পাহাড়িয়া বাঁশি বিশেষ ভ্রমণ

সবার ওপরে পাহাড় সত্য, তাহার ওপরে ট্রেকিং- প্রথম পর্ব

সোহিনী দেবরায়

অবশেষে এল অতি প্রতীক্ষিত ১৩ মে। আমার শহর কলকাতা ভিজল মরশুমের প্রথম বৃষ্টিতে।

আর আমরা ভিজতে ভিজতে রাত আটটার মধ্যে পৌঁছলাম হাওড়া স্টেশনে। ৯.৪৫ এর পাহাড়িয়া এক্সপ্রেস প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে। তখনও দলের সবাই এসে পৌঁছয়নি। সবাই আসার পর ট্রেনে উঠে নির্দিষ্ট আসন সংখ্যা খুঁজে নিলাম। ট্রেন ঠিক সময়েই ছাড়ল। দোদুল্যমান অবস্থান আর একটানা মৃদু কুঝিকঝিক শব্দের মধ্যে দিয়েই আমার শহর ছেড়ে বহু বহু দূরে চলে যেতে লাগলাম।

শিলিগুড়ি ঢোকার আগে।

কিন্তু ঠিক সময়ে ট্রেন ছাড়লেও পথে হল দেরি। বেশ খানিকটা লেট ছিল। নিউজলপাইগুড়ি পৌঁছতে প্রায় বেলা ১২টা বেজে গেল। আক্ষরিকভাবেই আমাদের ১২টা বেজে গিয়েছিল। ৬৪ জনের টিমকে মানেভঞ্জন নিয়ে যাওয়ার জন্য তিনটি বাস ঠিক করা হয়েছিল। আমাদের দেরি দেখে একটি বাস পালিয়েছে। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর, অনেক হুজ্জতি পোহানোর পর বেশি টাকা দিতে চাওয়ায় বাস আমাদের নিতে রাজি হল। বাসে উঠে বসলাম। দু’পাশের সুন্দরী বনানীকে হাত নাড়াতে নাড়াতে যেন বাসটি এগিয়ে চলেছিল। বাতাস ঠান্ডা ঠান্ডা। কলকাতার মে মাসের ৩৮ ডিগ্রি উত্তাপ সহ্য করা শরীরটা এক ধাক্কায় ১৬ ডিগ্রিতে এসে পড়লে যা হয় আরকী!..।

পাহাড়ের বুকে গজিয়ে তোলা বাসস্থান… (মানেভঞ্জন)।

প্রথম হল্ট নিলাম মিরিকে। মিরিক বাজার থেকে বাজার করা হল। তারপর দ্বিতীয় হল্ট নিলাম দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য। তারপর একটানা বাস চলতে লাগল। পাহাড়ে সেদিন ভোট ছিল। কিছু রাস্তা বন্ধ। ঘুরে ঘুরে মানেভঞ্জন পৌঁছতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। সেখানকার তাপমাত্রা ১২ ডিগ্রি। বেশ ঠান্ডা লাগছিল। শীতের পোশাক পরে নিয়ে বাস থেকে নামলাম। থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা দারুণ ছিল।

সবুজের মাঝে ছোটাছুটি… (চিত্রে পাহাড়ের এক দৃশ্য)।

হুঁকোদানি, রাজ-আয়না, সূক্ষ্ম কারুকাজ করা টেবিল, নরম গদি দেওয়া শোয়ার জায়গা, অসাধারণ সুন্দর একটা পেল্লাই ঘরে মানেভঞ্জনে একরাত কাটানোর পরে এল আমাদের প্রথম ‘পাহাড়ি সকালবেলা’। দিনটা ছিল বৃষ্টিমুখর। জলে ভরা মেঘেরা যেখানে সেখানে অভিমান করে দাঁড়িয়ে একরাউন্ড করে ‘কেঁদে’ নিচ্ছিল। কিন্তু সেই অভিমানিনীর কান্না দেখার ফুরসত আমাদের আছে নাকি? আমাদের যে অনেক পথ হাঁটতে হবে!! বৃষ্টি মাথায় নিয়েই হাঁটতে হবে।

বিপ্লব স্যার হলেন আমাদের কোঅর্ডিনেটর। স্যার বললেন, সকাল ৯টায় আমরা মুভ করব। প্রথমে যাব চিত্রে, তারপর মেঘমা…মেঘমাতে দুপুরের খাবার খাবো…তারপর যাব টুমলিং। মোট ১৩ কিমি। কিন্তু চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্যে দিয়ে ১৩ কিমি হাঁটা তো সোজা কথা নয়।

তাই আমরা মেয়েরা কয়েকজন, মানে আমি, কবিতাদি, নূপুরদি ভাবলাম, আগেই কিছুক্ষণ হেঁটে নিই। সঙ্গে নিলাম শ্রেয়সীকে। চারপাশটা দেখাও হবে আর endurance trainingও হবে। আর হবে অনেক সেলফি-ছবি।

রডোডেনড্রন।

তারপর ৯টা বাজল যেই, স্যারেরা আমাদের ৬৪ জনের মধ্যে যাঁরা হাঁটার জন্য প্রস্তুত, তাঁদের নির্দেশ দিলেন একে একে লাইন করে দাঁড়াতে। ১০-১২ জন ছাড়া প্রায় প্রত্যেকেই হাঁটবেন বলে মনস্থির করলেন। এমনকী পাঁচ-ছয় বছরের পুচকুগুলোও হাঁটার জন্য তৈরি হয়ে গেল। বিপ্লব স্যার বলে দিলেন যে বাচ্চাদের যদি কোনও অসুবিধা হয়, তবে তাদের পথ থেকে গাড়িতে তুলে নেওয়া হবে।

অতঃপর আমরা হাঁটতে লাগলাম। সুকমলস্যার সবার আগে গিয়ে আমাদের প্রত্যেককে ৪-৫টি করে হরেক রকমের লজেন্স দিলেন। প্রতিবার হাঁটা শুরুর আগে তিনিই লজেন্স দিয়ে থাকেন। অদ্ভুতভাবে লজেন্সগুলো পাওয়ার পরই এক অনাবিল আনন্দ হয়। খুব ছোট্ট ছিলাম যখন তখন আমাকে লজেন্স দেওয়া হতো। বড় হওয়ার পরে মনে পড়ে না আর কেউ কখনও লজেন্স দিয়েছে। তাই ট্রেকের দিনগুলোতে সেই ছোট্টবেলার দিনগুলো ফিরে পাই।

তিনি সর্বত্র বিরাজমান, আছে তাঁর বাসস্থানও। (মেঘমা যাওয়ার পথে এক গুম্ফা)।

এবড়োখেবড়ো পাহাড়ি রাস্তার মধ্যে দিয়ে হাঁটতে লাগলাম। কখনও ক্লান্ত হয়ে পড়লে, দম ফুরিয়ে গেলে কোথাও বসে খানিক বিশ্রাম নিয়ে নিচ্ছিলাম। মাঝে খুব বৃষ্টি হয়েছিল। থামিনি। একমাথা বৃষ্টি নিয়েই হেঁটেছি। ঠান্ডায় কুঁকড়ে গেছি। তবু হেঁটেছি। এভাবেই একে একে চিত্রে, মেঘমা পার হলাম। পথে দেখলাম রক্তলাল রঙের রডোডেনড্রন। প্রথমবার। আর প্রথম দেখাতেই প্রেম। রাস্তায় দেখলাম পাহাড়ি ঝরনা, সবুজের ছুটোছুটি আর নীল সাদা মেঘের খেলা। তাদের বিরক্ত করিনি। শুধু মুহূর্তগুলো ক্যামেরাবন্দি করার চেষ্টা করেছি।

এভাবেই হাঁটতে হাঁটতে ১৩ কিমি পার করে টুমলিং পৌঁছালাম। পেলাম এক দারুণ স্পেশাল ডিল্যাক্স রুম। চারজন মেয়ে মিলে সেই রুম শেয়ার করলাম। একটা গোটা সন্ধ্যে আড্ডা, গান, তর্ক, গল্পের মধ্যে দিয়ে কাটল। সেদিন দলের সবার সঙ্গে পরিচিতও হলাম। রাত্রের খাবারে পেলাম গরম গরম ডিমের ঝোল, আলুভাজা, ডাল আর ফাইন চালের ভাত। ব্যাস! আর কী চাই..!! খুব ক্লান্ত ছিলাম। খেয়েই একটানা ঘুম।

দূরে এক নীল পাহাড় (টুমলিংয়ে)

প্রথমেই বলে নেওয়া ভাল চিত্রে, মেঘমা, টুমলিং সব নেপালে। আর কালাপোখরি ভারতে। কালাপোখরি (৩১৮৭ মিটার) হল দার্জিলিংয়ের সিঙ্গালিলা ন্যাশনাল পার্কের ভেতরে একটি ছোট্ট গ্রাম। মানেভঞ্জন থেকে সান্দাকফু যাওয়ার সময় কিছু এলাকা নেপালের মধ্যে পড়ে আর কিছু এলাকা ভারতের মধ্যে।

‘কালাপোখরি’ একটি নেপালি শব্দ। ‘কালা’ মানে অন্ধকার বাগাড়। আর ‘পোখরি’ মানে লেক বা জলাশয়। বলা বাহুল্য অপেক্ষাকৃত গাঢ় জলবিশিষ্ট একটি জলাশয় থাকার জন্য এই নামকরণ। (আমি সেই লেকের ছবি দিয়েছি। যদিও আমার তোলা নয় ফটোটি। আমাদের গ্রুপেরই কোনও দাদা হয়তো তুলেছেন)।

মেঘের দেশে, কালিপোখরির পথে।

এই সমস্ত তথ্য দিয়ে আমাকে সাহায্য করেছেন কুশাংজি। তিনি হলেন পৃথিবীর একমাত্র ব্যক্তি যিনি চারদিক দিয়েই এভারেস্টে উঠেছেন। এতবড় একজন সেলিব্রিটি আমার মতো একজন সামান্য মানুষকে এভাবে দাদার মতো করে বুঝিয়ে দেবেন সত্যি বিশ্বাস হচ্ছিল না। সত্যি আমি ভাগ্যবান।

ভোরবেলা হোটেলের কয়েকজন জানালেন, কাঞ্চনজঙ্ঘার শিখর পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে..। প্রায় সবাই তা দেখতে গেল। আমি যাইনি। বাড়ির জন্য খুব মনখারাপ লাগছিল। প্রায় তিনদিন ধরে বাড়ির কারোর সঙ্গে কথা হচ্ছিল না যে! সবাইকে খুব মিস করছিলাম। আমি বসে বসে গল্পের বই পড়ছিলাম

সাড়ে সাতটার মধ্যে তৈরি হয়ে প্রাতরাশ করে নিলাম। তারপর হাঁটা লাগালাম। ঠিক হল, যাঁরা ধীরে হাঁটেন বা যাঁরা শারীরিক কারণে পিছিয়ে পড়েন তাঁরা আজ আগে থাকবেন। আর আমরা পিছনে। সেইভাবেই হাঁটতে লাগলাম। আমার সঙ্গে হাঁটতে লাগল পাঁচ বছরের পুচকু অদ্রিজা, অনীক স্যারের মেয়ে।

অসম্ভব সুন্দর পাহাড়ি বাঁকের মধ্যে দিয়ে আমরা ধীরে ধীরে এগোতে লাগলাম। আজ আকাশ মেঘলা ছিল না। বৃষ্টিও না। মনে হচ্ছিল পাহাড়ি আকাশ আজ প্রাণ খুলে হাসছে। আমরাও হাসছিলাম। গল্প করতে করতে…ছবি তুলতে তুলতে চড়াই-উতরাই পার হয়ে বেলা ১২.১৫তে পৌঁছলাম গৌরীবাস। সেখানে দুপুরে খেলাম

কালাপোখরি- একটি কৃষ্ণবর্ণা হ্রদ।

আর তারপরেই তুমুল বৃষ্টি! বেশ কিছু সময় অপেক্ষা করতে হল প্রকৃতিদেবীর কান্না মোছানোর জন্য।

তারপর আবার হাঁটা শুরু করলাম। প্রায় দেড় ঘণ্টা হাঁটার পর অসম্ভব পায়ে ব্যথা হচ্ছিল। খুব অসুস্থ লাগছিল। তাই ধীরে ধীরে হাঁটতে লাগলাম। আমার অবস্থা দেখে বলাইকাকু, বিভা, বিভার বাবা (কাকুর নাম মনে পড়ছে না) আর প্রতিম দাঁড়িয়ে গেল। ওরা আমার সঙ্গে হাঁটতে লাগল। কালাপোখরি পৌঁছতে বিকেল সাড়ে ৫টা। গিয়ে দেখি, ষাটোর্ধ্ব অসীমস্যার এই ভয়ঙ্কর ঠান্ডার মধ্যে পাহাড়ের বাঁকে দাঁড়িয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। তিনি হোটেলে যাওয়ার রাস্তাটা দেখিয়ে দিলেন।

বাড়ি ছেড়ে এত দূরে থাকার কষ্টটা কিছুটা যেন লাঘব হল। সত্যি এই Ofmt Rfi ক্লাবটা পুরো বাড়ির মতো। বাড়িতে ফিরতে দেরি হলে এভাবেই তো বাড়ির মানুষ অপেক্ষা করেন।

ছবি- লেখিকা

(চলবে)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *