ইতিহাস ছুঁয়ে

কলকাতার রাজমহলে, গোরস্থানেও

দীপশেখর দাস

কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের ১০-১২ জনের একটা গ্রুপ তৈরি হয়েছিল। সেই এক্সকারসনের পর থেকেই। সবকটারই পায়ের তলায় সরষে। অবশ্য আমাদের তিনজনের, আমার-সুদীপ্তা আর শুভরই, বেশি। আমরা ছিলাম ছকবাজ। মানে প্ল্যানমাস্টার আরকী! আর বাকিরা শাগরেদ। আসলে দলের মধ্যে আমরা হাতেগোনা কয়েকজনই মেসে থাকতাম। বাকিরা কল্যাণী বা তার আশপাশের বাসিন্দা। তাই মেসের একঘেয়েমি কাটাতে বেড়িয়ে পড়তাম এদিকসেদিক। আর এভাবেই গ্রুপ তৈরির বছরখানেকের মধ্যেই পৌঁছনো গিয়েছিল নদীয়ার প্রান্তিক গ্রাম শিকারপুর, নবাবরাজ্য মুর্শিদাবাদ, হুগলির হংসেশ্বরী মন্দির, ব্যান্ডেল চার্চ, উত্তর ২৪ পরগনার দক্ষিণেশ্বর মন্দির-ব্যারাকপুর মঠ-খেয়া ঘাট, দক্ষিণ ২৪ পরগনার সোনারপুর, সায়েন্স সিটি, কলকাতার ভিক্টোরিয়া, জাদুঘর, প্রিন্সেপ ঘাট, জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি আর হাওড়ার পাতিহালে। শেষের দর্শনীয় স্থানটি, আমার বাড়ি।

বিশ্ববিদ্যালয় শেষে যে যার বাড়ি ফিরে যাওয়ায় পায়ের তলার সরষেগুলো জমছিল না কিছুতেই। অনেকদিন পর ক্যালেন্ডারে একটা লাল কালি পেতেই জমিয়ে ফেললাম সরষেগুলো। ১২ জানুয়ারি প্ল্যান করে ফেললাম মার্বেল প্যালেস দেখার। আগেরদিন রাত্রে নেটে মার্বেল প্যালেস নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে চক্ষু ছানাবড়া। প্যালেসে প্রবেশ করতে নিতে হবে পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন দপ্তরের অনুমতি। যদিও খবরটা বাকিদের অজানাই রইল। জানতাম, কলকাতায় একবার জমায়েত হলেই মিলে যাবে ভ্রমণতীর্থের সন্ধান।

শিয়ালদহে হাওড়ার মতো বড়ঘড়ি নেই। তবুও একটা জায়গা তো ঠিক করতে হবে। আমাদের সংকেতস্থান ছিল এক নম্বর প্ল্যাটফর্মের টিকিট কাউন্টারের সামনেটা। আমরা সাতজন। বাকিরা বিএড-এর পরীক্ষায় ব্যস্ত। সময় তখন বড়জোর সকাল ১০টা। হুজুগ যখন ছিল তখন সেটা একবার বাইরে থেকে হলেও অন্তত চোখে দেখার বাসনা নিয়ে রওনা দিলাম মার্বেল প্যালেসের উদ্দেশ্যে। গেটের কাছে পৌঁছতেই হাতে মোয়া। উৎকোচ তত্ত্ব দুনিয়ার সেরা তত্ত্ব। রবি ঠাকুরের কথা মতো গান গেয়ে আর দ্বার খোলা হল না। বাম হাত দিয়েই রাজমহলের সিংহদুয়ার হাট করার ব্যবস্থা করা হল। কিন্তু ফটোগ্রাফির অনুমতি মিলল না কিছুতেই।

সত্যই রাজমহল বটে। বিশাল বাড়ি আর তার সামনে তার থেকেও বড় বাগান। বাগানে ছোটখাট চিড়িয়াখানা। সেখানে কী নেই!!! সাদা রাজহাঁস, গোলাপি পেলিক্যান, বার্কিং ডিয়ার, চিতল হরিণ, খরগোশ, বানর, হনুমান। অবশ্যই আলাদা আলাদা খাঁচায়। আর আছে বিভিন্ন ধরনের পাখি। ফেজ্যান্ট-ধনেশ-তিতির আরও কতকী। সুদীপ্তা তখন ঘোর চঞ্চল। এরকম একটা শ্বশুরবাড়ির কল্পনায় সে বিভোর। আর সে কল্পনাতেই বোধহয় খাঁচার ছাদে তার খরগোশের ডিম দর্শন। আসলে একটা সাদা প্লাস্টিক বলকে ডিম ভেবে ভুল করা। তা নিয়েই চলল খিল্লি। বাগান ঘুরে মহলে প্রবেশ করতে গিয়ে আবার বাধা। গাইড ছাড়া ভিতরে প্রবেশ করা যাবে না। অর্থাৎ স্বাধীনতায় ছেদ। অগত্যা গাইড-সহ অন্দরমহলে প্রবেশ। সেখানেও বড় বিস্ময়। পুরনো জমিদারের সম্পত্তি দারুণভাবে সংরক্ষিত। সে রাজা রাজেন্দ্র মল্লিক এর বিলিয়ার্ডস বোর্ড-ই হোক বা বেলজিয়াম গ্লাসের ঝাড়বাতি বা জাপানি-চিনা বৃহদাকার ফুলদানি।

আসলে এটি এখনও ব্যক্তিগত মালিকানাধীন। তাই বোধহয় এত পরিপাটি। মহলের অভ্যন্তরে রানি ভিক্টোরিয়ার হাজারো উপস্থিতি— তৈলচিত্রে আর আবক্ষ মূর্তিতে। তা-ও আবার ভিন্ন রূপে। সঙ্গে সেই সময়ের বিভিন্ন ইংরেজ মহাজনেরা। মহলে ঢুকে বাম হাতের দিকে প্রমোদমহল, সহজ কথায় জলসাঘর। অবশ্যই সাহেবসুবোদের আমোদের উদ্দেশ্যে। মহলের মাঝে বিশাল উঠোন। উঠোনেও ছোটখাট পক্ষীশাল। খাঁচার ভিতর ভিন্ন অচিন পাখি। মহলের প্রত্যেকটি কোণে বৈভবের ছাপ স্পষ্ট। আর ফুটে ওঠে রাজেন্দ্র মল্লিক মহাশয়ের ইংরেজ তোষণে উপাধি পাওয়ার লোভ।

দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, এইসব তোষণের পরোক্ষ ছোঁয়াতেই বোধহয় স্বাধীনতা লাভে আমাদের ২০০ বছর লেগে যায়।

মহল থেকে বেরনোর পরেও দেখি, অখণ্ড অবসর। সহজেই পাড়ি জমানো যেতে পারে দক্ষিণ পার্ক স্ট্রিটের কবরখানার দিকে। অতএব মেট্রো ধরে পার্ক স্ট্রিট। সেখানে ভুরিভোজ সেরে সোজা মিনিট ২০ হণ্টন। আর জমাটি আড্ডার মাঝে এর ওর লেগ পুল। বিশেষ করে দেবী আর শশীর। ওরা দুজনে বিশেষ বন্ধু। কিন্তু পাশাপাশি হাঁটতে দেবীর ভীষণ ভয়। পাছে চেনা কেউ দেখে ফেলে। আর এই ভয়ের কারণেই আমাকে উভয়ের নাম পরিবর্তনে বাধ্য করা। শুভ খুব করিতকর্মা ছেলে। লুকিয়ে ওদের পাশাপাশি হাঁটার ছবি তুলে চলে ব্ল্যাকমেল করা।

অবশেষে কবরখানায় পদার্পণ। এখানেও ফটোগ্রাফিতে নিষেধাজ্ঞা। প্রবাদপ্রতীম ইংরেজ সাহেবদের সমাধিগুলিকে উপদ্রব থেকে বাঁচাতেই হয়ত। অসংখ্য সমাধিক্ষেত্রের মাঝে আমার আকর্ষন শুধুই ডিরোজিও। ওঁর সমাধিতে মাথা ছোঁয়াতে এতটুকুও কুণ্ঠিত বোধহয় না। বরং মনে মনে গর্বিত হই। আর পূজা খুঁজে চলে জবুবাবুকে। মানে জোব চার্নক মহাশয়কে। যদিও তার আশা অপূর্ণই থাকে।

কলকাতা ঘোরার ক্লান্তি কাটাতে আমাদের প্রিন্সেপ ঘাট যাওয়া চাই-ই চাই। এবারেও তার অন্যথা হয় না। শেষ বেলাটা সেখানে কেটে যায় অচিরেই।

এবার সবার ঘরে ফেরার পালা। তার আগে শপথ গ্রহণ আবার মিলিত হওয়ার। অন্য কোনও বন্ধু-তীর্থে।

ছবির সৌজন্য- শুভ ও শ্রেয়াঞ্জলি।

সমাপ্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *