জ্বালিয়ে সার বেঁধে বেরিয়ে এসেছিলেন জঙ্গল থেকে। এই পর্যন্ত বর্ণনা করার পরে ভদ্রলোকের উক্তি, ‘আমরা তো মনে করেছি মাওবাদীরা আবার আসছে।’ এই উক্তি ভয়ের না ভক্তির তা আমি বুঝতে পারিনি। এখনও যেমন মালিক ভদ্রলোকের হাসি থেকে কিছু বুঝতে পারলাম না। তাই জিজ্ঞাসায় ক্ষান্ত দিয়ে চুপচাপ বেরিয়ে পড়লাম। খবর এসেছে, গাড়ি এসে গিয়েছে।

পুজোমণ্ডপের সামনে দিয়েই গেলাম। তখনই চোখে পড়ল, পুজোটা কিন্তু দুর্গামন্দিরে হচ্ছে না। হচ্ছে পাশে প্যান্ডেল বেঁধে।…

পাড়াটা ছাড়িয়ে সবেমাত্র গাড়িটা প্রবল গোঁ গোঁ শব্দে একটা চড়াইয়ে ওঠার চেষ্টা করছিল। রাস্তার একদিকে পাহাড়। বড় বড় পাথরের চাঁই সাজিয়ে সাজিয়ে সে ক্রমশ ওপরের দিকে উঠে গিয়েছে। পাথরের ধূসরতা প্রকৃতি ঢেকে দিয়েছে সবুজে। জঙ্গলে। রাস্তার আরেকদিকে পাথুরে ধাপওলা বেশ গভীর খাদ। হঠাৎই রাস্তার ডানপাশে চোখ পড়ে গেল।

সহজ গতির সহজঝোরা।

খাড়াই পথের অনেকটা নীচে একটা জলধারা। ঝরনা। বনজঙ্গলের ভিতরে কোনও লুকনো উৎস থেকে বেরিয়ে বিশাল বিশাল পাথরের চাঁইয়ের উপর দিয়ে গড়িয়ে বয়ে চলেছে। পুরনো বাংলায় একটা কথা ব্যবহার হতো খুব, দৃশ্যের অবতারণা। সেই অবতারণাই ঘটল আমাদের চোখের সামনে। ঝপাঝপ গাড়ি থেকে নামলাম।

ওই জলধারার নাম, সহজঝোরা। যার জল আটকে মুরগুমা বাঁধ। ঝরনা নানা বিভঙ্গে নেচে নেচে চলতে চলচে একটা বিশাল জলাশয় তৈরি করেছে। সে জলাশয় আর তার চারপাশের সৌন্দর্য শব্দে বর্ণনা করা মুশকিল। বিপুল শান্ত জলরাশি। তার শরীরের নানা বিভঙ্গে নানান প্রাকৃতিক কারুকাজ। কখনও সেটা একঝাঁক সবুজের দ্বীপ। কখনও বিশাল পাথর খণ্ড। আকাশে ছেঁড়া ছেঁড়া শারদ-মেঘ। বাকিটা সত্যেন্দ্রনাথের ভাষায়, ‘নীলের বিথার, নীলের পাথার’। আকাশের নীল মিশেছে জলের বুকে। দূরে তাকালে হালকা কুয়াশার স্বচ্ছ চাদর। সেই চাদর ভেদ করে চোখে পড়ছে পাহাড়ের সারি। তারই দিকে যেতে যেতে সহজঝোরা বাঁক নিয়েছে।

তিনজনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে চোখে সুন্দর ভরে নিচ্ছিলাম। নিচ্ছিলাম, নিচ্ছিলাম, নিচ্ছিলাম…। তারপর সহজঝোরাকে ঝুঁতে ইচ্ছে করল। প্রকৃতিই পাথুরে সিঁড়ির ধাপ ভেঙে তৈরি করে রেখেছে। ধাপ ধরে ধাপে ধাপে নামলাম। তিনজনে এগোলাম জলের উৎসের দিকে। এগোলাম মানে উঠলাম। জলধারার দৃশ্যমান উৎসটা একটু উঁচুতে। সেখানে জঙ্গল আরও ঘন।

ইন্দ্র তখন অ্যাডভেঞ্চারের নেশায় পাগল। ভারী শরীরেই লাফ দিয়ে এগোচ্ছিল। ঝরনাটা যেন চপল কিশোরী। আপন খেয়াল-খুশিতে জলখেলায় মেতেছে। ফলে বহু পাথরই ভিজে। হঠাৎ লাফে ইন্দ্রর পা পড়েছিল ভিজে পাথরে। সামান্য পতন উন্মুখ অবস্থা। দ্রুত টাল সামলেছিল তাই। না হলে এই ‘উপল উপকূলে’ আছাড় খেলে একেবারে কুমড়ো-ফটাস। বেড়ানো শেষ। তবে হাল ছাড়েনি। সুন্দরের নেশায় পেয়ে গিয়েছিল আমাদের। তিনজনেই ঝরনার শেষ লাফ দেওয়া পাথরের কাছ বরাবর পৌঁছেছিলাম। ওর পর থেকে জঙ্গল। ঘন জঙ্গলের ভিতর থেকে শুধু সহজঝোরার বয়ে চলার শব্দ কানে আসছিল।

উৎস সন্ধানে।

জায়গাটা ছাড়তে কিছুতেই মন চাইছিল না। এদিকে দেরিও হয়ে যাচ্ছে। অযোধ্যার আনাচকানাচ ঘুরে আজই পুরুলিয়া গিয়ে ট্রেন ধরতে হবে। তাছাড়া এরকম জঙ্গল আর স্যাঁতসেঁতে জায়গায় সাপখোপ থাকতেও পারে। আমরা অভিযানে রাশ টানলাম।

গাড়ি আবার ঢাল বেয়ে উঠতে শুরু করল। পথে পড়ল হাতি চলাচলের রাস্তা। হাতি-করিডরের এখানেই গত সপ্তাহে একজন মারা গিয়েছে। আমাদের হোম স্টে’র মালিক যেটা হাসতে হাসতে বলেছিলেন। সেসব পেরিয়ে রাস্তাটা পাক খেতে খেতে আরও উঁচুর দিকে উঠেছে। তখন অনেকটা উঁচুতে। আবার ডানদিকে চোখ পড়ল। ‘গাড়ি থামান গাড়ি থামান’ বলে চিৎকার করলাম। গাড়ি থামতেই লাফ দিয়ে নেমে আবার স্থানু। ওই উঁচু থেকে মুরগুমার জলাশয় আর তার চারপাশের অনেকটা এলাকা দেখা যাচ্ছে। জলাশয় তোলপাড় করে একজন সাঁতার কাটছে, জলাশয়ের পাশ দিয়ে আঁকাবাঁকা লাল মাটির রাস্তা, আরও দূরে ছড়িয়েছিটিয়ে থাকা পাড়ার ঘরবাড়িগুলো স্পষ্ট বা গাছের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে। যেন কোনও শিল্পী বিশাল একটা ল্যান্ডস্কেপ এঁকেছেন। সারাদিন দাঁড়িয়ে দেখলেও মন সরবে না।…

উফ! আর কিছু বলার নেই।

অযোধ্যা চক্কর কেটে দুপুর গড়িয়ে ফিরেছিলাম মুরগুমায়। গাড়িচালককে তাপসকে বলেছিলাম, জলাশয়ের পাশের সেই লালরাস্তা দিয়ে নিয়ে যেতে। নিয়ে গেলেন। এবার কাছ থেকে দেখলাম জলাশয়, ঘরবাড়ি, মানুষজন, বাচ্চাদের খেলা আর নাগা ক্যাম্প। তাপস দেখালেন বনবিভাগের একটা পরিত্যক্ত বাংলো। অশান্ত সময়ে বাংলোটি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। আমার আবার প্রাণের ভয়। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কেউ মারা গিয়েছিলেন?’ তাপস বললেন, ‘না। সবাইকে বের করে দিয়ে আগুন দিয়েছিল।’ বৈপ্লবিক নির্দশনের জায়গাটা এখন পর্যটকদের কাছে দর্শনীয় স্থান হয়েছে।

তখন সৌন্দর্য আত্মস্থ হয়েছে। আমরা আবার মানুষের দিকে ফিরেছি। ইন্দ্র কথাবার্তা চালাচ্ছিল। তখন ছিল অশান্ত সময় আর এখন নাগা ক্যাম্পের সময়। কেমন আছেন মানুষজন? তাপস জানালেন, এখন আর কোনও ঝামেলা নেই। ঠান্ডা হয়েছে এলাকা। নাগা জওয়ানেরা? জানলাম, এমনিতে কোনও সমস্যা নেই। খালি চোলাই খেয়ে মাঝেমধ্যে হুজ্জোত করে। দোকানে মাল কিনে দাম দিতে চায় না। ওদের জন্যই নাকি চোলাইয়ের ঠেকটা বসানো হয়েছে।…

গাড়িচালক তাপস।

মুরগুমার পাঠ চুকিয়ে তাপসের গাড়িতেই বেগুনকোদর ফিরছিলাম। তার আগে হোম স্টের মালিকের থেকে বিদায় নিয়েছি। পরিচয় হল ওঁর স্ত্রীয়ের সঙ্গেও। তিনিও খুব অমায়িক। ঘোরার নেশায় সারাদিন কিছু খাওয়া হয়নি। মুখ দেখে বোধহয় কিছু বুঝতে পেরেছিলেন। আমাদের সংকোচের সঙ্গে বললেন, ‘আজ অষ্টমী তো। তাই নিরামিষ। আলুর তরকারি দিয়ে মুড়ি খাবেন?’ এখন মুড়ি খেতে গেলে দেরি হয়ে যাবে। বেরিয়ে পড়েছিলাম তড়িঘড়ি।

ফেরাটা রাতের রাস্তায় নয়। নতুন রাস্তার দু’পাশে আদিগন্ত চাষের ক্ষেত। নানা সবজি। রাস্তাতেও কয়েকজন চাষিকে সবজি নিয়ে বেগুনকোদর বাজারের দিকে যেতে দেখলাম। এদিকে টমেটোর চাষ হয় খুব। তাই সব সারের বিজ্ঞাপনে টমেটোরই ছবি। হুগলিতে যেমন হিরো, আলু। এই সবজি পুষ্টি জোগায় এখানকার বাসিন্দাদের?

শিশুমহল।

জানতে চাইনি। তবে এটুকু বুঝেছি, অতি সাধারণ এঁদের যাপন। উপকরণের বাহুল্য নেই। রাস্তায় চোখে পড়েছে জঙ্গল থেকে জ্বালানি জোগাড় করে মাথায়-সাইকেলে নিয়ে ফেরা বাচ্চা, ব্যক্তিকে। দেখেছি, আশেপাশে ছড়িয়ে থাকা পাথর জোগাড় করে নতুন বাড়ির ভিত গাঁথছে যুবক। নতুন বাড়ি হচ্ছে জঙ্গলের ধারেই। ধারেকাছে কোনও পড়শি নেই। দেখেছি, আদুর গায়ে বা ছেঁড়া জামা পরে কাচ্চাবাচ্চার সরকারি কল ঘিরে খেলায় মত্ত। হয়তো ওটাই বিনোদন।

দু’পাশের আদিগন্ত সবজি খেতের মাঝখানের কাঁচা রাস্তা ধরে যেতে যেতে সেই আলাপি লোকটার কথা মনে পড়ছিল। সেই সরল স্বীকারোক্তি, ‘‘আমরা কী জংলি!’

ছবি- ইন্দ্রজিৎ সাউ

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *