অন্য সফর

স্মৃতির শান্তিনিকেতনে

ঈশানী দত্ত রায়

শান্তিনিকেতনে আমার প্রথম যাওয়া ছোট্টবেলায়। স্কুলে ভর্তি হইনি তখনও। বাবা-মা এবং দিদির সঙ্গে উঠেছিলাম ট্যুরিস্ট লজে। ট্যুরিস্ট লজের কথা বলছি এই জন্য যে শান্তিনিকেতনে কোথায় থাকছি, তার সঙ্গেও জড়িয়ে রয়েছে অনেক কিছু। তখন সত্তরের দশক। নকশাল আন্দোলন চলছে। ট্যুরিস্ট লজে উঠেছিলেন এক ম্যাজিস্ট্রেট। তাঁর প্রহরার জন্য অন্তত তিন জন পুলিশকর্মী থাকতেন সবসময়। আর আমি, রাম-বকবকে এক বাচ্চা তাঁদের সঙ্গে গিয়ে এন্তার গল্প করতাম।

মনে আছে, ট্যুরিস্ট লজে রাতের খাবারে চিত্রকূট দিত। লজের ডাইনিং হলে মা আমাকে খাইয়েদাইয়ে দিল, আমি রিসেপশনে বসব বলে গুটগুট করে পা বাড়াচ্ছি, হঠাৎ দেখি প্লেটে করে চিত্রকূট আনা হচ্ছে। আমি দৌড়ে আবার টেবলে, ‘‘মা, মা, চিরকুট, চিরকুট।’’ গিয়েছিলাম কঙ্কালীতলায়, জীবনের প্রথম ঝালমুড়ি খেয়েছিলাম।

আশ্রমের স্মৃতি মনে নেই। তবে মনে রয়েছে, রাস্তায় এক দীর্ঘাঙ্গ, জোব্বা পরা মানুষকে দেখে ‘রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ’ বলে ছুটে গিয়েছিলাম। যদিও তাঁর দাড়ি ছিল না। ভদ্রলোক ঈষৎ হেসে, মাথায় হাত দিয়ে চলে গিয়েছিলেন। পরে শুনেছি, তিনি কৃষ্ণ কৃপালনী। আর মনে আছে, বিশালাকৃতি উইঢিবি দেখে আতঙ্কে দৌড়তে গিয়ে আছাড় খাওয়া এবং হাঁটু রক্তাক্ত করা।

মনে আছে, কোপাই নদীর কথা। মা গিয়ে জলে পা ডুবিয়েছিল। সেই থেকে কোপাইয়ের কাছে যেতেই হবে।

ছোটবেলার পর আবার শান্তিনিকেতনে, সদ্য গ্র্যাজুয়েশনের পর। ভাঙা পৌষমেলায়। অজস্র ফুল আর ২৫ ডিসেম্বরের রাতে কাচঘরে খ্রিস্টোৎসব। এসরাজে ছড় যখন প্রথম পড়ল, টান পড়ল শরীর-মনে। বাঁধা হয়ে গেল তারটি। প্রথম সমবেত গান, ‘বিশ্বসাথে যোগে যেথায় বিহারো…’ তেমন আর কোনওদিন শুনিনি। সেবার বলেছিলেন অম্লান দত্ত। ‘দ্য গুড সামারিটান’ নিয়ে। তাঁর সেই বক্তৃতার লিখিত রূপ পড়েছিলাম পরে। কিন্তু সেই যে শোনা কথাগুলো, তার ধ্বনি আজও লেগে রয়েছে মনে।

উঠল বাই তো কটক যাই বলে এক বিকেলের সিদ্ধান্তে খ্রিস্টোৎসবে গিয়েছিলাম আবার। মধ্যবয়স তখন পার। এসরাজে প্রথম ছড়টি যখন পড়ল, আবার কেঁপে উঠল ভিতরটা। চিরনতুন বলে মনে হল আবার। এমন আর শুনিনি, শুনবও না কোনওদিন।

এবার যখন গেলাম, সঙ্গীতভবনে গান শেখানো হচ্ছে— ‘যারে নিজে তুমি ভাসিয়েছিলে দুঃখধারার ভরা স্রোতে তারে ডাক দিলে আজ কোন খেয়ালে আবার তোমার ও পার হতে…’ বুদ্ধমূর্তিকে দেখতে দেখতে একবার দেখে নিলাম সুজাতাকে।

শান্তিনিকেতন বদলে গিয়েছে অনেক, আশ্রমিকেরা বলতে পারবেন ভাল। তবু এখনও, এখনও শহরের ক্লান্তি আর শব্দকে পিছনে ফেলে, অজস্র গাছ, ফুল, খোয়াই, সোনাঝুরি, কাচঘর, তিনি আমার প্রাণের আরাম, আত্মার শান্তি, মনের আনন্দ, প্রান্তিক স্টেশনে শুধু বসে থাকা, চাঁদ উঠতে দেখা, ভরা বর্ষায়, ফাগুনে, অসংখ্য কাশফুলে—সে অন্যরকম। একগুচ্ছ শান্তিনিকেতন বাড়িতে রাখব বলে একটি কাশ তুলে এনেছিলাম একবার, বাগানে দিয়েছিলাম পুঁতে। একাধিকবার থেকেছি পার্ক গেস্ট হাউসে। রাস্তা থেকে বাঁদিকের ঢাল দিয়ে নেমে হেঁটে বা রিকশয় যেভাবেই যাই না কেন, পথে দেখা দেবেই দু’য়েকটি হনুমান। গেস্ট হাউসের সামনে শালুক ফোটা পুকুরটি।

২০১১ সালের দোলে শান্তিনিকেতনে যাওয়ার পর ফেসবুকে ইংরেজি-বাংলা মিশিয়ে পোস্ট করেছিলাম। এখানে দিলাম।

THE MAN, THE MOMENT

it was dusk, the nxt moment the moon was gettin up in the sky. The playgrnd in shatiniketan ws full 2 the brim,as the moon was up, all rumblings stoppd evrybody spellbound by the serene quiet beauty people there wtd for more than one hour 2 c CHITRANGADA a dance drama by rabindranath.. 4 nxt 2 hrs the magic continud, all silent in appreciation, bound by music, song , all.who read chitrangada, who didnt, movd, spellbound. Isnt it amazing that one man still spells the magic that people still appreciate art, music?

মনে এল আমার খুব প্রিয় তাঁর লাইন, ‘দুখের রাতে নিখিল ধরা যেদিন করে বঞ্চনা, তোমারে যেন না করি সংশয়।’

The day b4 as i was coming to Bolpur, as the train was speeding thr the moonlit surrounding, he came 2 my mind..after death of his youngest son rabindranath was having a train journy, as he looked outside, evrything was drenchd in moonlight.. He thought so far i remember..

জ্যোৎস্নায় সমস্ত চরাচর প্লাবিত হইয়া গিয়াছে; কোথাও তো কিছু কম পড়ে নাই; সমস্ত কিছুর মধ্যেই সমস্ত কিছু রহিয়া গিয়াছে!

২০১২ সালের দোলের পরে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি।

বেড়াতে যাওয়া? না, বোধহয়। ফেলে আসা রাস্তায় হেঁটে আসা।

এবার নতুনত্বের মধ্যে টোটো। তা চড়ে গিয়েছি রূপপুর। সূর্য ডুবতে থাকা বিকেলে সরষে ক্ষেত, গমের প্রান্তরের পাশ দিয়ে দীর্ঘ যাত্রা। নির্জন রাস্তা পেরিয়ে গ্রামে। ‘আমার কুটিরে’র পিছন দিয়ে গাছে ভরা রাস্তা। ‘ছুটি’র সামনে নিস্তব্ধ পথে হাঁটাহাঁটি। শান্ত ঘুঘুদের দল। শুকিয়ে যাওয়া ক্যানাল। শিল্পী মঞ্জরী চক্রবর্তীর বাড়িতে নীলমণিলতা। ভোর হচ্ছে তাড়াতাড়ি। নানা পাখির ডাক। সকাল থেকে পাগলপারা দৌড়ের অস্থিরতা নেই।

এবারের সংক্ষিপ্ত থাকা-য় যেখানেই গিয়েছি, আমাদের সঙ্গী হয়েছে কুকুরেরা। ‘আমার কুটিরে’র ভিতর দিয়ে যখন কোপাইয়ের দিকে যাচ্ছি, আচমকা সঙ্গী হল এক চোখে দৃষ্টিহীন একটি কুকুর। বন্ধু সোমাকে বললাম, ‘‘আমাদের দেখে তো চোর মনে হয় না, তাহলে ধর্মপুত্রীই হব!’’ কুকুরটি গেল নদীর সামনে, আমাদের পাশে দাঁড়াল। আবার আমাদের পায়ে পায়ে ফিরে এল!

চিরকালীন ‘বোটু’র (বোকা ট্যুরিস্ট) মতো স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার পাশে গয়না কেনার কথা বলতেই হচ্ছে। ২০১২ সালে যখন গিয়েছিলাম, এক অবাঙালি তরুণ বলেছিলেন, ‘‘আমার মায়ের জন্য গয়না কিনব, একটু বেছে দেবেন প্লিজ?’’ ‘মা?’’ ‘‘হ্যাঁ, বছর পঞ্চাশেক বয়স।’’ বালা, হার, দুলের সেট মিলিয়ে দেওয়া হল।

এবার যখন কিনতে গেলাম, মনে পড়ল। একগোছা চুড়ি কেনা হল কন্যাসমার জন্য।

‘যদি তার এত কাল পরে মনে হয়

— দেরি হোক, যায়নি সময়?

শান্তিনিকেতনে বৃষ্টি: ছুটি শেষ| ভিজে আলতা-লাল

শূন্য পথ| ডাকঘরে বিমুখ কাউন্টর চুপ| কাল

হয়তো রোদ্দুর হবে, শুকোবে খোয়াই, ভিজে ঘাস|

লোহার গারদ ঘেরা আম্রকুঞ্জে কবিতার ক্লাস

কাল থেকে ফের| ঘুমে ফোলা চোখ, ভাঙা-ভাঙা গলা,

কবে সে মন্থর পায়ে পাতা-ঝরা ছাতিমতলায়

একা এসে ঘুরে গেছে? ঘণ্টা গুনে হঠাৎ কখন

অকারণে দিন গেলো| ছায়াচ্ছন্ন শান্তিনিকেতন|

কলকাতায় ফিরে যদি…যদি আজ বিকেলের ডাকে

তার কোনো চিঠি পাই? যদি সে নিজেই এসে থাকে?’

(শান্তিনিকেতন ছুটি—নরেশ গুহ)

সমাপ্ত

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *