ইতিহাস ছুঁয়ে

একটি বসন্ত, কয়েকটি শিমুল আর ড্যাঞ্চিবাবুদের ফিকে গল্প

সৌমিত্র সেন

বাঁকাভুরু এবং নৈশযাত্রা

শুনছেন! এখন যেটা পড়ছেন (মানে, এই ‘যথা ইচ্ছা, তথা যা’র ছাতায়) সেটা মোটেই কোনও ভ্রমণকাহিনি নয়, এটি একটি নিপাট গোয়েন্দাকাহিনি! অন্তত, আমার নিজের তেমনই মনে হয়েছে (আপনার যা খুশি মনে হতে পারে।)। এবং এটুকু জেনে রাখুন, এই গোয়েন্দাকাহিনিতে তদন্তে নামা হবে কি, হবে না, তার সবটাই ঠিক হয়েছিল আধ ঘণ্টায়!

হ্যাঁ, একদম ঠিক পড়ছেন, আ-ধ-ঘ-ণ্টা-য়! এই গোয়েন্দাগিরি চোর-ডাকাত-খুনি-টুনি (টুনির মা তো নয়ই)— কারও খোঁজেই নয়। স্রেফ একটা ‘মিথে’র সন্ধান। এবং ঢাল-তরোয়ালহীন অবস্থাতেই। প্রস্তুতি থাকবেই-বা কী করে! ‘মিথ’টার মুখোমুখি হব, কি, হব না— এটা ঠিক করার জন্য সময় নিয়েছিলাম তো মাত্রই, ওই যে বললাম, আধ ঘণ্টা!

দোলপূর্ণিমার দিনটি তখন আর ক’য়েক সূর্য দূরে। এদিকে শহরের আকাশে মেঘের সোনাটা। এবং চরাচরময় ব্যাপ্ত অকাল-বৃষ্টির মল্লার। বসন্তের ফিনকি দিয়ে ওঠা চতুরালি এবং খুশিকণ্টকিত নির্ঝরের অনর্গল গতিপ্রাণতা ক’দিন আগেই যদিও থাবা বসিয়েছে বাতাসের গায়ে, তবু, সেসব নখদাগ ভেজা মেঘের দস্তানায় বেমালুম লোপাট! অফিসপ্রদত্ত সাপ্তাহিক ‘ডে-অফে’র সঙ্গে আর মাত্রই একটি দিন (ঘটনাচক্রে প্রাপ্ত) তালুতে কোনওরকমে ঠেকে থাকা জিভের অগ্রভাগের মতো আলগা লেগে থেকে দু’টি দিনের এক লিলিপুট-অবসর আমার দৈনন্দিনের প্লেটে সাজিয়ে দিয়েছে। প্রকৃতির হঠাৎ-শত্রুতায় বিরক্ত হয়ে সেটুকুও নষ্ট করব, না কি, বসন্তের অমল লাবণ্যে বিলগ্ন হওয়ার দুরাকাঙ্ক্ষা নিয়ে যা-থাকে-কপালে-করে শেষমেশ বেরিয়েই পড়ব?

বেরিয়ে পড়ব! কোথায়? ভাবাও যা, বেরিয়ে পড়াও তা।

শিমুলতলা!

যেখানে ‘মিথে’র কাঁথায় শত শত বুনন, বহুকৌণিক ফোঁড়ের ওঠা-পড়ার নৃত্যে ও রং-দারিতে যা এক ঘনবর্ণিল, চিরবিচিত্র ওয়ালহ্যাংগিং!

এই গল্পে অতএব ট্রেনের বার্থ-বুকিংয়ের কোনও গল্পই নেই! মাথা গোঁজার কাজটা একটু বেশি বাস্তব বলে, সেটুকুর জন্য একজনকে ফোন করে হোটেলের কিছু সুলুক-সন্ধান নিতেই হয়েছিল। কোনও ‘কনফার্মেশন’ নয়! স্রেফ হোটেল-ওয়ালার মুখের কথার ওপর ভরসা করেই ঘর ছাড়া!

বাড়ি থেকে কলকাতা স্টেশন, নেহাতই কম দূরত্ব। তবু বৃষ্টিসন্ধ্যার জুজু দেখিয়ে ট্যাক্সি-দাদা প্রথমেই পকেটে একটা কড়া ঝাঁকুনি দিলেন। যাই হোক, স্টেশনে পৌঁছে সেদিন জনগণের ‘কম্পোজিশন’টা একটু অন্যরকমই লাগল (এই ট্রেনটিতে এর আগেও বারদু’য়েক ওঠেছি, প্রথমবার স্টেশনে এসে অবাক! ধাক্কাধাক্কি তো দূরের কথা, জনমনিষ্যি নেই! ঠিক জায়গায় এসেছি তো— এমন একটা সন্দেহ ঘোরতর হয়ে উঠতে যাচ্ছিল সেবার; পরের বারেরটা এরকম নয়, কিন্তু সেবারও লোকজন খুব হাতেগোনা)! এত লোকজন কেন! আমার ট্রেন কলকাতা-জসিডি প্যাসেঞ্জার, রাত ১০টা ২৫। টিকিট কেটে ট্রেনের খোঁজে যখন ওভারব্রিজে ওঠা গেল, জানা গেল, আরও একটি ট্রেন ছাড়বে। এবং সময় হলে সেই ট্রেনও ছাড়ল। কিন্তু দেখা গেল ‘স্ট্যান্ডিং’ ভিড় তেমন কমল না! অর্থাৎ, এঁরা সকলেই আমার সহযাত্রী হতে চলেছেন। সেরেছে! ওঠা যাবে তো ট্রেনে!

অবশেষে ট্রেন এল। এবং সঙ্গে-সঙ্গে কিছু লোক দৌড় প্রতিযোগিতায় নামল। কিছু কুস্তিতে। কিছু কবাডিতে। তারই মধ্যে (শীৎকার ছাড়া) প্রায় সবরকম চিৎকারই কানে এল। সেই চিৎ(কার)-পুরে সংলাপ-বিলাপ-প্রলাপ-অপলাপের ট্যাপেস্ট্রি— ‘আরে পিসেমশাই ব্যাগটা নাকের ডগা থেকে সরান না’ বা ‘কাকু, ঠ্যাংটা তুলে নিন’ ‘জামাই, আমরা এদিকে’ ‘দাদা, এই তো উঠলেন, এর মধ্যেই এত গাঢ় ঘুম এসে গেল!’ বা ‘ট্রেনে উঠলেই তবিয়ত ঠিক নেহি, উঠিয়ে-উঠিয়ে’ জাতীয় কত-না মণিমুক্তো-ঝোলশুক্তো। এবং এই শুনতে-শুনতে একসময় অবাক হয়ে আবিষ্কার করলাম আমিও সপরিবারায়ৈঃ ওই ট্রেনের কামরাতেই!

কীভাবে, তা পুরোপুরি বুঝে ওঠার আগেই দেখি, সম্মুখে এ যে সিট কাড়াকাড়ির কুরুক্ষেত্র! আমার ভাগে পড়েছে একখানি উইন্ডোসাইডই! ট্রেন ছাড়ার আগেই যা ভিড় হয়ে গেল, তাতে বোঝা যাচ্ছিল, এ যাত্রা বড় সুখের যাত্রা নয়। প্রত্যেকেই যে যার জায়গাটুকুতে সোজা বসে। নড়া-চড়াহীন, যোগাসনে বসার মতো। গায়ে গা ঠেকে যাচ্ছে। এভাবে সারারাত?

না, মোটেই এভাবে নয়। আরও-আরও করুণভাবে বাকি রাত। সেকথা যথাকালে। ততক্ষণে অন্য প্রসঙ্গ। আশপাশে যাঁরা বসে আছেন তাঁদের সঙ্গে অল্প-স্বল্প কথাবার্তায় জানা গেল, প্রায় কেউই নিছক বসন্তের উন্মাদনায় পথে বেরোননি। এঁরা সবাই চলেছেন বৈদ্যনাথধাম। কেউ কেউ দেওঘরেরই সৎসঙ্গ আশ্রমে। বেশ! তাহলে, ট্রেন যা ছিলেন আর ট্রেন যা হইয়াছেন-এর বীজগণিতটি এতক্ষণে খানিক বোঝা গেল। একরাশ তীর্থযাত্রীর মধ্যে আমরা হংসমধ্যে বক যথা!

উনিশ শতকে ‘ড্যাঞ্চি’বাবুদের পশ্চিমে যাত্রা। কার্টুনিস্ট-ঋতুপর্ণ বসু।

ট্রেন যথাসময়ে ছাড়ল। এবং, দেখা গেল, আমরা যারা কোনওক্রমে বসতে পেয়েছি, তাদের দিকে, যাঁরা দাঁড়িয়ে আছেন তাঁরা তীব্র হিংসার চোখে তাকাচ্ছেন। ট্রেন পেরিয়ে চলেছে দমদম, ব্যারাকপুর। চন্দননগর, ব্যান্ডেল। এই করতে-করতে বেশ কিছু লোক ট্রেনের মেঝেতেই বসে পড়লেন। বৃষ্টিভেজা রাত-প্রকৃতির হাওয়া বেশ ঠান্ডা। একটা সময় জানলার কাচ নামাতে হল।

এমন সময় খেয়াল করা গেল, আমাদের সামনেই একজন দাঁড়িয়ে। যুবক। বিহারি। পোশাকে কেতা রয়েছে। মুখটি হাসি-হাসি (সেটা ওঁর দাঁতের অবস্থানের জন্যও হতে পারে)। আমাদের যখন ঠান্ডা লাগতে আরম্ভ করেছে, তার তখন দেখি গরম করতে শুরু হয়েছে! এবং লোকলজ্জার তোয়াক্কা না করে সে সটান খুলে ফেলেছে তার জামা। অচিরেই স্যান্ডো পরা শরীর দেখা গেল। মজবুত। পেশিবহুল হাত। কিন্তু যা এতক্ষণ চোখে পড়েনি, অথচ, পড়া উচিত ছিল (কেননা, চোখ তো জামায় ঢাকা ছিল না), তা হল তার ভুরু! একেবারে যেন তুলি ধরে এঁকে দেওয়া। কিছুদিন আগেও গ্রামগঞ্জের যাত্রাপালায় ঠিক যেমন মুখশ্রী দেখা যেত! ললিত কৃষ্ণ সেই ভ্রুযুগল প্রায় ধনুর মতো বাঁকিয়ে সে যখন ওই গেঞ্জি-পরা শরীরে বসে-বসে হেসে-হেসে দুলতে-দুলতে যেতে লাগল, তখন তা বাস্তবিকই একটা দেখবার মতো দৃশ্য হল! মেয়েরা (আমাদের জায়গাটায় মেয়ের সংখ্যাই বেশি ছিল) মুখ টিপে-টিপে হাসছে! ছেলেরা টুকটাক রসিকতা।

কিন্তু রাত আরও হতে দেখা গেল ওস্তাদের মার শেষ রাতেই। এই ভ্রু-ওয়ালাকে নিমেষে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু থেকে সরিয়ে আসরে (থুড়ি, কামরায়) এক নতুন মুখ। আসরে না-বলে সিলিংয়ে বলাই ভাল।

আমাদের তখন একটু-একটু তন্দ্রা এসেছে। হঠাৎ আমারই চোখ গেল ট্রেনের সিলিংয়ে। আপার বার্থের (প্যাসেঞ্জার ট্রেনে যেমন হয় আর-কী! কাঠের পাটাতন) ওপর দাঁড়িয়ে কেউ একজন একটা গেরুয়া কাপড় ওই বার্থটি যে রড থেকে ঝুলছে,তাতে বাঁধছেন! ঘুম থেকে উঠে চট করে আশ্চর্য হওয়া যায় নাকি! একটু তো সময় লাগবে! সেই সময়টুকুর মধ্যেই দেখি, তিনি কাপড়টির আর একটি প্রান্ত উল্টোদিকের লাগেজ-স্ট্যান্ডের রডের সঙ্গে বেঁধে ফেলেছেন! ‘ও দাদা কী করছেন’ বলতে-না-বলতেই দেখি সেই দোলনা-সদৃশ পরিসরে তিনি বসে গিয়েছেন! অ্যাঁ!! সে কী মশায়! ঝুলছেন? আমার গলা শুনে এক হিন্দিভাষীও শুনি কড়া গলায় তাঁকে নিষেধ করছেন। কিন্তু হঠাৎ কোথা থেকে কী হইয়া গেল, সেই ভদ্রলোক ট্রেনের ছাদ থেকে একেবারে ধপাস করে নীচে! সেই নীচে, যেখানে আগে থেকেই বহু লোক বসে আছেন। আমি ভয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললাম, এই ভেবে যে, এখনই কারও গোঙানি শুনেত পাব! কেননা, অত উঁচু থেকে তিনি যার ঘাড়ে পড়বেন, তাঁর ঘাড়টি আর আস্ত থাকেব না!

না! কারও তেমন কিছু হয়নি! একটি ছেলের আঙুলে একটু লেগেছে মাত্র। তার নির্ঘাত ফাঁড়া কেটে গেল। কিন্তু কাহিনি এখানেই শেষ নয়। পড়ে গিয়েও ভদ্রলোকের এতটুকু জড়তা নেই। তিনি আবার উঠে খেলাঘর বাঁধতে লেগেছেন! দেখে তো সেই হিন্দিভাষী এবং আমরাও রে-রে করে উঠলাম। ভদ্রলোক অনেক কষ্টে বোঝাতে চাইলেন (দেখা গেল, তিনিও হিন্দিভাষী), ও কিছু হয়নি, একটু আলগা হয়ে গিয়েছিল, এবার তিনি শক্ত করেই বাঁধবেন! হায় ভগবান! তাঁকে অবশ্য আর শক্ত করে বাঁধতে দেওয়া হল না। বলা হল, আপনি আপার বার্থেই কোনওক্রমে চেপে বসে থাকুন, মশায়, আর বাঁধবেন না, প্লিজ!

ফাটা ইতিহাস, কাঁচা শালপাতা, ভাঙা বারান্দা

কামরার আধো-আঁধারে এইরকম যখন চলছে, তখন হঠাৎ জানলার দিকে তাকিয়ে দেখি, কাচের বাইরে হালকা আলো! ভোর হচ্ছে। প্রায় এসে পড়েছি তাহলে! ফাল্গুনের এই প্রফুল্ল ভোরের সুষমা থেকে চোখ ফিরিয়ে থাকা অসম্ভব। ভূমিরূপ বদলে গিয়েছে। গিয়েছে সেই আসানসোল থেকেই। কিন্তু কামরার মধ্যে যা কীর্তি চলছিল, তাতে বাইরে তাকানোর কথা মনেই হয়নি। আর অন্ধকারে দেখাই-বা যেত কী? এখন ট্রেন যত যাচ্ছে, দিনটি যেন ক্রমশ ফুটে উঠছে। পাপড়ি মেলছে। এবং সব চেয়ে উত্তেজনাকর যা, সবুজের মহান সমারোহের মধ্যে অপরিমেয় লালের উৎসব, তা ক্রমশ গোচর হচ্ছে। একে-একে পেরিয়ে যাচ্ছি চিত্তরঞ্জন, জামতাড়া, মধুপুর!

এবং জসিডি। জসিডিতে নেমে মোকামা প্যাসেঞ্জারের জন্য অপেক্ষা। একটু বেশিই করতে হল। সে যা হোক, বসন্তসকালের অপরিমেয় মাধুর্যের মধ্যে দিয়ে গিয়ে শিমুলতলায় তো নামলাম!

শি-মু-ল-ত-লা!

অবশেষে। সকাল দশটার শিমুলতলা। রোদ তেতে উঠেছে। স্টেশনের যেদিকে নামলাম, সেদিকে বিশেষ কিছু নেই। হাতদশেক দূরত্বে ঠিক তিনটি দোকান। মাটির উনুন। কাঠের বেঞ্চ। মাথায় প্লাস্টিকের ছাউনি। বড় বড় কয়েকটি গাছ। কিন্তু তখন চোখও যেন শ্রান্ত, অবসন্ন।

ক্লান্ত শরীরে ঝটিতি অটো পাকড়ে যাওয়া গেল সেই ‘মুখ-বুকিং’য়ের হোটেলটিতে। কিছু অপেক্ষার পর ঘরও মিলল। একটু ফ্রেশ হয়ে নিলাম। আর তার পরেই শুরু হল আমার শিমুলতলা-দর্শন! মিথ-সন্ধান!

বসন্ত উপচে উঠছে শিমুলতলার অঙ্গে-অঙ্গে। হোটেলটির সামনে দিয়েই ট্রেন লাইন গিয়েছে। সারাদিনে হয়তো খানদশেক ট্রেনও এখান দিয়ে যায় না! চারিদিকে উঁচু-নিচু ঢেউ-খেলানো বিস্তীর্ণ ভূমিরূপ। শিমুলতলার নাম, দেখলাম, অবলীলায় পলাশতলাও হতে পারত! দিকে-দিকে পলাশ। কিছু গাছ ফুল ফুটিয়ে গেছে শত-শত, এখন ঝরিয়ে রিক্তা সন্ন্যাসিনী। আর বেশ কিছু গাছে তখনও জ্বলছে রক্তপ্রদীপ।

হোটেল থেকে স্টেশনে যাওয়ার পথটি অসাধারণ। সময় সেখানে যেন এখনও থমকে! পথটির দু’পাশে শুধু গাছ আর গাছ। মহাবৃক্ষ। সেই বনানীতে রয়েছে কিছু ইউক্যালিপটাসও। তার পাতা তখন নিঃশেষে গন্ধ ঝরাচ্ছে ফাগুনবাতাসে। আর সেই বনছায়ায়, সেই সুগন্ধীসমীরণে সারি সারি দাঁড়িয়ে রয়েছে পুরনো দিনের বাড়ি— বাংলো বাড়ি, বাগানবাড়ি, আশ্রমবাড়ি, ছোটবাড়ি, বড়বাড়ি… এমন কত না!

অপরূপ সেইসব বাড়ির দৃশ্যপট। রাশভারী জ্যাঠামশাইয়ের মতো দেখতে গম্ভীর লোহার দরজা, শুচিবায়ুগ্রস্ত পিসিমার মতো দালান, আর ফিচেল মামার মতো সদাখুশি ভিতরের বাগান-ওয়ালা একখণ্ড জমি! ওইসব চত্বরে ব্রাত্য শুধু ইতিহাস। পরিত্যক্ত অযত্নলালিত বাগানের গাছপালায় মাকড়সার জালে ধরা রয়েছে হয়তো কোনও অতীতসন্ধ্যার অমিত শিশিরবিন্দু, পুরনো দিনের লাল ধুলো! কে জানে! অথবা হুতোম রাত্তিরে কোনও বুড়ো পাখির ডানা ঝাপটানির মধ্যেই হয়তো ধরা রয়েছে স্মৃতিবেদনার কত না খয়েরি-সাদা পালক!

না, না! বর্ণনা নয়, কাব্য নয়, ইতিহাস তো নয়ই! আমার গন্তব্য হল মিথ। এবং মিথের কান টেনে ধরলে, কে না জানে, মিথ্যা-সত্য, অতিরঞ্জন-মায়াঅঞ্জন— সবই অবলীলায় চলে আসে!

উনিশ শতকে বাঙালিরা ঝেঁটিয়ে পশ্চিমে যেত। তখন ছিল মধুপুর-গিরিডি-শিমুলতলা নিয়ে সাঁওতাল পরগনা। সেখানে তারা জমি কিনত। কয়েকবিঘা জমিতে গড়ে নিত বাংলো প্যাটার্নের বাড়ি। উপনিবেশিক স্থাপত্যের সেইসব বাড়িতে শাল-শিমুল, মহুয়ার পাশাপাশি বেল, জুঁই, হাসনুহানা, ল্যাভেন্ডার, ম্যাগনোলিয়াও থাকত প্রচুর। স্যর আশুতোষের বাবার বানানো বাড়ি ছিল মধুপুরে— বিখ্যাত ‘গঙ্গাপ্রসাদ হাউস’। পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল হরেন মুখার্জির বাড়ি ‘স্বস্তিকা’। গিরিডিতে স্যর নীলরতন সরকারের ‘মাঝলাকুঠি’। শিমুলতলায় রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘মা হাউস’, লর্ড সত্যেন্দ্রপ্রসন্ন সিংহের ‘হাউস অব লর্ডস’!

সত্যি বলতে কী, ওই অঞ্চলে লোকে বাড়ি করবেন না-ই বা কেন? ওটা কি বাংলা-ছাড়া (এই সেদিন পর্যন্ত তো অঞ্চলটা বাংলাভূমির সঙ্গেই জোড়া ছিল। ১৯১২ সালে অংশটা বিহারের সঙ্গে যুক্ত হয়)? কে যাননি ওখানে? রাজনারায়ণ বসু, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, শরৎচন্দ্র, রাজেন্দ্রলাল মিত্র। শরৎচন্দ্র তাঁর কত গল্প-উপন্যাসের চরিত্রদের যে ‘পশ্চিমে’ পাঠাতেন। ‘পশ্চিম’ মানে তো এই জনস্থানমধ্যবর্তী উচ্চাবচ ভূমি-অঞ্চলই!

বাঙালিবাবুরা প্রথম-প্রথম ওই অঞ্চলে গিয়ে চমকে যেতেন। এত সস্তায় জিনিস মেলে এখানে! দুধ-ডিম-সবজি-মুরগি! যেমন টাটকা, তেমন সহজলভ্য। টাকায় ডজনখানেক দেশি ডিম কিনে ‘চেঞ্জারবাবুরা’ তাই আহ্লাদে ‘ড্যাম চিপ’, ‘ড্যাম চিপ’ বলে চিৎকার করে উঠতেন। আর সেই শুনে শুনে স্থানীয় লোকজন এই শ্রেণির লোকজনের নামই দিয়ে দিলেন ‘ড্যাঞ্চিবাবু’! ‘ড্যাম চিপ’ থেকে শ্রুতির পথ ধরে ‘ড্যাঞ্চি’ আর কী!

অর্থাৎ, শিমুলতলা অঞ্চলও হল এই ‘ড্যাঞ্চি’বাবুদের মুক্তাঞ্চল!

কী করে গড়ে উঠল এই মুক্তাঞ্চল, সে-ও একটা আলাদা ইতিহাস। একটা ট্রেনপথ একটা জাতির মানস গড়ে দিল। ১৮৫৪ সালে হাওড়া-রানিগঞ্জ রেলপথ চালু হল। সেই রেলপথই ক্রমশ বাঙালিকে পশ্চিমমুখো করে তুলল। কিন্তু বাঙালির চরিত্রে হাওয়াবদলের অভ্যাস একেবারেই যে ছিল না, এমনও কিন্তু নয়। দেবেনঠাকুরের আমলেই সেটা তৈরি হয়ে গিয়েছিল। স্বয়ং দেবেনঠাকুরের চরিত্রে তীব্র প্রকৃতিবিলাস ছিল। আবার বিদ্যাসাগরের মধ্যে বিন্দুমাত্র প্রকৃতিবিলাস ছিল না, কিন্তু তিনিও জীবনের একটা পর্বে সংসারের প্রতি তীব্র বিরাগ ও বিরক্তিবশত পশ্চিমমুখো হয়েছিলেন।

শোনা যায়, ইটাচুনা গ্রামের এক পেটরোগা বাঙালি নাকি রেললাইন পাতার ঠিকাদারি নিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন গিরিডি। খুবই সাবধানে খাওয়া-দাওয়া করতেন তিনি। ভয়ে-ভয়ে সেখানকার জলও খেতেন। খেতেই হতো। এই জল-সূত্রেই তাঁর জীবনে ঘটল মির‌্যাকল! তিনি আবিষ্কার করলেন, এখানকার জলের কী অপূর্ব গুণ! সবসময় খিয়ে পাচ্ছে। পেটের রোগ-টোগ সব নিমেষে উধাও! কী দারুণ চনমনে লাগছে সারাক্ষণ! বাহ্‌! শোনা যায়, মধুপুর থেকে গিরিডতে গিয়েছে যে ট্রেনপথ, সেখানেই ‘মহেশমুন্ডা’ নামের একটি স্টেশন পড়ে। সেসময়, ট্রেন এই স্টেশনে থামলেই নাকি চেঞ্জারবাবুরা স্টেশনের কুয়ো থেকে জল তুলে খেতেন! এখন এ-কাহিনি মিথ বৈকি!

এই সব গল্পের কান ধরেই সম্ভবত শুরু হল বাঙালির ‘চেঞ্জে’ যাওয়া। শরীর খারাপ হলেই শরীর সারাতে ভাল জল-হাওয়ার দেশ ‘পশ্চিমে’! কেমন সেই জল-হাওয়া? শুকনো খটখটে। আর আলো-রোদ-বাতাসের ছড়াছড়ি। সাহেবরা যদি শরীর সারাতে দেরাদুন-মুসৌরি-ডালহৌসি যেতে পারে, বাঙালিরা মধুপুর-গিরিডি-শিমুলতলা নয় কেন? শুরু হয়ে গেল একটা ‘প্যারালাল কালচার’। ভিন্ন জল-সংস্কৃতি। হাওয়া-সংস্কৃতিও। স্বাস্থ্যনিবাসের সংস্কৃতি। মন-মেজাজ ভাল করার সংস্কৃতিও।

আজকের শিমুলতলার মধ্যেও কি এই শিমুলতলা লুকিয়ে রয়েছে? আজও কি এখানে বাঙালিরা জমি কেনে? বাড়ি বানিয়ে হাস্নুহানার চারা লাগায় সংলগ্ন বাগানে? আজও কি এখানকার জল এবং হাওয়া তেমনই উপাদেয়, আনন্দনিষ্যন্দী, অমৃতপূর্ণ, মধুমথিত? আজও কি কোনও বনজ্যোৎস্নার দিনে বাংলোবাড়ির নিরালা বারান্দায় আরামকেদারায় চুপ করে পড়ে থেকে রোমান্টিক বাঙালি এই পৃথিবীর গাছ-আলো-আকাশের আশ্চর্য কনসার্ট শোনে একা-একা? অথবা, হাতে ক’দিনের অবসর জুটে গেলেই আত্মীয়-স্বজন সমভিব্যাহারে আজও কি বাঙালি চলে আসে শিমুলতলার স্থির অপার নির্জনতার কুয়োর ভিজে আঁধারে দু’দণ্ড জিরিয়ে নিতে?

না! এবং না! এবং না! ‘মিথ’ মিথই! মিথ্যা নয়। তবে, সত্য সেখানে মায়াময়। আবছা। ভোরের কুয়াশায় মাখা।

আজও যারা ওই পুরনো শিমুলতলার কাছেই যাচ্ছি বলে শিমুলতলা-ভ্রমণে যায়, তারা ভাবের ঘরে চুরি করে। কেননা, সেখানে আগের সেই মেজাজটাই নেই। বাঙালির সেই সমাদরটাই নেই। স্থানীয় সাধারণের সেই আন্তরিকতাটাও নেই। মুগ্ধতাটা তো নেইই। বিস্ময় নেই। উচ্ছ্বাস নেই।

তবে গ্লানিও নেই। গিয়েও যা আছে, আমাদের মতো জীবনযুদ্ধে চিরক্লান্ত বিষাদগ্রস্ত মানুষদের পক্ষে কম নয়। পুরনো মেজাজটা নেই হয় তো। তবে, আমেজটা আছে। সেই আমেজটাই অন্য জায়গার থেকে শিমুলতলাকে আলাদা করে দেয়। ওই বনগন্ধ পরিপূর্ণ স্টেশন রোড, তার দু’পাশের নানা ধরনের বাড়ি, নীল আকাশ, উদার উদাত্ত প্রচুর খোলা মাঠ, বনাঞ্চল, লাট্টু পাহাড়, বুনো ঝরনা— সবই ভ্রমণের একটা অন্য ঘরানা তৈরি করে দেয়।

একরাত্রের শিমুলতলায় বেড়াতে গিয়ে, ঠিক করেই রেখেছিলাম, কোত্থাও যাব না, মানে, কোনও ‘সাইট সিয়িং’ করব না। করিওনি। এবং আশ্চর্যের হলেও সত্য যে, ওখানেই বেশ কয়েকজন আমাকে বললেন, এখানে কীজন্য বেড়াতে এসেছেন, এখানে কিছু দেখার নেই কিন্তু!

দেখতে আমি আসিনি! অনুভব করতে এসেছি। বসন্তের সংগীতের মধ্যে অপরূপ সম কেমন, তা বুঝতে এসেছি। শুধু বিকেলে (একটিই বিকেল আমি পেয়েছিলাম) হেঁটে-হেঁটে লাট্টু পাহাড়ে গিয়েছিলাম। ওই উঁচু-নীচু ভূমিরূপের রোমাঞ্চটা অনুভব করব বলেই। অনেক আমবাগানের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে সেই পথ। আমমঞ্জরীর ঘ্রাণ নিতে-নিতে অপরাহ্ণ থেকে ক্রমশ গোধূলির দিকে যাত্রা করেছিলাম আমি। ভাল লেগেছিল। আর স্বাদ নিয়েছিলাম স্টেশন রোডের বিখ্যাত মিষ্টির দোকান গুপ্তের মিঠাইয়ের। অপূর্ব তার ছানার মুড়কি, পান্তুয়া! অপূর্ব তার কাঁচা শালপাতায় সামান্য টমেটো-ছড়ানো প্রায় সাদা আলুর তরকারি আর মুচমুচে কচুরির স্বাদ! নানারকম মানুষের ব্যস্ততা দেখতে-দেখতে, ট্রেন এলে-গেলে ট্রেনের শব্দ শুনতে-শুনতে, কুকুরের চঞ্চলতা দেখতে-দেখতে রাস্তার ধারে রাখা চৌকিতে বসে-বসে খেতে-খেতে সেই কচুরি-মিষ্টি-জিলিপির স্বাদ যেন বহুগুণ বেড়ে যায়!

এই গুপ্তের মিঠাইয়ের মতোই মিষ্টি একটা জায়গা শিমুলতলা। কাঁচা শালপাতা নয়, পলাশ-শিমুলের অলৌকিক প্রদীপ্তিতে বিজড়িত এই ‘পশ্চিম’ আমাদের মনে এখনও পূর্বদিগন্তের অপার আলো এনে ফেলতে পারে, যখন-তখন! হতে পারে, আগে এ অঞ্চলে এসে পৌঁছবার মধ্যে পথের যে রোমাঞ্চ-অ্যাডভেঞ্চার ছিল, গতিদিব্য আধুনিকতার জেরে তা অনেক কমে এসেছে, তবু, শিমুলতলা সব হারিয়েও এক স্বয়ংসম্পূর্ণ আশ্রয়, একটা বিকল্প স্বপ্নকামনা এবং আনন্দবিলাসের একটা কল্পক্ষেত্র হয়েই রয়ে গিয়েছে!

সমাপ্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *