জঙ্গল যাপন বিশেষ ভ্রমণ

শম্ভু আর তিন বন্দিনী প্রেমিকার গল্প— দ্বিতীয় পর্ব

দীপক দাস

ঝেঁপে বৃষ্টি হওয়ায় পরিবেশ ঠান্ডা। বেশ শীত শীত ভাব। তার ওপরে পাখা চলছে!

একটা বিষয় খেয়াল করে দেখেছি, এই জগৎ সংসারে যারা সমৃদ্ধ তাদের কথাই চলে। সেই সমৃদ্ধি যে কোনও দিকেই হতে পারে। এই যেমন আমাদের ইন্দ্র। প্রকৃতি ওর শরীরে অতিরিক্ত চর্বির দু’চারটে পরত বিছিয়ে দিয়েছে। ঠিক প্রকৃতির কিনা জানি না। তবে দিনে গোটা চার-পাঁচ ডিম, মাখন দেওয়া কফি, একদিন ছাড়া ছাড়া নানারকম মোগলাই খানা ওকে স্নেহ-সমৃদ্ধ করেছে। পরোক্ষে অবশ প্রকৃতিই হল। ডিম পাড়ে যে মুরগি, যে গরুর দুধে মাখন হয়, যে গাছের ফসল কফি এমনকী মোগলাইয়ের আলু পর্যন্ত প্রকৃতির দান। এই সমৃদ্ধির ফলে হয় কী, সব সময়ই ওর গরম। অনবরত হাঁসফাঁস করছে। পারলে হাতিদের মতো জলে চুবে থাকে। ঠিক করেছি, এবার গরমে ঘুরতে যাওয়ার আগে ওকে একটা ফোল্ডিং বাথটাব উপহার দেব। যাতে জল ভরে ও রাতে ঘুমোবে। আমাদের আর পাখা চালাতে বাধ্য করবে না।

শীতভাবের জন্য রাতে মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙে যাচ্ছিল। ভোরবেলা আধো ঘুমে মনে হল, কে যেন রিনরিনে স্বরে ডাকছে, ‘এই ওঠো, ওঠো নাআআআ…জঙ্গলে ঘুরতে যাবে না। দেরি হয়ে যাচ্ছে তো!’ ঘুমের ঘোরেই মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে জবাব দিতে যাব, কানের কাছে ক্যানক্যান করে বেজে উঠল, ‘ওঠো, ওঠো, ওঠো…জঙ্গলে ঢুকতে দেরি হয়ে যাবে। হরিণ সব পালাবে।’ হতচ্ছাড়া ইন্দ্র! সুন্দর স্বপ্নটায় চিৎকারের হাতুড়ি চালাল। নিকুচি করে ভোরের স্বপ্ন বলে উঠে পড়লাম। দীপু তখনও ঘুমোচ্ছে বা মটকা মেরে পড়ে আছে। বাকি তিনটে দোয়েলের কাছে। শ্যামায় কেউ শোয়নি।…

আড়মোড়া ভাঙা নবারুণ।

গেস্ট হাউস থেকে বেরোতেই একটা ভিজে সকালের সঙ্গে মোলাকাত হয়ে গেল। মধুর। এমন সকাল যে কতদিন দেখিনি! তখন সূর্য সবে আড়মোড়া ভেঙেছে। কিন্তু চোখ খোলেনি। ফলে ভিজে মাটির রস শুকোতে শুরু করেনি। টাওয়ারের সামনের মোরাম ফেলা রাস্তাটা আরও বেশি লাল। চারপাশের গাছগুলো প্রবল গরমের পরে ধারাস্নানে জল ছিটিয়ে চান করা শিশুর মতো সজীব। পাখিগুলো ডেকে চলেছে একটানা। সেই মনভরানো সকালে ক্লান্তি-ক্লেদ-মনখারাপ-প্রিয়জনের দেওয়া আঘাতের ক্ষত থেকে চুঁইয়ে পড়া রক্ত— সব ধুয়ে যেতে লাগল। সজীব হয়ে উঠছিলাম গাছগুলোর মতে।

ঠিক হল, জঙ্গলের ভিতর দিয়ে বড় রাস্তায় উঠব। টাওয়ারের পাশের জঙ্গলে তখন বহু লোকের আনাগোনা। সকলের হাতে ব্যাগ। আম কুড়োচ্ছে ওরা। ব্যাগগুলো ভালই ভর্তি। দেখেই আমাদের দলের আমকুড়োনদের মনখারাপ। রাতে আরও কিছুক্ষণ আম কুড়োলে হতো! মাৎসর্য কি এত সহজে যাওয়ার!

জঙ্গলের পথে অভিযানের পরিকল্পনা পরিত্যক্ত হল দু’মিনিটেই। আমকুড়োনদের একজনের কাছে পথের হদিস জানতে যাওয়া হয়েছিল। সে ব্যাটা হাতটা ‘আন্দাজ আপনা আপনা’ সিনেমার ক্রাইম মাস্টার গোগোর মতো হাওয়ায় নাড়িয়েচাড়িয়ে স্থানীয় ভাষায় যা বলল তাতে আর এগোতে সাহস হল না। জঙ্গলে নির্দিষ্ট পথ থেকে একটুখানি সরে গেলেই লক্ষ্য থেকে অনেকটা ফারাক তৈরি হয়। তাছাড়া এখন দেরি হয়ে যাচ্ছে। সোজা রাস্তাতেই সড়কে উঠলাম। সেই পুলিশের দলটা। এখন একটু পিছিয়ে ক্যানেলে ঢোকার রাস্তার মুখে দাঁড়িয়ে। লরির দিকে হাত বাড়াচ্ছে এখনও। তার মানে সারা রাত ধরেই ‘বাড়িয়ে দাও না হাত’ করেছে। একবার মনে হল, কাগজপত্র নয়, টাকার মতো কিছু একটা পকেটে ঢোকাল। কী জানি বাবা। আমার চালশে পড়া বয়স। কী দেখতে কী দেখছি।

সিক্ত সরণি।

গতরাতে কথা হয়েছিল। তাই আমাদের দেখে পুলিশদের একজন বললেন, ‘মিস করে গেলেন। আজ গাদা হরিণ এসেছিল।’ কখন? কখন? সম্মিলিত জিজ্ঞাসা। ‘এই তো পাঁচটা নাগাদ। এই পর্যন্ত চলে এসেছিল আজ।’— পুলিশ অফিসার ক্যানেলের দিকে রাস্তায় অঙ্গুলি নির্দেশ করেন। জায়গাটা খুব কাছেই। এখন ছ’টা বাজে। আমরা মাত্র এক ঘণ্টা লেট। বাঙালির ক্ষেত্রে ওটা কিছুই নয়। হরিণও তো বাংলার। ওই পাঁচ হরিণের দলে জুয়েলের মতো একটা লেট লতিফ তো থাকতেই পারে! তার সঙ্গে আমাদের মোলাকাত তো হতে পারে না? জোরে পা চালালাম আমরা।…

যত গভীরে যাচ্ছিলাম ততই জঙ্গল আচ্ছন্ন করছিল। সবে বসন্ত পার করেছে। জঙ্গলের দেহে এখন কিশোরীর লাবণ্য। একে কচি পাতা, তার ওপরে বৃষ্টির জলে লালধুলোর আস্তর ধুয়ে গেছে। জঙ্গল যেন সেই শাড়ির বিজ্ঞাপনের মতো, ছোট্ট টিপ, হালকা লিপস্টিক আর…।

ভোরের জঙ্গলের আর বেলার জঙ্গলের বেশ তফাৎ। দু’টোর গন্ধও আলাদা। এই জঙ্গলে ভিজে মাটি, ঝরে পড়া পচা পাতায় জল পড়ে একটা মোদো গন্ধ তৈরি করেছিল। সেই মাদকতা নাকে নিয়েই আমরা হাঁটছিলাম। তখনই চোখে পড়ল পায়ের ছাপটা। হরিণের পা। দলের একটা বোধহয় মাঝ রাস্তা বরাবর হেঁটে গিয়েছে। তার পায়ের ছাপের অনুগামী হলাম আমরা। কচি আমাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাঁটতে পারছিল না। জঙ্গলে ছবির এত বিষয়! পাতায় ধরে রাখা বৃষ্টির হীরে-ফোঁটা, গাছপালার ফাঁক নবারুণের উঁকি, জঙ্গলের রূপ…কোনটা ছেড়ে কোনটা তুলবে। আর জুয়েলের ঘুমের রেশ তখনও কাটেনি। আধখোলা চোখে হালকাপুলকা শরীরটা টেনে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল।

মহাপ্রস্থানের পথে যেন।

জঙ্গলে ঢোকার পরেই একটা কুকুর আমাদের সঙ্গী হয়েছিল। আমাদের ছ’জনের দল। সঙ্গী কুকুর। মহাপ্রস্থানের পথে নাকি! কিন্তু দলে সকলেই পুরুষ। মহাপ্রস্থানের পথে তো একটা দ্রৌপদী লাগবে। তখনই মনে পড়ল আমার পুরনো অফিসের এক সিনিয়রের কথা। আমার গলার স্বরটা নাকি মিষ্টি। শুনলে মনে হয়, অনেক কাচের চুড়ি ঝনঝনিয়ে ভেঙে পড়ছে। তার মানে তো আমাকেই…! উপমাটা টপ করে গিলে নিয়ে গম্ভীর মুখে হাঁটতে শুরু করলাম। তখনই কে যেন, ইন্দ্র বোধহয়, বলল, ‘ক্যামেরাট্যামেরা দেখে কুকুরটা ভেবেছে আমরা শিকারে যাচ্ছি। ও ভাগটাগ পেতে পারে।’ দীপু ধমক দিল, ‘যাও ফিরে যাও।’ ধমককে পাত্তা না দিয়ে তিনি আমাদের আগে আগে হাঁটতে শুরু করলেন। আমি একটু বুঝিয়েসুঝিয়ে কাজ করানোয় বিশ্বাসী। একবার মনে হল, গায়ে-গলায় হাত বুলিয়ে ফিরে যেতে বলি। কিন্তু প্রাণীপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হতে পারলাম না। কুকুরটা চর্মরোগে আক্রান্ত।

আবার হাঁটা। শুনেছি, জঙ্গলে একটা ডোবা আছে। সেখানে নাকি হরিণ, শুয়োরেরা জল খেতে আসে। জঙ্গলের এদিক ওদিক ঢুঁরে একসময় ডোবার কাছে এসে পৌঁছলাম। কিন্তু কেউ কোত্থাও নেই। হরিণ-শুয়োর কি মানুষ? সারাক্ষণ খাই খাই? ওদের খাদ্য-পানীয় গ্রহণ জৈবিক ঘড়ি মেনে হয়। সেই ঘড়ি মেনে জীবন কাটায় বলেই ওদের কোনও ডাক্তার লাগে না। ডাক্তার লাগে না বলেই ভুয়ো ডাক্তারের হাতে প্রাণ দেওয়ার ভয়টা নেই।

হরিণ, শুয়োরদের জলযোগের সেই ডোবা।

ডোবা পার করে আবার হাঁটা। কতদূর? তখনই দেখা হল এক বধূর সঙ্গে। জঙ্গলে কাঠ ভাঙছে। কত বয়স হবে? খুব বেশি হলে আঠেরো। সুন্দর একটা লালছাপা শাড়ি পরেছে। কানে ঝুমকো দুল। চোখে-মুখে ঘুমের আলতো রেশ। এমন শাড়ি পরে জঙ্গলে কাঠ ভাঙছে? হয়তো এটাই ওর একমাত্র শাড়ি। হয়তো কাল কোনও আত্মীয়ের বাড়ি গিয়েছিল। আজ কাচার পরে তুলে রাখবে। কিশোরী বধূকেই জিজ্ঞাসা করলাম, ‘হরিণ আছে?’ উত্তর এল, ‘গাদা। ক্যানেলে পাশে মিলবে।’ আবার গাদা! আমরা গাদা মানে খড়ের স্তূপ বুঝি। সেই স্তূপের আরও ছোট একক আছে। যেমন, আঁটি। কিছু খড় এক সঙ্গে বাঁধা। অনেক আঁটি মিলে এক তরফা। তরফা সাজিয়ে গাদা। আমরা গাদা হরিণ দেখতে চাই না। এক আঁটি হরিণ হলেও চলবে।

পায়ের দাগ দেখতে দেখতে হা-ক্লান্ত আমরা। তারপর হঠাৎই…ক্যানেলের ধারে। মুগ্ধ বিস্ময়ে থমকে গেলাম। কেমন সেই মুগ্ধতা? শব্দ দিয়ে ছবি আঁকতে পারব না। উদাহরণ দিই। ‘জুরাসিক পার্ক’ সিনেমাটা মনে আছে? পার্কে যাওয়া দলটার প্রথম ডাইনোসর দেখা? কিংবা ‘অবতার’? সেই আলো জ্বলা, জেলিফিশের মতো কিছু নেমে আসা জায়গাটা? বা বিশাল পাখিদের পিঠে চড়ার জায়গাটা? সিনেমার চরিত্রগুলোর মতো দর্শকেরা নির্বাক হয়ে গিয়েছিল অবর্ণনীয় সৌন্দর্যে। আমরাও হলাম। ক্যানেলটা বাঁধানো। এখন জল নেই। কিন্তু একসময়ে ছিল। তার বাঁধানো দেওয়ালে শ্যাওলার জলছাপ। বুকে ঘাস-গুল্ম। দু’পাড়ে পায়ে চলার রাস্তা। নরম মাটির। বৃষ্টিতে হয়েছে তুলতুলে। ক্যানেলকে ঘিরে রেখেছে দু’পারের জঙ্গল। সে চলেছে বহুদূর। সাথী হয়েছে জঙ্গলও। কতরকমের পাখির ডাক ভেসে আসছে জঙ্গল থেকে। দেখতে পাচ্ছি না তাদের। কিন্তু তাতে কী! কান যে ভরে উঠছে!

 অপরূপা ক্যানেল।

ক্যানেল পাড়ের রূপ একটু পুরনো হতেই হরিণের কথা মনে পড়ল। দুই সুন্দরের তুলনা করলে যা তখনও পাওয়া হয়নি সেই বেশি টানে। এটাই মানবচরিত্র। শার্লক হোমসের গল্পে অপরাধীদের সূত্র পেতে বৃষ্টির একটা ভূমিকা থাকে। ইংল্যান্ডের ছিঁচকাঁদুনে আবহাওয়ায় এই মেঘ, এই বৃষ্টি। ভিজে মাটিতে মেলে অপরাধীদের পায়ের ছাপ। কালকের বৃষ্টির নরম মাটিতে অনেক হরিণের পায়ের ছাপ। গাদা যাকে বলে। দু’একটার পা হড়কেছে। কিংবা মাটিতে পা দাবিয়ে তারা গুঁতোগুঁতি করেছে। ফলে ছাপ গভীর এবং ঘাঁটা। কিন্তু তারপর? নালার কাছে গিয়ে সেই ছাপগুলো সব হারিয়েছে। কোথায় যে গেল!

গাদা হরিণ।

জঙ্গলে কাঠ কাটতে ঢুকছিলেন একদল মহিলা। তাঁদের একজন বললেন, তাঁর বাড়ির কাছে তিনটে হরিণ আছে। ফসল নষ্ট করছে। উৎসাহিত হয়ে তাঁর বাড়ির দিকে হাঁটা লাগালাম। ক্যানেলের ওপারের জঙ্গলেও তখন কাঠের খোঁজে মহিলারা। কচি ক্যামেরা তাক করতেই এক বৃদ্ধা বুক চিতিয়ে দাঁড়ালেন। বার্তাটা স্পষ্ট, তাঁরা কোনও অন্যায় করছেন না। জঙ্গলে তাঁদের অধিকার আছে। তাঁদের জীবন সংগ্রামের উপকরণ মেলে এখান থেকে।

ক্যানেলের পার বরাবর হাঁটতে হাঁটতে পা ব্যথা। না বাড়িঘর, না হরিণ। ফিরতে শুরু করলাম। তবে জঙ্গলের ভিতর থেকে মাঝে মাঝে হরিণের ডাক ভেসে আসছিল। ডাক শুনলেই ইন্দ্র চঞ্চল হয়ে উঠছে। ঘ্যানঘ্যান করছে জঙ্গলে ঢোকার জন্য। ছোঁড়া ভেবেছে, হরিণগুলো কণ্বমুনির আশ্রমের। ঋষি ধ্যানমগ্ন, ঋষিপত্নী গৃহকর্মে। আর অনুসূয়া, প্রিয়ংবদাকে নিয়ে শকুন্তলা হরিণদের কচি ঘাস খাওয়াচ্ছে। গেলেই দেখা মিলবে। শীতকালে চিড়িয়াখানায় যাওয়া পাবলিক তো! হঠাৎ ফোন আসায় ওর হরিণ দেখার ইচ্ছেয় ভাটা পড়ল। আমাদের যন্ত্র-রথের সারথির ফোন। বাসুদেবপুরে যাব। বন দফতরের হাতি দেখতে।…ক্যানেলের পাড় ছাড়ার আগে একটা কথা বলে নিই। সফরগল্পে অরিজিতের কথা বেশি আসছে না। তার কারণ একটাই, ও ছেলে আত্মমগ্ন। এই জঙ্গলের মতোই নিঝুম। জঙ্গলে তা-ও পাখি ডাকছে। ওর মন-বনে পাখি ডাকলেও সে ডাক বোধহয় ওর মতোই অরব। আমাদের কানে এসে পৌঁছচ্ছে না।…

সাহসিনী।

আমাদের যন্ত্র-রথ, ভ্যানোর সারথি বেশ গল্পবাজ। বাসুদেবপুরের দিকে যেতে যেতে কত গল্প যে শুনলাম। এই জঙ্গলে বছর পাঁচেক আগে একটা হাতি বিদ্যুতের তারে শক খেয়ে মারা গিয়েছিল। সারথির তাতে কোনও কষ্ট ছিল না। বরং গর্বের সঙ্গে জানাল, সুযোগ বুঝে সে হাতে তুলে হস্তি-দণ্ডের ওজন করে নিয়েছিল। মানুষের কত যে বিচিত্রচারী আগ্রহ! দ্বিতীয় গল্পটা গত সপ্তাহের। এলাকার এক মাস্টারমশাই নাকি তাঁর স্কুটি নিয়ে সোজা এক হাতির পিছনে ধাক্কা মেরেছিলেন। স্কুটি তো উল্টে গোঁ গোঁ করছে। আর সেই আওয়াজের ভয়ে হাতিটা নাকি চোঁচাঁ দৌড়ে জঙ্গলে ঢুকে গিয়েছিল। তবে সেরা গল্প তিন নম্বরটাই… দুই মাতাল জঙ্গলের পথ ধরে ফিরছিল। তার মধ্যে একজন তালে ঠিক। সে সাবধান করল, ওদিকে হাতি আছে। যাওয়া ঠিক নয়। অন্য মাতাল অকুতোভয়। সে আমাদের ইন্দ্রর মতোই অভয় দিয়েছিল, ‘কিছু হবে না।’ ইন্দ্রর কিছু হবে না মানে অবশ্যম্ভাবী ভাবে সেটাই হবে। হলও তাই। হাতির সামনে পড়ে গেল দুই মাতাল। হাতি দেখেই তালে ঠিক দে ছুট। কিন্তু ইন্দ্ররূপী মাতাল সোজা গিয়ে ‘গণেশবাবা, আমি এলাকার জামাই। রক্ষে করো বাবা’ বলে হাতির শুঁড় জাপটে ধরেছিল। হঠাৎ শুঁড়ের ওপর এমন আপদ দেখে ভড়কে গিয়ে হুড়মুড়িয়ে দৌড় লাগিয়েছিল গণেশবাবা।

আমাদের সারথি।

গল্পের দুধ-জলের খতেন নিতে যাইনি আমরা। ভালই লাগছিল। গল্প শুনতে শুনতে মাচানতলা ফেলে, নতুনগ্রাম পাশে রেখে পৌঁছেছি আরেকটা ক্যানেলের কাছে। খুব সুন্দর জায়গা। তার আগে একটা মজার ঘটনা ঘটেছে। ভ্যানোচালক হঠাৎ রাস্তার মাঝে গাড়ি থামিয়ে রহস্যময় গলায় বলে উঠেছিল, ‘দেখুন।’ দেখলাম। পাশের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা জন্তু। প্রথমে ভেবেছিলাম নেকড়ে। ভাল করে দেখে বুঝলাম, শিয়াল। আমাদের বাড়ির উঠোন দিয়ে এদের ভাই-বেরাদরেরাই রোজ রাতে ছোটে। দীপুর বাড়ির পাশের ডাঙায় হল্লা করে। ইন্দ্র ওর ঘরের জানলা দিয়ে ছবি তোলে আর আমাকে পাঠায়। এটা অবশ্য বেপাড়ার শিয়াল।

কচিকে বললাম, ‘ছবি তোল।’ ব্যাটা বোধহয় ঘুমোচ্ছিল। ঘুমের ঘোরে হয়তো শুনেছিল, ‘ধরে আন ব্যাটাকে’। ভুটভুটি থেকে লাফিয়ে ক্যামেরা বাগিয়ে তেড়ে গেল। ফিরে এল পলায়নপর শিয়ালের লেজের ছবি তুলে। সে পোজ দেয়নি। ছুট দিয়েছে। আমাদের শিয়াল দেখাতে পেরে ভ্যানোচালকের তখন কী গর্ব, ‘দেখলেন, একটা জন্তু দেখাই দিলাম।’ আমি আর দীপু পরস্পরের দিকে তাকিয়ে হাসলাম। কিন্তু আমরাও যে শিয়াল চেনা গেঁয়ো ঠাকুর সেটা আর ফাঁস করলাম না।

ক্যানেলের পাড়ে ফটোসেশন চলল কিছুক্ষণ। তারপর ঢুকে গেলাম বাসুদেবপুরে যাওয়ার জঙ্গুলে রাস্তায়। এলাকাটার রূপ বর্ণনা করব না। ছবি দিচ্ছি আমরা। নিজেরাই দেখে নিন।

লালচে রাস্তা, মন কেমন করা প্রকৃতি, পাখির কলকাকলিতে সরব বন আর বুনো গন্ধ মাখতে মাখতে হঠাৎই দেখা হয়ে গেল শম্ভুর সঙ্গে। দেখতে পেলাম শীলাবতী, ফুলমতি আর কাবেরীকেও। রাস্তার পাশে কাঁটাতার দিয়ে ঘেরা জায়গায় রয়েছে তারা। শম্ভু বন দফতরের কুনকি দাঁতাল। বাকিরা তার সঙ্গী। চারজনের পায়েই বেড়ি। কেউ কারও কাছে যেতে পারে না। দূর থেকেই শুঁড় দুলিয়ে প্রীতি সম্ভাষণ করে। জঙ্গলের মাঝে হাতি দেখে আমরা তো কত খুশি। হোক না তারা কুনকি। ধৃতিকান্ত লাহিড়ী চৌধুরীর ‘হাতির বই’য়ে বন দফতরের কুনকি যাত্রাপ্রসাদের কত কীর্তি পড়েছি!

আমি হাতিদের খোঁজখবর নেওয়ার তাল খুঁজতে শুরু করলাম। বাকিরা ছবি তোলায় মগ্ন হল। এর মধ্যে আমাদের শম্ভু, মানে ইন্দ্র, ওর সেই অতিরিক্ত চর্বির কারণে, শীলাবতীর ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করেছিল। কাঁটাতার ঘেঁষে সেলফি তুলছিল। কিন্তু শীলাবতী অত্যন্ত শম্ভুনিষ্ঠ। সে ওই গায়ে পড়াটা পছন্দ করেনি। শুঁড় উঁচিয়ে ঘোঁত করে আওয়াজে বিরক্তি প্রকাশ করতেই আমাদের শম্ভু ছুটে পালিয়ে এসেছিল।

বনকর্মীদের সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছে নিয়ে দফতরের প্রবেশ দ্বারে ঢোকার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু ঢুকতে নিষেধ করা হল। একজন বেরিয়ে এলেন। তিনি মাহুত। গতকালই ফুলমতিকে গরুমারা থেকে এখানে এনেছেন। তাঁর কাছেই শুনলাম, এখান থেকে এক হাতিকে উত্তরবঙ্গ নিয়ে যাওয়া হবে। কাকে নিয়ে যাওয়া হবে সেটা ঠিক হয়নি। ওপরতলা থেকে অর্ডার এলে বোঝা যাবে। আমরা গল্প জুড়লাম মাহুতের সঙ্গে। কত কথাই বললেন তিনি। জানলাম, শম্ভু, শীলাবতী আর কাবেরী বাঁকুড়ার জঙ্গলেরই হাতি। এখানকার জঙ্গল থেকেই উদ্ধার করা হয়েছিল।

শম্ভু, শীলাবতী আর ফুলমতী।

শীলাবতীকে পাওয়া গিয়েছিল এখানকার এক নদীর পাড় থেকে। সেই নদীর নামেই নাম তার। কাবেরীর এক আশ্চর্য গুণ। সে ক্যামেরা দেখলেই নানাভাবে পোজ দেয়। ইন্দ্র খুশি হয়ে ছবি তুলেই চলেছে। ব্যাটা এখন শীলাবতীকে ছেড়ে কাবেরী-মগ্ন হয়েছে।

এখানে রোজ হাতিদের ঘোরাতে নিয়ে যায়। মাহুতের কাছেই শুনলাম, হাতি বদল হবে বলে আজ আর চরতে যাবে না কেউ। মজা নেই। তাই আমরাও আগ্রহ হারালাম।

সবুজের সন্তান।

জুয়েলটার সকাল থেকে দফায় দফায় ফোন আসছে। কথা বলতে বলতে প্রায় জঙ্গলে সেঁধিয়েছে। ব্যাটাকে কুড়িয়ে নিয়ে সারথি লোহারকে বললাম, ‘চালাও ভ্যানো চাতাল।’

(চলবে)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *